উপন্যাস পার্ট

নিয়তির আগুন – ২

সুচীপত্র

১১

মধ্যরাতের দিকে অশোক এবং শিখেন্দর হলের মধ্যে হুইস্কি পান করছে। একের পর এক খুন হল তার দুই সঙ্গী। প্রথমবার যখন চন্দনের খুন হয়, তখনই তার সন্দেহ হয়েছিল যে এই বিষয়টি মীনুর খুনের সাথে সম্পর্কিত। আর পরে সুনীল হত্যার পর তার সন্দেহ বিশ্বাসে পরিণত হয় যে এটি শুধুমাত্র মীনুর খুনের কারণে ঘটছে.. যাই ঘটুক না কেন, আমরা আতঙ্কিত হব না, এই সংকল্প করার পরেও তাদের মনে ভয় যে সেই মনে হয় পরবর্তী নম্বরে। তাদের মধ্যে স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান এটা। তাই তারা মুখ থেকে উদ্বেগ ও ভয় দূর করার কোনো চেস্টাই করল না। সে একের পর এক হুইস্কির কয়েক গ্লাস খালি করে তার ভয় দূর করার চেষ্টা করছিল।

“আমি তোকে বলিনি?” শিখেন্দর রেগে এসে বলল।

অশোক প্রশ্নবোধক ভঙ্গিতে ওর দিকে তাকাল।

“ওই শালাকে বাঁচিয়ে রাখিস না। আমাদের তখন ওকে সরিয়ে দেওয়া উচিত ছিল.. ওই মেয়ের সাথে।” হুইস্কিতে একটা তেতো চুমুক দিতে দিতে শিখেন্দর বলল।

সে সন্দেহ করেনি.. নিশ্চিত ছিল যে এই দুটি ঘটনায় শারদের হাত আছে।

“আমরা ভাবিনি যে শালা এত বিপজ্জনক হয়ে উঠবে।” অশোক বলল।

“প্রতিশোধ… প্রতিশোধের ইচ্ছা মানুষকে বিপদজনক আর সাহসী করে ফেলে।” শিখেন্দর বলল।

“কিন্তু একটা কথা মাথায় আসছে না যে কিভাবে সে সব খুন করছে.. পুলিশ যখন সেখানে পৌঁছায়, তখন ঘরটি ভিতর থেকে তালাবদ্ধ এবং ভিতরে লাশ পড়ে আছে। শুধু তাই নয়, তারপরে সুনীলের গলায় কিভাবে? কাটা মাংসের টুকরোটা কি করে আমার রান্নাঘরে আসলো? আর সবচেয়ে বড় কথা, তখন আমি আমার ঘরের জানালা, দরজা সব ভালো করে বন্ধ করে রেখেছিলাম।” বিস্ময় প্রকাশ করে অশোক বলল।

অশোক শূন্যে কোথাও তাকিয়ে ভেবে বলল,

“এই সব দেখে, একটি জিনিস সম্ভব মনে হচ্ছে।”

“কোনটা?” হুইস্কির খালি গ্লাস ভর্তি করতে করতে শিখেন্দর জিজ্ঞেস করল।

“তুই ভূত বিশ্বাস করিস?” অশোক জিজ্ঞেস করল। কারণ সেই দৃশ্য সে নিজেই দেখেছে, কিন্তু সেই লোকটা এমন করে পালিয়ে গেল কী করে?

“বোকার মত কথা বলিস না.. তার নিশ্চয় কোন কৌশল আছে যেটা ব্যবহার করে সে এভাবে খুন করছে।” শিখেন্দর বলল।

“আমিও তাই ভেবেছি। কিন্তু মাঝে মাঝে মনে নানা ধরনের সন্দেহ আসে।” বলল অশোক।

“চিন্তা করিস না। সে আমাদের কাছে পৌঁছার আগেই আমরা লুকিয়ে আছি।” শিখেন্দর তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে বলল।

“আমাদের পুলিশি প্রটেকশন নেওয়া উচিত।” অশোক চিন্তা করে বলল।

“পুলিশ প্রটেকশন? তুই কি পাগল হয়ে গেলি? আমরা তাদের কি বলবো। আমরা খুন করেছি.. দয়া করে আমাদের রক্ষা করুন।

“এটা পরের জিনিস। প্রথমে তোর সুরক্ষা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস।

“তবে পুলিশের কাছে যা এবং তাদের প্রটেকশনের জন্য জিজ্ঞাসা বল।”

পুলিশের কথা উঠতেই অশোক খুব ভয় পেয়ে গেল।

“ওকে নিয়ে চিন্তা করিস না.. সব আমার উপর ছেড়ে দে।” শিখেন্দর খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে বললো, মাঝপথে তার কথা থামিয়ে।

 

রাজ কেবিনে বসে মাথা নিচু করে ভাবছিল। এরই মধ্যে সহকারী পবন সেখানে আসেন।

“স্যার।কিভাবে সেই খুনি খুনের জায়গায় পৌঁছে এবং তারপর সে কীভাবে বেরিয়ে আসে এই সম্পর্কে আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে।” পবন উত্তেজিত স্বরে বলল।

রাজ মাথা তুলে পবনের দিকে তাকাল। পবন দরজার বাইরে গিয়ে দরজা টেনে বন্ধ করে দিল।

“স্যার, এখন দেখুন।” সে বাইরে থেকে জোরে চেঁচিয়ে উঠল।

রাজ দেখল দরজার ভেতরের ল্যাচটা আস্তে আস্তে পিছলে বন্ধ হয়ে গেল। রাজ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

“স্যার, দেখেছেন?” সেখান থেকে পবনের আওয়াজ এলো।

তারপর আস্তে আস্তে দরজার ল্যাচটি অন্য দিকে পিছলে যেতে লাগল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজাটি খুলে গেল। রাজ খুব অবাক হল। পবন দরজা খুলে ভিতরে এলো, তার পেছনে তার হাতে কিছু একটা লুকিয়ে রেখেছে।

“তুমি এটা কিভাবে করলে?” রাজ কৌতূহলবশত আচার্য হয়ে জিজ্ঞেস করল।

পবন তার পিছনে একটা বড় চুম্বক লুকিয়ে রেখেছিল, সেটা বের করে রাজের সামনের টেবিলে রাখল।

“এই সমস্ত মন্ত্র এই চুম্বকের কারণ দরজার ল্যাচটি লোহার তৈরি।” বাতাস বলল।

“পবন তোমার সদয় তথ্যের জন্য। ঘটনাস্থলে পাওয়া সব দরজার ল্যাচগুলি অ্যালুমিনিয়ামের ছিল।” রাজ তাকে বাধা দিয়ে বলল।

“ওহহহ। ওটা অ্যালুমিনিয়াম ছিল।” তারপর আরেকটি বুদ্ধি মাথায় এলো সে বললো, “কোন সমস্যা নেই.. আমার কাছে এরও একটা সমাধান আছে।”

রাজ অবিশ্বাসের চোখে তার দিকে তাকাল।

পবন তার গলায় পরা পাথরের একটি নেকলেস বের করে, তার সুতোটি ছিড়ে, এক হাতে সমস্ত পাথর নিল এবং অন্য হাত দিয়ে তার থেকে সুতোর নাইলন সুতোটি টেনে নিল। হাতে জমে থাকা সব পাথর পকেটে রাখে। এখন তার অন্য হাতে সেই নাইলনের সুতো।

রাজ বিভ্রান্ত অবস্থায় সে কি করছে দেখতে লাগলো।

“এবার এই দ্বিতীয় আইডিয়াটি দেখুন। আপনি এখন আমার সাথে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন।” পবন বলল।

রাজ তাকে অনুসরণ করতে লাগল।

পবন দরজার কাছে গেল। সে সেই নাইলনের সুতো দরজার ল্যাচে আটকে দিল। সুতোর দুই প্রান্ত এক হাতে ধরে রাজকে বলল, “এবার আপনি দরজার বাইরে যান।”

রাজ দরজার বাইরে চলে গেল। পবনও এবার সুতোর দুই প্রান্ত এক হাতে ধরে দরজার বাইরে এসে দরজা টেনে দিল।

দরজা বন্ধ ছিল কিন্তু পবনের হাতে থাকা সুতোটি দরজার ফাটল দিয়ে ভেতরের কুঁচিটা ধরে আছে। পবন ধীরে ধীরে সুতার দুই প্রান্ত টেনে নিল এবং তারপর সুতার এক প্রান্ত হাত দিয়ে রেখে অন্য প্রান্তের সাহায্যে সুতোটি টেনে নিল। পুরো সুতো এখন পবনের হাতে।

“এবার দরজা খুলে দেখুন।” রাজকে বলল পবন।

রাজ দরজা ঠেলে অবাক হয়ে দেখল, দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। রাজ বিস্ময়ে পবনের দিকে তাকাতে লাগল।

“এখন আমার পূর্ণ বিশ্বাস হয়েছে।” বলল রাজ।

“কিসের?” পবন জিজ্ঞেস করল।

“এই চাকরির আগে কি ব্যবসা করতে।” মজা করে বলল রাজ।

দুজনেই একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসল।

“কিন্তু একটা কথা বল।” বলল রাজ।

প্রশ্নবিদ্ধ ভঙ্গিতে রাজের দিকে তাকাল পবন।

“দরজা ভিতর থেকে বন্ধ থাকলে?” রাজ জিজ্ঞেস করল।

“না। সেক্ষেত্রে। তাহলে একটাই সম্ভাবনা।” বলল পবন।

“কোনটা?”

“যে দরজাটি খোলার জন্য কোনও অপ্রাকৃতিক শক্তি থাকতে হবে।” পবন বলল।

 

থানার সম্মেলন কক্ষে বৈঠক চলছিল। সামনের দেয়ালে ঝুলানো সাদা পর্দায় প্রজেক্টর থেকে একটি লেআউট ডায়াগ্রাম দেখানো হচ্ছে। ওই চিত্রে দুটি বাড়ির লেআউট একের পর এক বেরিয়ে আসতে দেখা গেল। লাল লেজার পয়েন্টার ব্যবহার করে ইন্সপেক্টর রাজ সামনে বসা লোকদের কাছে তার পরিকল্পনা সম্পর্কে তথ্য দিচ্ছিলেন।

“মি. শিখেন্দর এবং মি. অশোক।” রাজ শিখেন্দ্রকে দিয়ে শুরু করল আর অশোক বাকি পুলিশের সাথে সামনে বসে আছে। রাজ যা কিছু তথ্য দিচ্ছিল সেই সব লোকেরা মনোযোগ দিয়ে শুনছিল।

“আমরা আপনার বাড়িতে এই জায়গায় ক্যামেরা স্থাপন করতে যাচ্ছি.. তিনটি বেডরুমে এবং তিনটি বাড়ির অন্য জায়গায়। উভয় বাড়িতে মোট ৬টি ক্যামেরা স্থাপন করা হবে। সেই ক্যামেরাগুলি সংযুক্ত করা হবে সার্কিট টিভিতে যেখানে আমাদের টিম বাড়ির যাবতীয় কার্যক্রম দেখবে। নিয়ন্ত্রিত নজরদারি করা হবে।

“তোর কি মনে হয় এটা দিয়ে কিছু হবে?” শিখেন্দর অশোকের কানে রেগে ফিসফিস করে বলল।

অশোক শিকেন্দরের দিকে তাকিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে রাজকে জিজ্ঞেস করল, “খুনী যদি ক্যামেরা থেকে দূরে থাকে?”

“মি. আমরা বাড়িতে লাইভ ক্যামেরা বসাতে যাচ্ছি.. যার কারণে আপনার পুরো বাড়ি আমাদের দলের নজরদারিতে থাকবে। এবং হ্যাঁ। আমি আপনাকে আশ্বস্ত করছি যে এটিই সবচেয়ে কার্যকর এবং একমাত্র পদ্ধতি যা আমরা ব্যবহার করতে পারি খুনিকে ধরতে। খুনি ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করলে কোনো অবস্থাতেই আমাদের হাত থেকে পালাতে পারবে না।। আমাদের কারিগরি দল দিনরাত পরিশ্রম করে এই ফাঁদ তৈরি করেছে।

“আচ্ছা, সব ঠিক আছে.. আর এটা করার পর যদি খুনি আপনার হাতে আসে, তাহলে তাকে নিয়ে আপনি কী করবেন?” শিখেন্দর জিজ্ঞেস করল।

“অবশ্যই আমরা তাকে আদালতের সামনে হাজির করব। এবং আইন অনুযায়ী তার যে শাস্তি উপযুক্ত মনে হবে, সেটা আদালতই সিদ্ধান্ত নেবে।” রাজ বলেন।

“এবং যদি সে পালিয়ে যায়?” শিখেন্দর আরও প্রশ্ন করল।

“যেমন মীনুর খুনিরা তাকে মেরে পালিয়ে গেছে।” পবন ব্যঙ্গ করে বলল।

শিখেন্দর আর অশোক তার দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকাল।

“আপনার কি মনে হয় আমরা খুনি।” অশোক রাগ করে জিজ্ঞেস করল।

“মনে রাখবেন, এখন পর্যন্ত আদালত আমাদের দোষী প্রমাণ করতে পারেনি।” শিখেন্দর রেগে বলল।

“মি. অশোক ও মি. শিখেন্দর। শান্তি। শান্তি। আমার মনে হয় আমরা আসল ইস্যু থেকে বিচ্যুত হয়ে যাচ্ছি। এই মুহূর্তে আসল সমস্যা হল আপনাদের কীভাবে সুরক্ষা দেওয়া যায়। আপনি মীনুর খুনের জন্য দায়ী কি না, এটা পরবর্তী ইস্যু।।” রাজ বলল। তাকে শান্ত করার লক্ষ্যে।

“আপনারাও আগে আমাদের সুরক্ষার কথা ভাবুন। বাকি জিনিসগুলি পরে দেখা যাবে।” শিখেন্দর গলায় কাশি দিয়ে পবনের দিকে তাকিয়ে বলল। যে ওকে জ্বালাতন করছিল। এই দুই ব্যক্তির সুরক্ষার জন্য মোতায়েন করা দলে পবনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। রাজও পবনকে শান্ত থাকার ইঙ্গিত দেন। পবন রাগে উঠে সেখান থেকে চলে যায়। তার চলে যাওয়ার সাথে সাথে পরিবেশ কিছুটা ঠান্ডা হয়ে গেল এবং রাজ আবার তার পরিকল্পনার বিস্তারিত তথ্য সবাইকে জানাতে শুরু করল।

শিখেন্দর এবং অশোক পুলিশ তাদের রক্ষা করতে পারবে কি না তা নিয়ে এখনও চিন্তিত ছিল। কিন্তু তাদের সুরক্ষার দায়িত্ব পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় ছিল না।

 

থানায় রাজের খালি চেয়ারের সামনে বসে ছিলেন এক ব্যক্তি। রাজ তাড়াতাড়ি সেখানে এসে নিজের চেয়ারে বসল।

“হ্যাঁ। এই মামলার ব্যাপারে আপনার কাছে কোন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে?” রাজ জিজ্ঞেস করল।

“হ্যাঁ স্যার।”

রাজ একবার উপর থেকে নিচ পর্যন্ত ঐ লোকটার দিকে তাকাল তারপর সে যা বলে তা শুনতে লাগল।

“স্যার, আমাদের পাড়ার সেই মেয়েটি, মীনু। যাকে খুজে পাওয়া যায়নি, তার ভাই আছে।” লোকটি শুরু করে এবং সে পুরো ঘটনাটি বলে চলে গেল…

একটা বড় বাড়ি, সেই বাড়ির চারদিকে শুধু কাঁচের জানালা। এতটাই যে প্রতিবেশীরাও জানে ওই বাড়িতে কী চলছে। জানালা দিয়ে হলের মধ্যে বসে থাকতে দেখা গেল মীনুর ভাই অঙ্কিতকে। এখন ওকে আগের থেকে একটু বেশি অদ্ভুত আর পাগল মনে হচ্ছিল। দাড়ি বেড়েছে, চুল ছড়িয়েছে। কিছু মাথায় একটা বড় টিকা আছে। হাতে কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে ফায়ারপ্লেসের সামনে বসে ছিলেন। হয়তো সেই পুতুলটা নিশ্চয়ই তার তৈরি। পাশে রাখা থালা থেকে হাত দিয়ে কিছু একটা তুলে নিয়ে সে কিছু তন্ত্র-মন্ত্রের মতো কথা বলতে থাকে।

“আবে তি বা রাস কেতিন স্ট্যাট।”

প্লেট থেকে যা তুলেছে তা ফায়ারপ্লেসের সামনে আগুনে ফেলে দেয়। আগুন জ্বলে উঠে ধাও ধাও করে। আবার সে একইভাবে কিছু অদ্ভুত তন্ত্র মন্ত্র উচ্চারণ করতে লাগল।

“কাটসি।ননতান্দি।বনশরপাট।রেভারত স্ট্যাটা।”

আবার সেই থালা থেকে ধানের মতো কিছু তুলে নিয়ে সেই আগুনে ছুড়ে মারে। এবার আগুন আরও শক্তিশালী হল। সে তার হাত দিয়ে সেই পুতুলটিকে পাশে রেখে সামনের দিকে ঝুঁকে মেঝেতে মাথা ঘষে।

পাড়া থেকে এক ব্যক্তি কৌতূহলী হয়ে দেখছিলেন অঙ্কিতের বাড়িতে কী হচ্ছে।

মাথা ঘষার পর অঙ্কিত উঠে অদ্ভূত ভঙ্গিতে চিৎকার করে উঠল। আশেপাশে যিনি উঁকি মারছিলেন তিনিও ক্ষণিকের জন্য ভয় পেয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। অঙ্কিতা নিচু হয়ে পাশে রাখা পুতুলটা তুলে নিয়ে আবারও অদ্ভুত ভাবে জোরে চিৎকার করে উঠল। এক অদ্ভুত ভয়ানক নীরবতা নেমে এসেছে সর্বত্র।

“এখন তুমি মরতে প্রস্তুত, চন্দন।” অঙ্কিত সেই পুতুলকে বলল।

“না। না। আমি এত তাড়াতাড়ি মরতে চাই না। অঙ্কিত তোমার পায়ে পড়ি। তুমি যা বলবে তাই করব। কিন্তু আমাকে ক্ষমা করে দাও।” অঙ্কিত যেন পুতুলটার সাথে কথা বলছে, যেন সে ডায়ালগগুলো বলছে পুতুলটা।

“তুমি কি আমার জন্য কিছু করতে পারো? তুমি কি আমার বোনকে ফিরিয়ে আনতে পারবে?” অঙ্কিত এখন নিজের সংলাপগুলি বলে।

“না। আমি এটা কিভাবে করতে পারি? সে যদি আমার হাতে থাকত, আমি এটা করতাম.. এই একটা জিনিস ছাড়া যেকোন কিছু করতে বল আমি তা তোমার জন্য করব।” অঙ্কিত পুতুলের সংলাপ বলতে শুরু করল।

“ঠিক আছে।। তাহলে এখনই মরতে প্রস্তুত হও।” অঙ্কিত সেই পুতুলকে বলল।

সেই প্রতিবেশী তখনও অঙ্কিতের জানালা দিয়ে লুকিয়ে ভিতরে উঁকি দিচ্ছিল।

 

১২

মধ্যরাতের ওপরে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। বের হওয়ার পথে কাউকে দেখা গেল না। অঙ্কিত ধীরে ধীরে বাসা থেকে বেরিয়ে এলো, চারিদিকে তাকাল। তার হাতে একটি ব্যাগ ছিল যার মধ্যে সে পুতুলটি ভরে এবং দরজা লক করে বেরিয়ে যায়। কম্পাউন্ড থেকে বেরিয়ে সে আবার চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিল। সামনের রাস্তার দিকে যেদিকে তাকায় সব অন্ধকার। এবার পথে পা বাড়িয়ে দ্রুত হাঁটতে লাগল। ওই পাড়ার লোকটি তার জানালা দিয়ে লুকিয়ে অঙ্কিতকে বাইরে যেতে দেখেছিল। অঙ্কিত পথে হাঁটতে শুরু করার সাথে সাথে লোকটি তার ঘর থেকে বেরিয়ে এল, লোকটি খেয়াল রাখছিল সে যেন কিছু না শুনতে পায় বা সে দেখতে না পায়। অঙ্কিত দ্রুত পায়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। অঙ্কিত অনেকদূর যাওয়ার পর লোকটি তাকে অনুসরণ করে তার পিছু পিছু চলতে শুরু করে।

লোকটি অঙ্কিতকে অনুসরণ করে কবরস্থানে পৌঁছল, কবরস্থানের চারপাশে ঘন গাছ। হয়তো গাছে লুকিয়ে পেঁচারা নিশ্চয়ই পথ দেখছে.. দূর থেকে কুকুরের কান্নার মতো অদ্ভুত আওয়াজ ভেসে আসছে। এই সব পরিবেশে লোকটা ভয় পেল। কিন্তু অঙ্কিত কেন এখানে এসেছে তা জানতে চায়। অঙ্কিত কবরস্থানে প্রবেশ করল এবং লোকটি কম্পাউন্ড প্রাচীরের পিছনে লুকিয়ে দেখতে লাগল অঙ্কিত কি করে। চাঁদের আলোয় লোকটা অঙ্কিতের ছায়া দেখছিল। অঙ্কিত একটা জায়গা ঠিক করল এবং সে সেখানে খনন শুরু করল। একটি গর্ত খুঁড়ে তিনি তার ব্যাগ থেকে পুতুলটি বের করে। অঙ্কিত সেই পুতুলকে কবর দিল যেন পুতুল নয়, মৃতদেহ। সে উপর থেকে মাটি ঢালা শুরু করে এবং মাটি ঢালার সময়ও তাঁর মন্ত্র-তুল্য কিছু বচসা চলছে। কাদামাটি ঢালার পর যখন গর্তটি মাটিতে ভরে গেল, অঙ্কিত সেই মাটির উপর দাঁড়িয়ে পা দিয়ে টিপতে লাগল।

লোকটা কথা বলছিল আর রাজ মনোযোগ দিয়ে শুনছিল, লোকটা আরও বলল-

“পরের দিন যখন জানলাম চন্দনকে মেরে ফেলা হয়েছে, আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।”

অনেকক্ষণ কেউ কিছু বলল না। এখন ঘটনা একটি নতুন মোড় নিয়েছে। রাজ ভাবল।

“আপনার কি মনে হয় অঙ্কিত খুনি?” রাজ তার তদন্তকারীর ভূমিকায় ফিরে আসতে আসতে জিজ্ঞাসা করলেন।

“না। আমার মনে হয় এই সব খুন করার জন্য সে নিশ্চয়ই তার কালো জাদু ব্যবহার করেছে.. কারণ সুনীলকে হত্যার আগের দিন অঙ্কিত একই রকম একটি পুতুল বানিয়ে তাকে কবরস্থানে দাফন করেছিল।” লোকটি বলল।

“আপনি এই সব কিছুতে বিশ্বাস করেন?” রাজ একটু ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল।

“না.. আমি বিশ্বাস করি না। তবে আপনাকে সেই জিনিসগুলিতে বিশ্বাস করতে হবে যা আপনি আপনার খোলা চোখে দেখতে পাচ্ছেন।” লোকটি বলল।

রাজের সঙ্গী, যে এতক্ষণ দূর থেকে তার কথা শুনছিল, হাঁটতে হাঁটতে তার কাছে এসে বলল-

“আমি আগেই সন্দেহ করেছিলাম যে খুনি একজন মানুষ নয় বরং একজন আধ্যাত্মিক শক্তি।”

সারা ঘরে নীরবতা ছড়িয়ে পড়ে।

“এখন সে আরেকটি পুতুল বানিয়েছে।” লোকটি বলল।

 

অঙ্কিতের ঘরের জানালা দিয়ে ভিতরের সবকিছু দেখা যাচ্ছিল। আজও সে অগ্নিকুণ্ডের সামনে বসে। সে হাত দিয়ে পুতুলটিকে পাশের মাটিতে রেখে নিচু হয়ে আগুনের সামনে মেঝেতে মাথা ঘষতে থাকে। এ সব করতে গিয়ে সে ক্রমাগত মন্ত্র তন্ত্র বকাবকি করতে থাকে। কিছুক্ষণ পর সে উঠে দাঁড়িয়ে পাগলের মতো অদ্ভুতভাবে চিৎকার করে উঠল। এত হঠাৎ এবং জোরে চিৎকার যে রাজ, পবন আর যারা জানালা দিয়ে উঁকি মারছিল এবং যে লোকটি তাদের সাথে নিয়ে এসেছিল, তারা হতবাক হয়ে গেল। সেই চিৎকারের পর পরিবেশে এক অদ্ভুত ভয়ানক নীরবতা নেমে আসে।

“মশাই অশোক, এবার আপনার পালা।” হাতে রাখা পুতুলটা নামিয়ে নিয়ে বলল অঙ্কিত।

কিন্তু তখনই দরজার বেল বেজে উঠল। অঙ্কিত ঘুরে দরজার দিকে তাকাল। পুতুলটাকে আবার মাটিতে রেখে উঠে দরজা খুলতে এগিয়ে এলো।

দরজা খুলল, রাজ আর পবন সামনে। সেই তৃতীয় লোকটি সম্ভবত সেখান থেকে পিছলে গেছে।

“মিস্টার অঙ্কিত, আমরা আপনাকে চন্দন এবং সুনীল হত্যার সন্দেহভাজন হিসাবে গ্রেপ্তার করতে এসেছি। আপনার নীরব থাকার অধিকার আছে.. এবং কথা বলার আগে আপনি আপনার আইনজীবীর সাথে যোগাযোগ করতে পারেন.. এবং মনে রাখবেন যে আপনি যাই বলুন না কেন তা তোমার বিরুদ্ধে কোর্টে ব্যবহার করা হবে।” দরজা খুলতেই রাজ ঘোষণা করল।

অঙ্কিতের মুখটা ছিল সম্পূর্ণ অভিব্যক্তিহীন, প্রবল অধৈর্য নিয়ে হাজির হল তাদের সামনে।

তাকে গ্রেফতার করার আগে রাজ কিছু প্রশ্ন করার সিদ্ধান্ত নেয়।

“আপনার সাথে এখানে কে কে থাকে?” রাজ প্রথম প্রশ্ন করল।

“আমি একা থাকি।” সে উত্তর দিল।

“কিন্তু আমাদের জানা মতে আপনার বাবাও আপনার সাথে থাকতেন।”

“হ্যাঁ যখন বেঁচে ছিল। কিন্তু এখন তিনি আর এই পৃথিবীতে নেই।”

“ওহহহ….দুঃখিত.. এটা কবে হল? মানে সে কখন মারা গেল?”

“মীনুর মৃত্যুর খবর শোনার পর কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি মারা গেলেন।”

“আচ্ছা, আপনি কি চন্দন আর সুনীলকে চিনতেন?”

“হ্যাঁ, আমি সেই শয়তানদের খুব ভালো করেই চিনি।”

চন্দন আর সুনীলের নাম নেওয়ার পর রাজ একটা জিনিস লক্ষ্য করলো যে ওর মুখে রাগ আর ঘৃণা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এবং সে এটি লুকানোর চেষ্টাও করেননি।

এখন রাজ তার সাথে আসল বিষয়ে সরাসরি কথা বলতে বদ্ধপরিকর।

“আপনি কি চন্দন আর সুনীলকে মেরেছন?”

“হ্যা।” সে ঠান্ডা গলায় বলল।

রাজ ভেবেছিল যে সে অস্বীকার করবে। কিন্তু সে কোন দ্বিধা করল না এবং সরাসরি ব্যাপারটা মেনে নিল।

“কিভাবে মেরে ফেললেন?” রাজ পরের প্রশ্ন করল।

“আমি আমার কাছের কালো জাদু দিয়ে তাদের হত্যা করেছি।” সে বলল।

অঙ্কিত পাগলের দিকে তাকায় রাজ কিন্তু তার উত্তরে আশ্বস্ত হয় না।

“আপনার এই কালো জাদু দিয়ে কি কাউকে মারতে পারবেন?” রাজ ব্যঙ্গ করে জিজ্ঞেস করল।

“কেন আমি কাউকে মারবো? আমি শুধু তাদেরই মারবো যাদের সাথে আমার শত্রুতা আছে।”

“এখন আপনি এই কালো জাদু দিয়ে কাকে মারবে?”

“এখন অশোকের নাম্বার।”

“এখন এই মুহুর্তে আপনি কি তাকে মেরে বলতে পারবেন?” রাজ তাকে তার কালো জাদুর ক্ষমতা প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞাসা করে।

“এখন নয়। যখন তার সময় আসবে, আমি অবশ্যই তাকে হত্যা করব।” সে বলল।

তার এই উত্তর শুনে রাজ তাকে আর কোন প্রশ্ন করতে আগ্রহী হল না। দুজনে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে চলে অঙ্কিতকে। এবারও সে প্রতিরোধ ছাড়াই সম্পূর্ণ সহযোগিতা করে।

রাজের মনে হল এই লোকটা হয় পাগল নয়তো খুব চালাক।

কিন্তু সে যা বলে তা যদি সত্যি হয়?

এক মুহুর্তের জন্য রাজের মনে এই ভাবনা ভেসে উঠল।

না.. এটা কিভাবে হতে পারে?

রাজ মনের কথাটা ঝেড়ে ফেলল।

রাজের সঙ্গী পবন অঙ্কিতকে জেলের একটি কক্ষে আটকে বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করে দেয়। রাজ বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। রাজ এবং তার সঙ্গী চলে যাওয়ার সাথে সাথে অঙ্কিত রেগে গিয়ে চিৎকার করে উঠল –

“তোমরা বোকা। যদিও আমাকে এই জেলখানায় বন্দী করে রেখেছ, তবুও আমার জাদু এখান থেকে কাজ করবে।”

রাজ আর পবন থেমে গিয়ে অঙ্কিতের দিকে তাকাতে লাগল। রাজ এখন অঙ্কিতের প্রতি করুণা অনুভব করছিল..অসহায়। বোনের মৃত্যুতে মাথাটা বিগড়ে গেছে।

ভাবতে ভাবতে রাজ আবার সঙ্গীকে নিয়ে সামনের দিকে হাঁটা শুরু করল। খানিকটা দূরত্ব কাভার করার পর সে আবার ঘুরে অঙ্কিতের দিকে তাকাল। সে এখন নিচে হেলান দিয়ে মেঝেতে কপাল ঘষছে এবং তার সাথে কিছু মন্ত্রও গুঞ্জন করছিল।

“একে নজরে রাখবে আর কাউকে এর কাছে যেতে দেবে না।” রাজ নির্দেশ দিল।

“হ্যাঁ স্যার।” রাজের সঙ্গী বাধ্য ভঙ্গিতে বলল।

 

অশোকের বাড়ি ও আশপাশের এলাকা পু রাতের অন্ধকারে রোপুরি তলিয়ে গেছে। বাইরে থেকে ঝ্বি ঝ্বি শব্দ ভেসে আসছিল। হঠাৎ বাড়ির পাশের গাছে আশ্রয়ের জন্য বসে থাকা পাখিরা ভয়ে উড়তে শুরু করে।

দুই পুলিশ সদস্য টিভির সামনে বসে অশোকের বাড়ির যাবতীয় কার্যক্রম পর্যবেক্ষন করছিলেন। অশোকের বাড়ির পাশের একটি গেস্টরুমে তাদেরকে জায়গা দেওয়া হয়েছে। ওই দুই পুলিশ সদস্যের সামনেই টিভিতে দেখা গেল অশোককে অস্থিরভাবে পাশ বদল করে ঘুমানোর চেষ্টা করছে।

“এরচেয়ে টিভিতে একটি সেক্সি দম্পতি দেখতে পেলে আমার ভালো লাগতো।” একজন পুলিশ ঠাট্টা করে বলে।

আর অন্য পুলিশ তার রসিকতায় মোটেও আগ্রহী ছিল না।

তারপর হঠাৎ একটি মনিটরে কিছু নড়াচড়া দেখা গেল। একটা কালো বিড়াল বেডরুমে দৌড়াতে দৌড়াতে এখান থেকে ওদিকে চলে গেল।

“এই দেখ, অশোকের বেডরুমে একটা কালো বিড়াল।” একজন বলল।

“আমরা কি এখানে কুকুর বিড়ালের গতিবিধির উপর নজর রাখার জন্য বসে আছি? যদি আমার বাবা জানতেন যে একদিন এমন একটি মনিটরে কুকুর বিড়ালের গতিবিধির উপর নজর রাখবো তাহলে তিনি কখনই আমাকে পুলিশে জয়েন করতে দিতেন না।” অপর পুলিশ অফিসারটি কটাক্ষ করে বলে।

হঠাৎ সেই বিড়ালটি কোণে রাখা একটি বাক্সের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এবং এখানে এই দুজনের সামনে রাখা সমস্ত মনিটরগুলো ফাঁকা হয়ে গেল।

“আরে কি হল?” বলতে বলতে একজন অফিসার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়।

তার অন্য সঙ্গীও চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। দুজনের মজা করার সময় শেষ তার বদলে মুখে এখন উদ্বেগ আর আতঙ্কের ছাপ।

“চলো তাড়াতাড়ি। দেখি কি হয়েছে।” দুজনেই তাড়াতাড়ি রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

 

একটি বেডরুম। বেডরুমে আবছা আলো ছড়িয়ে পড়েছে এবং বিছানায় একটা ছায়াকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখা যায়। হঠাৎ বিছানার পাশের টেলিফোনটা একটানা বেজে উঠল। সেই বিছানায় ঘুমিয়ে থাকা ছায়া ঘুমের মধ্যে হাত তুলে টেলিফোনটা তুলে নিল।

“হ্যাঁ।” সেই ছায়াটি ছিল রাজ।

ফোনের ওপাশে থেকে পুলিশ অফিসারের কন্ঠ ভেসে আসে, “স্যার অশোককেও একইভাবে মেরে ফেলা হয়েছে।”

“কি?” রাজ সাথে সাথে বিছানা থেকে উঠে বসলো।

বিছানার পাশের একটা বোতাম টিপে সে বেডরুমের বাল্ব জ্বালিয়ে দিল। তার ঘুম পুরোপুরি গায়েব।

“কি বললে?” রাজ যা শুনছে তা বিশ্বাস করতে পারছে না।

“স্যার অশোককেও খুন করা হয়েছে।”

“তোমরা মনিটরে এতগুলো ক্যামেরা লাগিয়ে প্রতিনিয়ত মনিটরিং করছো। তারপরও? রাজ রেগে বলল।

“স্যার কি হল। একটা বিড়াল ট্রান্সমিটারের উপর দিয়ে লাফিয়ে পড়ল এবং হঠাৎ করেই সব মনিটর বন্ধ হয়ে গেল। তারপর আমরা সেখানে গিয়েছিলাম মেরামত করতে। এবং সেখানে গিয়ে দেখলাম ততক্ষণে মারা গেছে। ঘটনা ঘটে গেছে।” অফিসার ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে।

অফিস থেকে ফোন আসতেই রেডি হয়ে ডলিকে একটা চুমু খেয়ে রাজ অশোকের বাড়ির দিকে রওনা দিল।

এত ফুল প্রুফের ব্যবস্থা থাকার পরও অশোক খুন হয়। মানে কি? ইতিমধ্যেই মানুষের মধ্যে পুলিশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। আর এবার পূর্ণ বিশ্বাস ছিল যে খুনির এইবার ক্যামেরা ট্র্যাপ থেকে পালানো অসম্ভব। তাহলে কোথায় ভুল হলো?

রাজের ভাবনাও দ্রুত গতিতে ছুটতে থাকে গাড়িটা মত।

রাজ বেডরুমে ঢুকল। বেডরুমে একই অবস্থায় বিছানায় পড়ে ছিল অশোকের মৃতদেহ। সর্বত্র রক্ত দেখা যাচ্ছে। রাজ লাশের প্রাথমিক পরীক্ষা করে এবং তারপর কক্ষটি পরীক্ষা করে। আরো দুই পুলিশ কর্মকর্তাও সেখানে ছিলেন। পুলিশের তদন্ত দল, যারা মাত্র সেখানে পৌঁছেছে এবং তাদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

“কিছু পাচ্ছেন?” রাজ তাকে জিজ্ঞেস করল।

“না স্যার। এখন পর্যন্ত কিছু নেই।” একজন বলল।

বেডরুমে ঢুকে সব কিছু মনোযোগ দিয়ে দেখতে রুমে একটা চক্কর দিল রাজ। প্রদক্ষিণ করার পর রাজ আবার বিছানার কাছে দাঁড়িয়ে বিছানার দিকে তাকাল।

খাটের নীচ থেকে দুটো চকচকে চোখ ওর দিকে তাকিয়ে আছে। এক মুহূর্ত ভয়ে কিছুটা পিছিয়ে গেল রাজ। সেই জ্বলজ্বল চোখগুলো তখন ধীরে ধীরে তার দিকে আসতে শুরু করে এবং হঠাৎ তার ওপর আক্রমণ করে। ধাক্কা খেয়ে সেটা দ্রুত সেখান থেকে চলে গেল। রাজ দেখে একটি কালো বিড়াল ঘাড়ের স্ট্র্যাপ পরা বিছানার নিচ থেকে বেরিয়ে এসে বেডরুমের বাইরে দরজা দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে। দরজা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বিড়ালটি পুরোপুরি থেমে গেল এবং সে ঘুরে ফিরে তাকাল। রুমে অদ্ভুত নীরবতা। বিড়ালটা রাজের দিকে এক বা দুই মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে আবার ঘুরে সেখান থেকে পালিয়ে গেল। কিছু না বলে দু-তিন মুহূর্ত কেটে গেল।

“ওটা বিড়াল। স্যার।” রুমের নীরবতা ভাঙল একজন অফিসার।

“ট্রান্সমিশন বক্স কোথায়?” বিড়াল থেকে রাজের কাজের কথা মনে পড়ল।

“স্যার এখানে।” একজন অফিসার একটি কোণার দিকে ইশারা করে বললেন।

 

১৩

সেই বাক্সটি নীচে মাটিতে পড়ে আছে। রাজ কাছে গিয়ে বাক্সটা তুলে নিয়ে দেখে সেটা ভেঙে গেছে। রাজ বাক্সটি উল্টে পাল্টে দেখে যেখান থেকে তুলেছিল সেখানেই আবার রেখে দেয়। তখনই রাজের ভাবনা বেডরুমের দরজার দিকে চলে গেল। যথারীতি দরজায় কড়া নেড়ে দেখে। কিন্তু এবার ভেতরের ল্যাচটি চেইন দিয়ে তালা দেওয়া।

“পবন। এখনই এখানে এসো।” রাজ পবনকে ডাকে।

পবন দ্রুত রাজের কাছে আসে।

“এই দেখ.. আর এখন বলো তোমার লজিক কি বলে.. মেরে ফেলার পর কি করে ভেতর থেকে আরামসে দরজা বন্ধ করে দিল?” রাজ বলল, চেইন আর লকের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

পবন সেই চেন আর লকিং ল্যাচের দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে বলল, “স্যার.. এখন আমি বিশ্বাসের ব্যাপারে নিশ্চিত।”

“কিসের?”

“যে খুনি একজন মানুষ নয় বরং কোন আধ্যাত্মিক শক্তি হতে পারে।” পবন শূন্যে উন্মাদের মতো তাকিয়ে বলল।

ওর কথা শুনে সবাই একে অপরের দিকে গভীর দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো।

 

থানায় বসে রাজ একটা কথা মন দিয়ে ভাবছিল আর মাঝে মাঝে ওর সঙ্গীর সাথে আলোচনা করছিল।

“মাথায় একটা কথা ঘুড়পাক খাচ্ছে আমার?” শূন্যের দিকে তাকিয়ে সঙ্গীকে বলে রাজ।

“কোনটা?” তার সঙ্গী জিজ্ঞেস করল।

“এখন পর্যন্ত তিনটি খুন হয়েছে রাইট?”

“হ্যা। তাই?”

“তিনটি খুনের আগে, অঙ্কিত খুব ভালো করেই জানত যে পরবর্তীতে কাকে হত্যা করা হবে।” রাজ বলল।

“হ্যা ঠিক আছে।”

“এবং তৃতীয় খুনের সময়, অঙ্কিত হেফাজতে ছিল।” রাজ বলল।

“হ্যাঁ এটাও ঠিক।” সঙ্গী বলল।

“তার মানে কি?” মনে হল যেন রাজ নিজেকেই প্রশ্ন করে।

“এর স্পষ্ট মানে জেলের ভেতর থেকেও তার কালো জাদু কাজ করছে।” সঙ্গী খুশি হয়ে বলল যেন সে সঠিক উত্তর পেয়েছে।

“বেকুবের মত কথা বলো না।” রাজ রাগে চেঁচিয়ে উঠলো তার দিকে।

“এমন কথা বলো যেটাতে যুক্তি আছে।” রাজ রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে তাকে বলল।

রাজের রাগ বুঝতে পেরে খুশিতে ঝলমলে রাজের সঙ্গীর মুখ ম্লান হয়ে যায়। কোনো কথা না বলে অনেকক্ষণ শান্তভাবে কেটে গেল।

রাজ বলে, “শোনো, আমরা যখন অঙ্কিতের বাড়িতে গিয়েছিলাম, একটা জিনিস খুব স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করেছি।”

“কোনটা?”

“অঙ্কিতের বাড়িতে এত বেশি জানালা ছিল যে তার আশেপাশের যে কেউ তার বাড়িতে কী ঘটছে তা স্পষ্ট দেখতে এবং শুনতে পারে।” রাজ বললো..

“হ্যা” তার সঙ্গী বলল, কিছু না বুঝেই।

হঠাৎ রাজের মনে একটা চিন্তা এলো। সোজা উঠে দাঁড়াল সে। রহস্য সমাধানের আনন্দ তার মুখে ফুটে উঠেছে।

তার সঙ্গীও তার পাশে দাঁড়িয়েছে, কিছুই বুঝতে পারছে না।

“তাড়াতাড়ি এসো।” তাড়াতাড়ি দরজার দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলল রাজ।

তার সঙ্গী, কিছু বুঝতে না পেরে শুধু তার পিছনে যেতে শুরু করে। রাজ দরজার কাছে গিয়ে হঠাৎ ব্রেক কষে।

“ঠিক আছে তুমি এক কাজ করো। তোমার দলকে একটা বিশেষ মিশনের জন্য প্রস্তুত হতে বলো।” রাজ তার সঙ্গীকে নির্দেশ দিল।

তার সঙ্গীর সম্পূর্ণ তালগোল পাকিয়ে গেল। হঠাৎ তার বসের কী হল তা বুঝতে পারছে না। বিশেষ মিশন…! মানে খুনি কে তা কি বস জানে! কিন্তু এইমাত্র যা আলোচনা হয়েছে, তাতে খুনির টিকিটাও তো বুঝার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। তাহলে বিশেষ মিশন কেন?

রাজের সঙ্গী ভাবতে থাকে। সে রাজকে কিছু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, তখন রাজ দরজার বাইরে যাওয়ার পথে আবার থামল এবং পিছনে ফিরে বলল,

“চলো তাড়াতাড়ি।”

তার সঙ্গী অবিলম্বে কর্ম তৎপরতা শুরু করে দেয়।

আমাকে কি করতে হবে এখন? বিশেষ মিশনে বিশেষ অভিযান। রাজের সঙ্গী প্রথমে টেবিল থেকে ফোনটা তুলে একটা নম্বর ডায়াল করতে লাগল।

 

ট্রাফিকের মধ্যে রাস্তা পরিষ্কার করতে করতে পুলিশের গাড়িটি দ্রুত ছুটছিল, সাইরেন বাজছিল এবং সেই গাড়ির পিছনে আরও চার-পাঁচটি গাড়ি যাচ্ছিল। সাইরেনের শব্দে যান চলাচল স্বয়ংক্রিয়ভাবে সরে গিয়ে ওই যানবাহনগুলোকে পথ দিচ্ছে। সেই আওয়াজের কারণে এবং এত বড় ঝাঁক পুলিশের গাড়ি দেখে আশেপাশের পরিবেশে এক অন্যরকম কৌতূহল ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। যানজট থেকে রাস্তা পরিষ্কার করে এবং পথে ঘন ঘন বাঁক নিয়ে গাড়িগুলি অবশেষে অঙ্কিতের বাড়ির কাছে থামল। পুলিশের একটি বড় দল দ্রুত যানগুলোর থেকে বেরিয়ে আসে তবে শৃঙ্খলার সাথে।

“তাড়াতাড়ি এসো। পুরো এলাকা ঘেরাও করো। তাড়াতাড়ি। খুনি যেন কোনো অবস্থাতেই হাত ফসকে না যায়।” রাজ তার দলকে নির্দেশ দিল।

একের পর এক পুলিশ দল সমান শৃঙ্খলায় পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে এবং তারা চারদিক থেকে পুরো এলাকা ঘিরে ফেলে। এত বড় পুলিশ দলের জুতার শব্দে পুরো এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে। আদোস পাড়ার লোকজন জানালা দিয়ে ও কেউ কেউ পর্দার আড়াল থেকে উঁকি মারছিল এবং ভয়ে দেখছিল বাইরে কী হচ্ছে।

রাজ দু-তিনজন পুলিশ নিয়ে একটা বাড়িতে গেল। যে লোকটি আগে অঙ্কিতের গল্প বলেছিল সে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।

“দয়া করে বলুন, কোন বাড়ি থেকে অঙ্কিতের বাড়ির সমস্ত কাজ কর্ম দেখা ও শোনা যায়।” রাজ লোকটিকে জিজ্ঞেস করল।

রাজের দিকে দুই তিনটা বাড়ির দিকে আঙুল দেখিয়ে লোকটা বলল,

“ওই দুটো। আর আমারটা।”

“আমাদের এই এলাকাটিকে পুরোপুরি সিল করতে হবে।” রাজ তার দলকে সেই বাড়িগুলোর দিকে নিয়ে যাওয়ার সময় বলে।

ওই তিনটি বাড়ি ছাড়াও রাজ তার এখতিয়ারে আরও দুটি বাড়ি নিয়েছে। একের পর এক দুই-তিন জনকে নিয়ে বাড়ির দিকে যায় এবং ঘর বন্ধ থাকলে নক করে। দরজা খুলে কিছু লোক বের হলে তাদের মুখে বিস্ময় আর ভয়ের ছাপ। এর মধ্যে রাজ তার সঙ্গীদের সাথে ওয়্যারলেসে যোগাযোগ রাখে। এরকম ভাবে বাড়ি খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে একটা বাড়ির কাছে পৌঁছে গেল ওরা। দরজায় টোকা দিল। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরও ভেতর থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। রাজের সাথে থাকা সবাই সজাগ হয়ে গেল। যার যার নিজের বন্দুক নিয়ে প্রস্তুত হয়ে আবার দরজায় টোকা দিল, এবার একটু জোরে.. তারপরও ভেতর থেকে কোনো সাড়া এল না।

কিন্তু এবার রাজের ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে গেল।

“দরজা ভাঙ।” সে আদেশ দিল।

এমন কাজে অভ্যস্ত পবন সবসময় দরজা ভাঙতে এগিয়ে থাকে, সে এবং আরও দু’জন মিলে দরজা ধাক্কা দিয়ে ভেঙে ফেলল। দরজা ভাঙ্গার পর সবাই প্রথমে সাবধানে পিছু হটে, এখন আস্তে আস্তে সাবধানে ভিতরে যেতে লাগল।

প্রায় সারা বাড়ি তল্লাশি চলে। কিন্তু বাড়িতে কেউ থাকার কোনো চিহ্ন ছিল না। রান্নাঘর এবং হল খালি। শেষপর্যন্ত বেডরুমের দিকে নজর দেয়। বেডরুমের দরজা সম্পূর্ণ খোলা। ভেতরে উকি দিল রাজ। ভিতরে কেউ ছিল না, এক কোণে শুধু একটা টেবিল পড়ে আছে।

রাজ এবং তার সাথে থাকা দুয়েকজন পুলিশ বেডরুমে ঢুকার সাথে সাথে তারা বিস্ময়ের চোখে পরস্পরের দিকে তাকাতে থাকে। তাদের মুখ হা। শোবার ঘরের এক কোণে রাখা সেই টেবিলে মাংস ও রক্তের টুকরো ছড়িয়ে আছে। সবাই অবাক আর ভয়ে একে অপরের দিকে তাকাল। সবার মনে প্রশ্ন কিন্তু কেউ একে অপরকে জিজ্ঞাসা করার সাহস পাচ্ছিল না। রাজ বেডরুমের জানালার দিকে তাকাল। জানালাটা ছিল পুরো খোলা।

“এখানে কে থাকে? খুঁজে বের কর।” আদেশ দিল রাজ।

তাদের একজন পুলিশ বাহিরে গিয়ে কিছুক্ষণ পর তথ্য সংগ্রহ করে ফিরে আসে।

“স্যার, আমি এই বাড়িওয়ালার সাথে যোগাযোগ করেছি.. সে কিছুক্ষণের মধ্যেই এখানে পৌঁছাবে.. কিন্তু লোকজনের তথ্য অনুযায়ী, রমেশ নামে একজন এখানে ভাড়ায় থাকে।” পুলিশটি বলে।

“সে যদি আসে, তাকে আগে আমার সাথে দেখা করতে বলো। ফরেনসিক লোকদের ডাকো। নির্দেশনা দিলো রাজ।

কিছুক্ষণের মধ্যে বাড়িওয়ালা এলেন। বাইরে জড়ো হওয়া মানুষের ভিড়ে। বাড়িওয়ালা এলে কানাঘুষা শুরু হলো।

“বাড়িওয়ালা কে?” সেই ভিড়ের দিকে যেতে যেতে রাজ জিজ্ঞেস করল।

একজন মাঝবয়সী লোক সামনে এসে ভীতু গলায় বলল, “আমি।”

“আপনার ভাড়াটেদের সম্পর্কে সমস্ত তথ্য নিশ্চয়ই আপনার কাছে আছে?” রাজ তাকে জিজ্ঞেস করলো।

“হ্যাঁ আছে।” রাজের হাতে একটা কাগজের টুকরো তুলে দিয়ে বাড়িওয়ালা বলল।

রাজ সেই কাগজের টুকরোটা নিল। বাড়িওয়ালা তাতে রাজেশের স্থায়ী ঠিকানা, ফোনের মতো সব তথ্য লিখে রেখেছিলেন।

“কিন্তু এসব দেখে মনে হচ্ছে, এই তথ্যগুলো ভুয়া এবং মিথ্যে।” বাড়িওয়ালা ভয়ে বললো।

“মানে? আপনি কি তার সব তথ্য যাচাই করে দেখেননি?” রাজ জিজ্ঞেস করল।

“না… মানে। আমি এটা করতে যাচ্ছিলাম।” বাড়িওয়ালা আবার ভয় পেয়ে বলল।

ইন্সপেক্টর রাজের মোবাইল বেজে উঠলে মোবাইলের ডিসপ্লে দেখে। ফোনটি ছিল তার নিজের সঙ্গীর কাছ থেকে। সে কল রিসিভ করে বলে,

“হ্যাঁ।”

“স্যার, আমরা মীনুর বন্ধু শারদ সম্পর্কে জানতে পেরেছি।” ওখান থেকে সঙ্গীর গলা ভেসে এল।

“খুব ভালো।” রাজ খুশি হয়ে বলল।

রাজের সঙ্গী তাকে একটি ঠিকানা দিয়ে দ্রুত সেখানে আসতে বলে।

 

শারদ বিছানায় শুয়ে জোরে জোরে কাশছে। মুখে দাড়ির জঙ্গল আর মাথার বড় বড় উস্কো খুস্কো চুল। কত দিন এই অবস্থায় বিছানায় শুয়ে আছে কে জানে। ঘর থেকে বের হওয়াও বন্ধ করে দিয়েছে।

যখন তার প্রিয়তমা মীনুকে ধর্ষণ ও খুন করা হয়েছিল, তখন সে এতটাই হতাশ এবং বিচলিত হয়ে পড়েছিল যে তার পরবর্তী কী করা উচিত তা ভেবে পাচ্ছিল না। সে মনেপ্রাণে অনুভব করেছিল যে দোষীদের শাস্তি হওয়া উচিত। কিন্তু কিভাবে সে কিছুই বুঝতে পারল না। এমন হতাশাগ্রস্ত ও ভুতুড়ে অবস্থায় সে রাতের আঁধারে শহরে ঘুরে বেড়াত পাগলের মত, আর মাঝে মাঝে সন্ধ্যাবেলায় সমুদ্র সৈকতে গিয়ে অস্তগামী সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকত। হয়তো তার নিজের জীবনটাও সেই অস্তগামী সূর্যের মতো মনে হয়। দিনরাত পাগলের মত ঘুরে বেড়ায় তারপর ক্লান্ত হয়ে বারে গিয়ে মদের নেশায় ডুবে যায়। এমনই ছিল তার রুটিন। কিন্তু এভাবে আর কতদিন চলবে? আস্তে আস্তে তার ঘোরাঘুরি কমে যায় এবং মদ্যপান বেড়ে যায়। তা এতটাই বেড়ে গেল যে এখন তার স্বাস্থ্যের অবনতি হয়েছে এবং বহু দিন ধরে বিছানায় শুয়ে আছে। বিছানায় শুয়েও সে পান করতে থাকে। নেশা একটু কমে গেলেই সেই ভয়ংকর ধর্ষণ ও খুনের দৃশ্য মনে পড়ে যেতেই সে আবার মদ্যপান করত।

হঠাৎ তার আবার কাশির শব্দ হলো। সে উঠার চেষ্টা করল। কিন্তু এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে উঠতেও পারছিল না। দেয়ালের সাহায্যে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালেও ভারসাম্য হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তার কাশি একটানা শুরু হয়। কাশির সময় এবার তার মুখ থেকে রক্ত আসতে থাকে। হাত দিয়ে মুখে রক্ত দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। উঠে ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিৎ। কিন্তু উঠতেও পারল না।

চিৎকার করে মানুষকে ডাকতে হবে। কিন্তু এতটা চিৎকার করার শক্তি তার ছিল না। এ অবস্থায় শারদ কি করবে?

অবশেষে সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল এবং হাতে রক্ত নিয়ে মেঝেতে কিছু লিখতে লাগল।

 

১৪

একজন লোক ফোনে কথা বলছিল, “হ্যালো থানা?”

ওপাশ থেকে উত্তর পেতেই বলতে থাকে…

….আমাদের পাড়ায় একজন লোক থাকেন। মানে..আমরা তাকে প্রায় ৭-৮ দিন দেখিনি। তার দরজাটাও ভিতর থেকে বন্ধ। আমরা তার দরজায় টোকা দিলাম। কিন্তু ভিতর থেকে কোন প্রতিক্রিয়া নেই। তার বাসা থেকে ভিতর থেকে পচা জিনিসের গন্ধ আসছে..আমার মনে হয় আপনাদের কেউ যদি এখানে এসে দেখেন।”

এই বলে তিনি উত্তরের জন্য থামলেন এবং “ধন্যবাদ।” বলে তিনি ফোন রেখে দিলেন।

ইন্সপেক্টর নাইনের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল খুব দ্রুত ফোনে দেওয়া ঠিকানায় পৌঁছে যায়। ওই লোকটা তাদের অপেক্ষায় ছিল। সেখানে পৌঁছতেই ওই ব্যক্তি তাদের একটি ফ্ল্যাটের বন্ধ দরজার সামনে নিয়ে যান। সেখানে পৌঁছতেই পচা জিনিসের দুর্গন্ধ নাকে লাগে। সবাই সাথে সাথে রুমাল বের করে নাক চাপা দেয়। যখন তারা সেই দুর্গন্ধের উৎসের খোজ পায়। সেই ঘর থেকেই দুর্গন্ধ আসছে। তারা দরজায় ধাক্কা দেয়। দরজা বোধহয় ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। দরজায় টোকা দিয়ে দেখে ভেতর থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়না। যে লোকটি ফোনে পুলিশকে জানিয়েছিল, সে বারবার একই কথা বলছে। শেষ পর্যন্ত দরজা ভেঙে দেয় পুলিশ। দরজা ভাঙ্গার পর সেই পচা গন্ধ ক্রমশ তীব্রতর হতে থাকে। মুখে-নাকে রুমাল চেপে ধরে আস্তে আস্তে ভেতরে যেতে লাগলো।

পুলিশ দল বেডরুমে পৌঁছলে তারা শরদের মৃতদেহ মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে, যা পচনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। রুমাল দিয়ে নাক শক্ত করে ঢেকে মৃতদেহের কাছে গেল। সেখানে মৃত্যুর আগে তার রক্তে লেখা কিছু মাটিতে দেখা যায়। তাদের একজন পুলিশ কাছে গিয়ে পড়ল,

“মীনু। আমাকে ক্ষমা করে দিও..আমি তোমাকে বাঁচাতে পারিনি। কিন্তু চিন্তা করো না….

 

রাজ ইন্সপেক্টর নিন্সের সামনে বসে আছে, যে পুলিশ অফিসার শারদের মৃত্যুর মামলা পরিচালনা করেছে।

ইন্সপেক্টর নিন্স শারদ সম্পর্কে তথ্য দিতে শুরু করলেন, “অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবনের কারণে ব্রোকাইটিসে মারা গেছে।”

“কিন্তু তার পরিচয় কিভাবে পেলেন?” রাজ জিজ্ঞেস করল।

যে ঘরে তার মৃতদেহ পাওয়া গেছে, সেই ঘরে তার কিছু কাগজপত্রও পাওয়া গেছে। সেখান থেকেই আমরা তাকে চিনলাম।

নিন্স তার ড্রয়ার থেকে শরদের ছবি বের করে রাজের সামনে রাখল।

“এই ছবিটি এবং ইন্সপেক্টর ধরমের পাঠানো তথ্যের কারণেই আমরা তার ঠিকানা এবং বাড়ি খুঁজে পেয়েছি।” নিন্স বলল।

“আপনি কি তার বাড়ির লোকজনের সাথে যোগাযোগ করেছেন?” রাজ জিজ্ঞেস করলো।

“হ্যাঁ। তার বাড়ির লোকজনকেও এখানে ডাকা হয়েছিল। তারাও লাশটি নিজেদের হেফাজতে নেওয়ার আগে শারদকে শনাক্ত করেছিল এবং পোস্টমর্টেমেও তার পরিচয় শারদ হিসেবেই রেকর্ড করা হয়েছে।” তিনি বলেন।

“কবে মারা গেছে? তার মানে কত দিন আগে লাশ পাওয়া গেছে।” রাজ জিজ্ঞেস করল।

“পোস্টমর্টেম অনুসারে, মার্চের শুরুর দু-তিন দিনের মধ্যেই সে মারা গেছেন।” অফিসার বলে।

“আর্লি মার্চ… মানে প্রথম খুনের অনেক আগে।” ভাবছিল রাজ।

“তিনি খুনি নন, যেমনটা আমরা বুঝেছি।” রাজ যোগ করে।

“হ্যাঁ, মনে হচ্ছে।” নিন্স বলল।

দীর্ঘ সময় কেটে গেল চুপচাপ ভাবে। মানে আমি যা সন্দেহ করেছিলাম তা সত্য হতে চলেছে।

রাজ ফোনে তার সঙ্গীর কাছ থেকে মীনুর প্রেমিক শারদের হদিস পাওয়ার সাথে সাথে খুব খুশি হয়েছিল। যাক কেসটি সলভ হওয়ার পথে। কিন্তু এখানে এসে দেখে, মামলাটি ভিন্ন মোড় নিয়েছে। শারদের মৃত্যুর সময়টা যদি দেখি, এই খুনের সঙ্গে তার সম্পর্ক থাকার কোনো সুযোগই নেই।

“শারদ যদি খুনি না হয়.. তাহলে খুনি কে?” সাথে সাথেই নিজেকে প্রশ্ন করলো রাজ।

ঘরের তিনজন লোক একে অপরের দিকে তাকাতে লাগলো। কারণ তাদের কাছে সেই প্রশ্নের উত্তর ছিল না।

নিন্স তার ড্রয়ার থেকে আরেকটি ছবি বের করে রাজের সামনে রাখে।

রাজ সেই ছবি তুলে নিয়ে দেখতে লাগল। ওই ছবিতে শারদকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখা যায় এবং তার সামনে মেঝেতে রক্ত দিয়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা ছিল,

“মীনু আমি দুঃখিত। আমি তোমাকে বাঁচাতে পারিনি। কিন্তু চিন্তা করো না, আমি একেকজনকে মেরে প্রতিশোধ নেব।”

এই ছবিটি দেখিয়ে নিন্স তাকে কী বলতে চায় তা বুঝতে পারে রাজ।

“এই হত্যাকাণ্ডে কোনো আধ্যাত্মিক শক্তি জড়িত থাকতে পারে শুনে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, কোনো মানুষের হাত নয়.. এই ছবি দেখিয়েও কি একই কথা বলবেন?” রাজ নিন্সকে জিজ্ঞেস করল।

নিন্স রাজ আর তার সঙ্গীর মুখের দিকে তাকাল।

“না, আমি সেরকম কিছু বলছি না। যেভাবে ঘটনাগুলো ঘটছে এবং মেঝেতে লেখা শারদের বার্তার মধ্যে খুব মিল। সেটাই আমি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছি।” নিন্স থতমত খেয়ে বলে।

 

কারাগারের চারিদিকে অন্ধকার ছড়িয়ে পড়েছে। অঙ্কিত এক কোণে একটা সেলে বসে বোন ভাবনায় মগ্ন। হঠাৎ সে উঠে দাঁড়ালো এবং তার পরনের কাপড়গুলো পাগলের মত ছিঁড়তে লাগলো। কাপড় ছিঁড়ে এদিক-ওদিক পড়ে থাকা ছেঁড়া কাপড়ের টুকরোগুলো সংগ্রহ করে। সে আবার সেই টুকরোগুলো থেকে একটা পুতুল তৈরি করতে লাগল। একটি রহস্যময়, ভয়ঙ্কর হাসি তার মুখে ছড়িয়ে পড়ে যখন পুতুলটি প্রস্তুত হয়।

“মশাই। শিখেন্দর। এবার তোমার পালা। বুঝেছ…।” সে পাগলের মতো পুতুলের সাথে কথা বলতে লাগল।

সেখানে ডিউটিতে থাকা পুলিশ অনেকক্ষণ ধরেই অঙ্কিতের কার্যকলাপের ওপর নজর রাখছিল। অঙ্কিতের কথোপকথন শোনার সাথে সাথে সে দ্রুত উঠে ফোনে গেল – তার উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানাতে।

শিখেন্দর বাড়িতে বসে মদ্যপান করছিল হলের মধ্যে। সেই সাথে মুখে অনেক দুশ্চিন্তা নিয়ে ক্রমাগত একের পর এক সিগারেট খাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর সে উঠে দাঁড়িয়ে ভাবতে ভাবতে ঘরের মধ্যে আস্তে আস্তে এগোতে লাগল। তাকে তার চলাফেরা দেখে বেশ ক্লান্ত মনে হচ্ছিল, অথবা তার নেশা হয়েছে বলে তাকে এমন দেখাচ্ছিল। কিছুক্ষণ হাঁটার পর আবার চেয়ারে বসে নিজের ভাবনায় ডুবে গেল। হঠাৎ সে ঘরে কারো উপস্থিতি টের পেল। মনে হচ্ছিল কেউ রান্নাঘরের বাসনপত্রে টেম্পারিং করছে।

এই সময় রান্নাঘরে কে থাকবে? সব দরজা জানালা তো বন্ধ। মনে হয় মনের ভয়।

হঠাৎ মেঝেতে একটা বড় পাত্র পড়ার আওয়াজ হল, শিখেন্দর উঠে দাঁড়াল।

কি হল? তার হৃৎপিণ্ড দ্রুত স্পন্দিত হতে থাকে। আমি শুধু শুধুই আতঙ্কিত হচছি। কোন বিড়াল টিড়াল হবে হয়ত। নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করে আস্তে আস্তে হাঁটতে হাঁটতে কিসের শব্দ হচ্ছে দেখতে রান্নাঘরে যেতে লাগলো।

এখন রান্নাঘর থেকে শব্দ আসা বন্ধ হয়ে গেছে। কোন শব্দ ছিল না। রান্নাঘরের দরজার কাছে গিয়ে আস্তে আস্তে রান্নাঘরের দরজাটা তির্যক করে ভেতরে তাকাল। রান্নাঘরে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। রান্নাঘরে ঢুকে। ভেতরে ঢুকে চারদিকে তাকিয়ে দেখল, পুরো রান্নাঘর ঘুরে ঘুরে দেখে..

কোথায়? কিছুই না। নাকি আমি ভুল শুনেছি। শুধু একটি খালি পাত্র মাটিতে পড়ে আছে।

রান্নাঘর থেকে ফিরতে ফিরতে বিভ্রান্তির মধ্যে সে এখন হল থেকে কিছু একটা ভাঙার শব্দ শুনতে পেল। শিখেন্দর হতভম্ব হয়ে হলের দিকে দৌড়ে গেল।

হলের মধ্যে সে মাটিতে তার হুইস্কির গ্লাস ভেঙে পড়ে থাকতে দেখে। নিচে পড়ার জন্য হুইস্কি ছড়িয়ে পড়েছে  এখানে-সেখানে। সে চারিদিকে তাকাল। কেউ ছিল না। শিখেন্দরের নেশা একেবারেই উবে গেছে। এখানেও কেউ নেই। আমার এসব কি হচ্ছে? গ্লাসটা কিভাবে নিচে পড়ে গেল। সে আবার চেয়ারে বসে ভাবতে থাকে। এখন পুরো বোতলটা মুখে দিয়ে রেখেছে।

 

সকালে হলে বসে চা পান করতে করতে টিভি দেখছিল রাজ। প্রতিটি চুমুক ধীরে ধীরে সে চা উপভোগ করছে। দেখতে দেখতে টিভির দিকে তাকিয়ে থাকলেও মনের মধ্যে নানা চিন্তার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সম্ভবত সে খুনের মামলার কথাই ভাবছে। তার চিন্তার দৌড়ে সে রিমোটের বোতাম পরিবর্তন করে দ্রুত চ্যানেল পাল্টাতে থাকে। অবশেষে কার্টুন চ্যানেলে থামে। কিছুক্ষণ কার্টুন চ্যানেল দেখার পর সে টেনশন, দুশ্চিন্তা দূর করে নিজেকে সতেজ করেছে। আবার চ্যানেল পরিবর্তন করে এখন ডিসকভারি চ্যানেল দেখা শুরু করে। ডিসকভারিতে চলমান প্রোগ্রামে আগ্রহী হয়ে উঠে। হাত দিয়ে রিমোটটা রেখে খুব মনোযোগ দিয়ে অনুষ্ঠান দেখতে লাগলেন।

ডিসকভারি চ্যানেলে চলমান প্রোগ্রামে একটি মাউস দেখানো হচ্ছিল। সেই ইঁদুরের গলায় একটা ছোট পাতা দেখা গেল। আর মাথায় খুব ছোট তার দেখা গেল। তারপর টিভি ফিগার বলতে শুরু করল-

“যখন কোনো প্রাণী কোনো কাজ করে, সেই ক্রিয়া সম্পাদনের জন্য তার মস্তিষ্কে একটি সংকেত পাঠানো হয়। আমরা যদি বাইরে থেকে তার মস্তিষ্কে ঠিক একই সংকেত দিতে সক্ষম হই, তবে আমরা সেই প্রাণীটিকে ধরে রাখতে পারি এবং বাইরে থেকে তাকে সমস্ত সংকেত দিয়ে তাকে আমরা যা খুশি করাতে পারি।

তখন টিভিতে একটা কম্পিউটার দেখা গেল, একজন বিজ্ঞানী কম্পিউটারের সামনে বসে আছেন। রাজ খুব মনোযোগ দিয়ে টিভিতে চলমান অনুষ্ঠান দেখতে লাগলো।

কম্পিউটারের সামনে বসা বিজ্ঞানী বলতে শুরু করলেন-

“এই কম্পিউটারের মাধ্যমে আমরা এই ইঁদুরের গলায় স্ট্র্যাপে বাঁধা এই চিপে বিভিন্ন সংকেত প্রেরণ করতে পারি, এই চিপের মাধ্যমে তা একটি মাত্র ইঁদুরের মস্তিষ্কে পৌঁছাবে এবং তারপরে আমরা যে সংকেত দিই, সে অনুযায়ী তার দেওয়া এই কম্পিউটার, সেই মাউস বিভিন্ন কাজ করতে শুরু করবে।”

তারপর টিভিতে সেই ইঁদুরটিকে খুব কাছ থেকে দেখানো হয়। তার গলায় একটি ছোট চিপ বাধা।

রাজ টিভিতে অনুষ্ঠান দেখছিল। তার মুখে বিস্ময়ের ছাপ।

টিভিতে যে বিজ্ঞানী আরও বলতে শুরু করলেন-

“এইভাবে আমরা এই সিগন্যাল ট্রান্সমিশনের মাধ্যমে সেই মাউসকে বিভিন্ন ধরনের কমান্ড দিতে পারি। এখন আমরা তাকে মাত্র কয়েকটি অর্ডার দিতে পেরেছি।”

তারপর কম্পিউটারের মনিটরে চলমান সফটওয়্যারে সেই বিজ্ঞানী মাউসের সাহায্যে ‘ডান’ বোতাম টিপলেন এবং মাউস ডান দিকে ঘুরে দৌড়াতে শুরু করে। বিজ্ঞানী কম্পিউটারে ‘স্টপ’ বোতাম টিপলে মাউস চলা বন্ধ হয়ে যায়। তারপর তিনি ‘বাম’ বোতাম টিপে এবং মাউসটি বাম দিকে ঘুরে দৌড়াতে শুরু করে। এরপর তিনি এই ‘জাম্প’ বোতাম টিপলেন এবং সেই মাউসটি দৌড়ানোর সময় লাফ দিল। আবার ‘স্টপ’ বোতাম টিপে এবং মাউসটি একটি ফুড জিনির সামনে পৌঁছে থেমে গেল। বিজ্ঞানী ‘খাও’ বোতাম টিপলেন এবং মাউস তার সামনে রাখা খাবারের জিনি খেতে শুরু করল। আবার তিনি ‘স্টপ’ বোতাম টিপলেন এবং মাউস খাওয়া বন্ধ করে দিল। এবার বিজ্ঞানী ‘অ্যাটাক’ বোতাম টিপলেন এবং মাউসটি তার সামনে রাখা খাবারের জিনগুলো না খেয়ে সেটিকে ভেঙে ফেলতে শুরু করল।

এসব দেখে হঠাৎ রাজের মনে একটা চিন্তার উদয় হল। একটা ঘটনা মনে পড়তে থাকে…

…..যখন দুই পুলিশ সার্কিট টিভিতে অশোকের বাড়ি পর্যবেক্ষণ করছিল, তখন একটি বিড়াল সার্কিট ট্রান্সমিট ইউনিটে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তার কারণে, অশোকের শোবার ঘরের সমস্ত কাজ টিভিতে দেখানো বন্ধ হয়ে যায়। আর পুলিশ দুজনে বেডরুমে পৌঁছানোর আগেই খুন হয়ে গেছে।

চিন্তায় মগ্ন রাজ টিভির সামনে থেকে উঠে দাঁড়াল। তার পরের কথা মনে পড়তে লাগলো….রাজ ও তার দল যখন তদন্তের জন্য অশোকের বেডরুমে গিয়েছিল এবং তদন্ত করার সময়, তারা খাটের নিচে উকি দিয়ে দেখেছিল যেখানে বিছানার নিচে দুটি উজ্জ্বল চোখ দেখতে পেয়েছিল।

যখন সেই চোখগুলো ধীরে ধীরে তার দিকে এসে হঠাৎ আক্রমণ করে যেন সে তার ওপর ঝাপিয়ে পড়বে তখন সে সেখান থেকে সরে গিয়ে আত্মরক্ষা করেছিল এবং পরে দেখল গলায় কালো ফিতা পরা একটি কালো বিড়াল বিছানার নিচ থেকে বেরিয়ে এসেছে আর বেডরুমের দরজা দিয়ে বাইরে দৌড়ে বেরিয়ে যায়….

এখন রাজের কাছে প্রতিটি রহস্য খুব স্পষ্টভাবে সমাধান হয়ে যাচ্ছিল। এখন আর সময় নষ্ট করতে চাই না। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে।

ভাবতে ভাবতে রাজ তড়িঘড়ি করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল পরবর্তি পদক্ষেপের জন্য।

 

১৫

রাজ কনফারেন্স রুমের মঞ্চে ডেস্কের পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন, শিখেন্দর, অন্যান্য পুলিশ অফিসার এবং তাঁর সঙ্গী তাঁর সামনে বসে আছে।

“এখন আমি জানি খুনি কীভাবে সব খুন করেছে।” রাজ একটা ভঙ্গি নিয়ে চারদিকে চোখ মেলে বলতে শুরু করল-

“তাই একটা প্ল্যান করেছি….” রাজ আত্মবিশ্বাসের সাথে কথা বলছিল।

“আপনি গতবারও একই কথা বলেছিলে তারপরও খুনি অশোককে মেরে ফেলতে পেরেছে।” শিখেন্দর তিক্তভাবে বলল।

“মশাই শিখেন্দর আমি মনে করি আপনার আগে আমার পরিকল্পনাটি শোনা উচিত এবং পরে মন্তব্য করা উচিত।” রাজও তাকে একই ভাবে উত্তর দেয়।

রাজ প্রজেক্টর অন করে, তার সামনে একটা ফিগার পর্দায় ভেসে উঠল।

“মনে হচ্ছে খুনি এ পর্যন্ত যতগুলো হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তাতে অবশ্যই একটি বিড়াল ব্যবহার করেছে। যার মানে আমি নিশ্চিত।” রাজ বলল।

রাজ আবার হাতের রিমোটের একটা বোতাম টিপে দিল। একটি বিড়াল এবং একটি কম্পিউটারে কাজ করা একজন মানুষের ছবি পর্দায় প্রদর্শিত হতে শুরু করে।

“এর আগে হত্যাকাণ্ডের তদন্তে পাওয়া কিছু তথ্য থেকে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে এটিই হতে পারে হত্যার একমাত্র উপায়। যে অনুসারে খুনি কম্পিউটারে বসে বিড়ালটিকে সমস্ত আদেশ দেয়। এবং ওয়্যারলেস প্রযুক্তির অধীনে সেই সমস্ত আদেশ এখানে এই বিড়ালের কাছে পাঠানো হয়.. এই বেল্টটি যা বিড়ালের গলায় দেখা যাচ্ছে। এটিতে একটি চিপ রয়েছে, যার মধ্যে রিসিভার লাগানো আছে.. এই সমস্ত সংকেত এই রিসিভার রিসিভ করে। পরে সেই সিগন্যাল বিড়ালের গলায় পরা ফিতা বিড়ালের মস্তিষ্কে পৌছায়। এবং সেই সব সিগন্যাল দ্বারা প্রাপ্ত আদেশ বাস্তবায়ন করে বিড়াল তার শিকারকে আক্রমণ করে। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি।”

রাজ আবার হাতের রিমোটের বোতাম টিপে দিল। সামনের পর্দা ফাঁকা হয়ে গেল। রাজ একটা নিঃশ্বাস নিয়ে কিছুক্ষণ থেমে, হাত দিয়ে রিমোটটা একপাশে রাখল।

“আমি আমার পরিকল্পনাকে দুই ভাগে ভাগ করেছি।” সামনে বসা লোকদের প্রতিক্রিয়া দেখে রাজ আরও বলে, “পরিকল্পনার প্রথম অংশ হল সেই বিড়ালটিকে সনাক্ত করা এবং সংকেতগুলি কোথা থেকে আসছে তা চিহ্নিত করা। তাহলেই আমরা খুনির হদিস খুঁজে বের করতে সক্ষম হব।” রাজ আবার এক মুহূর্ত থেমে গিয়ে বললো, “এবং পরিকল্পনার দ্বিতীয় অংশ হল বিড়ালের প্রাপ্ত সমস্ত সংকেত বন্ধ করা যাতে আমরা শিখেন্দরকে বাঁচাতে পারি।”

রাজ আবার তার পাশের রিমোটটা তুলে তার একটা বোতাম টিপে দিল। সামনের স্ক্রিনে একটা বাড়ির ম্যাপ ভেসে উঠতে লাগল।

“এটা শিকান্দরের বাড়ির মানচিত্র। আমাদের এটাকে দুই ভাগে ভাগ করতে হবে।” রাজ দুটি বৃত্ত আঁকেন, একটি ছোট এবং অন্যটি বড়, মানচিত্রে লেজার রশ্মি দিয়ে নির্দেশ করছিল।

“চিত্রে যেভাবে বর্ণনা করা হয়েছে.. বাইরের প্রথম বড় বৃত্ত, প্রথম অংশ এবং ভিতরের ছোট বৃত্তটি দ্বিতীয় অংশ।” রাজ লেজারের রশ্মি দুটো বৃত্তে একের পর এক রেখে বললো।

“বিড়ালটি বাইরে পৌঁছালে, আমরা বিড়ালটিকে ঘরে আসার সংকেত পাব কারণ আমরা সেখানে সিগন্যাল ট্র্যাকার এবং সিগন্যাল রিসিভার ডিটেক্টর স্থাপন করেছি।” রাজ তার হাতে থাকা রিমোটের লেজার বিমটি বন্ধ করে বলল।

“সিগন্যাল ট্র্যাকারের সাহায্যে আমরা সেই আগত সংকেতগুলির উত্স পাব। এবং একবার আমরা সেই সংকেতগুলির উত্স পেয়ে গেলে, আমরা খুনিকে সনাক্ত করতে পারব এবং তাকে রাইড হ্যান্ডে ধরতে পারর।” লেজার রশ্মি শুরু করে এবং বাইরের বৃত্তের দিকে নির্দেশ করে রাজ বলল ..

“যখন বিড়ালটি অন্য ভিতরের ছোট বৃত্তে পৌঁছাবে, সেখানে স্থাপন করা সিগন্যাল ব্লকারগুলি খুনীর কাছ থেকে পাওয়া সমস্ত সংকেত এবং আদেশগুলিকে ব্লক করে দেবে.. মানে পরবর্তীতে সেই বিড়ালের উপর তার কোন নিয়ন্ত্রণ থাকবে না।” রাজ লেসার বিম বৃত্তের ইনসাইডে ইশারা করার সময় তিনি কথা বলল।

রাজ তার পুরো প্ল্যানটা সবাইকে বুঝিয়ে দিল এবং বোর্ডরুমে বসা সবার দিকে তাকালো। সমস্ত অফিসার এবং সামনে বসা পুলিশ স্টাফরা রাজের পরিকল্পনায় সন্তুষ্ট।

“কারো কোন সন্দেহ আছে?” রাজ সামনে বসা মানুষের দিকে তাকিয়ে বলল, বিশেষ করে আলেকজান্ডারের দিকে।

“দেখ..” শিখেন্দর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বলল, এই প্ল্যানটা সে খুব একটা ভাল অনুভব করছে না।

সত্যি বলতে কি, সে ভিতর থেকে এতটাই ভেঙে পড়েছিল যে সে কোনও পরিকল্পনা নেওয়ার মতো অবস্থায় ছিলে না এবং সে বাধ্য ছিল কারণ স্পষ্টতই খুনিদের তালিকায় পরবর্তী নম্বরটি নিজের দেখতে পাচ্ছিল।

“তাহলে এখন এই প্ল্যান অনুযায়ী আমাদের কাজ শুরু করা যাক। পবনের সাথে কাকে কি করতে হবে তার একটা তালিকা দিয়েছি.. যদি আপনাদের কোন সন্দেহ থাকে তাহলে আমাকে জিজ্ঞেস করুন।”

রাজ তার দলের দিকে তাকিয়ে বলল।

 

শিখেন্দরের বাড়ির পাশে একটা গেস্ট রুম ছিল। ওই কক্ষে দুই পুলিশ কর্মকর্তা টিভিতে সিকান্দারের বেডরুম পর্যবেক্ষণ করছিলেন।

হঠাৎ কন্ট্রোল বোর্ডে একটি ‘বীপ’ বেজে উঠল।

“এসো এবং দেখ। কিছু একটা ঘটছে।” একজন অফিসার বলে।

একটি মনিটরে কিছু নড়াচড়া দৃশ্যমান। একটা কালো বিড়ালকে হাঁটতে দেখা গেল।

“দেখ আবার সেই বিড়ালটা।” বলল দ্বিতীয় অফিসার।

“দেখ, তার গলায় ফিতাও বাঁধা আছে।” বলল ফার্স্ট অফিসার।

“মানে। আমাদের সাহেব যেমন বলেছেন, সেই ফিতায় সম্ভবত একজন রিসিভার আছে।” দ্বিতীয় অফিসার বলল।

“এবং সেই রিসিভারটি সনাক্ত হয়েছে, সম্ভবত তার বীপই বেজেছে।” প্রথম অফিসার বলে।

তাদের মধ্যে একজন ওয়্যারলেস তুলে নিল এবং সে ওয়ারলেসে কথা বলতে শুরু করল।

“স্যার। গলায় ফাঁস পরা বিড়াল ঘরে এসেছে।” সেই অফিসার তার বসকে জানাল।

“ভাল। এখন সেই সিগন্যালগুলো কোথা থেকে আসছে তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করুন।” রাজ সেখান থেকে তাদের নির্দেশ দিল।

একইভাবে, সে বাড়িতে সংকেত ট্রেস করার জন্য যে ব্যবস্থা স্থাপন করেছিলেন তাও কম্পিউটারে সংকেত ট্রেস হওয়ার ইঙ্গিত দেখায়।

“স্যার সিঙ্গেলের সোর্সও পাওয়া গেছে।” কম্পিউটারের দিকে তাকিয়ে থাকা একজন অফিসার সাথে সাথে রাজকে জানায়।

“দারুণ কাজ.. আমি ইতিমধ্যে চলে এসেছি। আমি আর ৫ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাব।” রাজ বলল এবং ফোনটি সেখান থেকে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।

 

সামনে রাখা সার্কিট টিভির দিকে তাকিয়ে ছিল দুই অফিসার আর রাজ। সেই টিভিতে বিড়ালের সমস্ত নড়াচড়া দৃশ্যমান।

কম্পিউটারের মনিটরে এখন শহরের মানচিত্র দেখা যাচ্ছিল। সেই মানচিত্রে একটা জায়গায় একটা লাল দাগ একটানা জ্বলছিল। সেদিকে ইঙ্গিত করে একজন অফিসার বলে, “এই বিড়ালের সমস্ত সংকেত এবং নির্দেশনা এখান থেকে আসছে।”

“যেখান থেকে সিগন্যাল আসছে সেই জায়গাটা কতদূর।” রাজ জিজ্ঞেস করল।

সেকেন্ড অফিসার বললেন, “স্যার, ওই জায়গাটা এখান থেকে পূর্ব দিকে প্রায় ৫ কিমি হবে।”

“হ্যাঁ.. হয়তো এক মিটার এদিক ওদিক।” আরেকজন অফিসার মাঝখানে বলে।

রাজ শিখেন্দরের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ওয়্যারলেসে তার পুরো টিমকে নির্দেশের পর নির্দেশ দিচ্ছিল।

“আমি মনে করি সবাই সবার অবস্থান খুব ভালভাবে বুঝতে পেরেছ.. এখন আমাদের কাছে এটাই একমাত্র সুযোগ। এখন কোনো অবস্থাতেই খুনি যেন খপ্পর থেকে পালাতে না পারে। তাই যারা ওই জায়গায় অবস্থান নিয়েছ তারা যেন তাদের জায়গা ছেড়ে না যায় এবং কোনো কারণ ছাড়াই তাদের ভেতরে যাওয়ার দরকার নেই.. দায়িত্ব আলাদাভাবে হস্তান্তর করা হয়েছে। আর বাকিরা তখনই বাড়ির সামনে জীপের কাছে জড়ো হয়।” বলেই ভেতরে ঢুকে গেল।

প্রায় ১৫-২০ জনের টিম জীপের কাছে জড়ো হয়। সেখান থেকে যাওয়ার আগে রাজ তাদেরকে সংক্ষিপ্তভাবে ব্রিফ করে।

“আমরা সেই জায়গাটি খুজে পেয়েছি যেখান থেকে খুনি কাজ করছে.. তাই আমি আমার দলকে দুই ভাগে ভাগ করেছি। ৭ জন ইতিমধ্যেই শিখেন্দরকে রক্ষা করার জন্য এখানে মোতায়েন করা হয়েছে.. এবং বাকি ১৮ জন মানে তোমরা এবং আমি। আমাদের অপারেশনের দ্বিতীয় অংশটি করতে হবে অর্থাৎ খুনিকে ধরা।

রাজ এবার দ্রুত তার গাড়ির দিকে যেতে লাগল। গাড়ির দিকে যাওয়ার সময় তিনি সবাইকে নির্দেশ দিল, “এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গাড়িতে বস। আমরা পৌঁছানোর আগে খুনি যেন সেখান থেকে সরে না যায়।”

সবাই তাড়াতাড়ি তাদের গাড়িতে উঠে গেল এবং সমস্ত গাড়ি ধোঁয়া ছেড়ে চলে গেল – যেখান থেকে হত্যাকারী কাজ করছিল। ওখান থেকে সব যানবাহন চলে গেলে, সেখানে যে ধুলোর মেঘ উড়েছিল তা ধীরে ধীরে নামতে শুরু করে।

শিখেন্দরের বাড়ির পাশে একটি কেবিন এবং সেই কেবিনে দুই কনস্টেবল কম্পিউটারের সামনে বসে ছিল। তাদের একজন কম্পিউটারের কিবোর্ডের বোতাম টিপে কিছু একটা করছিল।

হঠাৎ কন্ট্রোল বোর্ডে আবার ‘বিপ’ ‘বিপ’-এর মতো শব্দ আসতে শুরু করে। দুজনেই প্রথমে কন্ট্রোল বোর্ডের দিকে তাকাল তারপর টিভি স্ক্রিনে। টিভি স্ক্রিনে দেখা গেল বিড়ালটি বেডরুমের কাছে পৌঁছে গেছে।

“আমার মনে হয় বিড়ালটি সিগন্যাল ব্লকিং এরিয়ায় ঢুকেছে।” একজন কনস্টেবল যেন নিজের মনেই বলল।

এবার ‘বিপ’ ‘বিপ’ আওয়াজ আরও জোরে আসতে লাগল।

“দেখুন। দেখুন। বিড়ালটি একক ব্লকচেইন এলাকায় পৌঁছেছে।” একজন কনস্টেবল দ্রুত বেতারটি তুলে নিল এবং কন্ট্রোল প্যানেলের একটি জ্বলন্ত আলোর দিকে ইশারা করে বলল।

“স্যার।বিড়ালটি এখন সিগন্যাল ব্লকিং এরিয়াতে পৌঁছে গেছে।” একজন রাজকে জানান।

“ঠিক আছে।এখন ওর দিকে ভালো করে নজর রাখো।” রাজের মেসেজ আসলো সেখান থেকে।

“হ্যাঁ স্যার।” বলল কনস্টেবল।

“আমি খুনীর পেছনে এসেছি এবং মনে রাখবে যে সেখানে পুরো দায়িত্ব তোমার।” রাজ তাকে নির্দেশ দেয়।

“হ্যাঁ স্যার।” বলল কনস্টেবল।

আর সেখান থেকে ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় রাজ।

“সিগন্যাল ব্লকার সমস্ত সিগন্যাল ব্লক করে দিয়েছে এবং এখন সেই হত্যাকারীর একটি আদেশও সেই বিড়ালের কাছে পৌঁছাবে না” একজন কনস্টেবল আবার উত্তেজিত হয়ে মনিটর এবং টিভির দিকে তাকিয়ে বলল।

বিড়ালটিকে এখন টিভি মনিটরে বিভ্রান্ত লাগছিল। কখনো সামনের দিকে কখনো পিছিয়ে যাচ্ছিল। হয়তো কোথায় যাবে বুঝতে পারছে না।

হঠাৎ তাদের সামনে রাখা সার্কিট টিভিতে দেখা গেল যে বিড়ালটি বোমার মতো একটি বড় বিস্ফোরণ হয়েছে। আর সাথে সাথে কেবিনে রাখা কম্পিউটার ও সার্কিট টিভি বন্ধ হয়ে যায়।

উভয় পুলিশও এই অপ্রত্যাশিত বিস্ফোরণে আঘাত পায়। তারা বুঝতে পারছে না কিভাবে এটা হলো। তারা এলোমেলো করে এদিক ওদিক দৌড়াতে লাগলো।

“হঠাৎ কি হল?” একজন কনস্টেবল ঘাবড়ে গিয়ে বলল।

সে এতটাই নার্ভাস ছিলেন যে তার শ্বাস বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

“সন্ত্রাসী হামলা নাকি?” কনস্টেবল নিঃশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে বলল।

“বেকুবের মত কিছু বলো না। দেখনি বিড়ালটা ফেটে গেছে।” দ্বিতীয় কনস্টেবল বলল।

“তাড়াতাড়ি এসো। আমাদের দেখতে হবে ওখানে কি হয়েছে।” কনস্টেবল দৌড়ে গিয়ে বলল।

 

১৬

দুজনে যখন শিখেন্দর বেডরুমে পৌঁছল। তারা দেখে বিস্ফোরণের কারণে বেডরুমটি আর বেডরুম নেই। সেখানে শুধু ইট.. পাথরের স্তূপ, সিমেন্টে তৈরি ভাঙা জিনিসপত্র এখানে-ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সেই স্তূপে তারা সিখান্দরের শরীরের কিছু অংশ দেখতে পায়। দুই কনস্টেবল সঙ্গে সঙ্গে সেখানে পৌঁছে। একজন সিকান্দারের শরীর থেকে ভাঙ্গা জিনিস সরিয়ে স্তূপ থেকে বের করে আনল। একজন তার নাড়ি স্পর্শ করল। কিন্তু পালস বন্ধ। বিস্ফোরণ ঘটার সাথে সাথেই হয়তো তার প্রাণহানি ঘটে।

এখন দুজনেই বেডরুম থেকে বেরিয় বাসার অন্য ঘরের দিকে রওনা দিল। তাদের অন্য সঙ্গীরা যেখানে অবস্থান করছিল সেখানে তাদের খোঁজ করতে থাকে। কিছু লোক আহত হয়ে চিৎকার করছিল, সেখানে তারা তাদের সাহায্য করতে ছুটে গেল।

এমনই মেসি অবস্থায় একজন পকেট থেকে মোবাইল বের করে একটা নাম্বারে ডায়াল করে…।

 

ইন্সপেক্টর রাজ ও তার দলের গাড়িগুলো রাস্তা দিয়ে দ্রুত ছুটছিল। তারা খুনীর হদিস জানত, এখন ধরার জন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেখানে যাওয়া দরকার। রাজের মনও ট্রেনের গতির সাথে দৌড়াদৌড়ি করছিল। সে মনে মনে সব সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছিল এবং প্রত্যেক পরিস্থিতিতে তার কৌশল কী হবে তা ঠিক করছিল। ঠিক তখনই তার মোবাইলের বেল বেজে উঠল। তার চিন্তার শিকল ভেঙে গেল।

মোবাইলের ডিসপ্লের দিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি ফোন অ্যাটেন্ড করে বললো, “হ্যাঁ বল।”

“স্যার, এখানে একটা গুরুতর সমস্যা হয়েছে….” ওখান থেকে কনস্টেবলের গলা ভেসে এল।

এই কথা শুনে ‘ গুরুতর সমস্যা হয়েছে’ আর রাজ হতাশ হতে লাগল। মনে নানা চিন্তা আসতে লাগল।

“কি? কি হয়েছে?” রাজ উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করল। হতাশা ঢাকার চেষ্টা করে।

“স্যার, বিড়ালটা এখানে বোমার মত ফেটে গেছে।” কনস্টেবল বলল।

“কি? একটা বিস্ফোরণ হয়েছে?” রাজের মুখ অবাক হয়ে হা হয়ে যায়.. তার একের পর এক পরিকল্পনা ভেস্তে যাচ্ছে।

“কিন্তু কিভাবে?” রাজ আরও জিজ্ঞেস করল।

“স্যার, সেই বিড়ালটি অবশ্যই তার গলায় পরা স্ট্র্যাপে প্লাস্টিকের বিস্ফোরক রেখেছিল। আমি মনে করি সিগন্যাল ব্লক করার সাথে সাথেই এটি বিস্ফোরিত হবে, এটি অবশ্যই এমনভাবে প্রোগ্রাম করা ছিল যাতে হত্যাকারীর শিকার যে কোনো পরিস্থিতিতে তার খপ্পর থেকে হাতছাড়া না হয়।” কনস্টেবল তার মতামত ব্যক্ত করে।

“কেমন আছেনশিখেন্দর? তার কি কিছু হয়েছে?” সর্বোপরি, এই অবস্থায়ও তাকে বাঁচাতে পেরেছে কি না, তা জানাও রাজের জরুরী ছিল।

“না স্যার, ওই বিস্ফোরণেই সে মারা গেছে।” সেখান থেকে কনস্টেবল বলল।

“ধুর?” রেগে রাজের মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, “আর তোমার লোক? তারা কেমন আছে?” রাজ আরও জিজ্ঞেস করল।

“দুই জন আহত হয়েছে।, আমরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি।” কনস্টেবল জানান।

“কেউ গুরুতর আহত নয়ত?” রাজ আবার সান্ত্বনা দিতে বলল।

“না স্যার। ক্ষতটা সামান্য।” ওখান থেকে একটা আওয়াজ এল।

“শোন, আমি ওখানকার পুরো দায়িত্ব তোমার হাতে তুলে দিচ্ছি। যেখান থেকে সিগন্যাল আসছে আমরা ঠিক সেখানেই আছি।

“হ্যাঁ স্যার।”

“তোমার লোকদের যত্ন নাও।” রাজ বলল আর ফোন কেটে দিল।

“তাড়াতাড়ি চলো। আমাদের তাড়াতাড়ি করা উচিত। অন্যদিকে আমরা শিখেন্দরকে বাঁচাতে পারলাম না। অন্তত এই খুনিকে এখানে ধরতে পারবো।” রাজ ড্রাইভারকে দ্রুত যেতে ইশারা করে বললো।

যেখান থেকে সিগন্যাল আসছিল তার কাছাকাছি পৌঁছে গেল রাজ ও তার দল। এটি একটি গুদাম এবং গুদামের সামনে এবং আশেপাশে অনেক খোলা মাঠ।

“কম্পিউটারে এই জায়গাটা দেখা যাচ্ছিল। তার মানে খুনি নিশ্চয়ই গুদামে লুকিয়ে আছে।” রাজ তার কাছের ম্যাপ এবং গুদামের চারপাশের জায়গার দিকে তাকিয়ে বলল।

ড্রাইভার রাজের দিকে তাকাল তার পরবর্তী আদেশের অপেক্ষায়।

“গাড়িটা ওয়্যার হাউস কম্পাউন্ডে নিয়ে যাও।” রাজ ড্রাইভারকে নির্দেশ দিল।

“হ্যাঁ স্যার।” ড্রাইভার বলল এবং সে গুদাম ঘরের খালি মাটিতে প্রবেশ করল..

তার পেছন পেছন আসা গাড়িগুলোও তার পেছনে ফাঁকা মাঠে ঢুকে পড়ে।

রাজের গাড়ির পেছনে সব গাড়ি গুদামের সামনে এসে থামল। গাড়ি থামানোর পর রাজ তার ওয়্যারলেস ক্যাপচার করে।

“গ্রুপ ২, গ্রুপ ৩ এক্ষুনি গুদাম ঘেরাও কর।” রাজ গাড়ি থেকে নামার সময় ওয়্যারলেসে অর্ডার দিতে শুরু করলো।

তার সঙ্গীরাও খুব দ্রুত গাড়ি থেকে নামতে থাকে।

“গ্রুপ ২ গুদামটি ডানদিকে এবং গ্রুপ ৩ গুদামের বাম দিকে ঘিরে রাখ।” রাজ তার আদেশ প্রকাশ করে যাতে কোনও ঝামেলা না হয়।

গাড়ি থেকে নামার পর, গ্রুপ ২ ডান দিক থেকে গুদামটি ঘিরে ফেলে এবং গ্রুপ ৩ বাম দিক থেকে গুদামটিকে পুরোপুরি ঘিরে ফেলে। খুনি যদি গুদামে লুকিয়ে থাকে এবং সে পালিয়ে যেতে চায়, তবে তাকে তাদের তৈরি করা এই দেয়াল দিয়ে যেতে হবে.. এবং এটি প্রায় অসম্ভব।

সন্তুষ্ট যে তার উভয় দলই ভাল এবং সম্পূর্ণরূপে গুদামটি ঘিরে রেখেছে, রাজ তার দল সহ প্রায় দৌড়ে গুদামের দরজায় চলে গেল।

“গ্রুপ ১ এখন গুদামে প্রবেশ করতে চলেছে। সবাই প্রস্তুত থাক। ভিতরে কত লোক থাকবে, তা এখনও জানি না।” রাজ আবারও সবাইকে সতর্ক হতে সতর্ক করে।

গুদামের এক জায়গায় কম্পিউটারের মনিটর জ্বলছিল, সেই জায়গা ছাড়া সব জায়গায় অন্ধকার। সেই কম্পিউটারের সামনে একটি ছায়া দাঁড়িয়ে ব্যাগে তার জিনিসপত্র ঠাসাঠাসি করে ভরতে যাচ্ছিল।. সবাইকে খুন করা হয়েছ। এবার সে পালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। লাগেজ ভর্তি করতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেল। সে নিশ্চয়ই গুদামের বাইরে বা ভিতরে কিছু নড়াচড়া অনুভব করেছে। সেভাবেই শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে এবং মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করতে লাগল।

সব কাজই এখন পর্যন্ত ঠিকঠাক ভাবেই হয়েছে। তো এখন আর আমি কেন ভয় পাচ্ছি। এখন পর্যন্ত কেউ আমাকে ধরতে পারেনি যেহেতু এখন আর আমাকে কে ধরতে পারবে। আমার পরিকল্পনায় কোন খুত ছিল না। কোন প্রমাণ নেই না। মনের মধ্যে চলমান চিন্তার বিভ্রান্তি ঝেড়ে ফেলে আবার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

হঠাৎ পেছন থেকে একটা আওয়াজ এলো, “হ্যান্ড আপ.. ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট..”

লোকটি সম্ভবত কিছু একটা অস্ত্র বের করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু তার চেয়েও চতুরভাবে এবং দ্রুত, ইন্সপেক্টর রাজ তার চারপাশে গুলির বর্ষণ করে।

“খুব স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করো না।” রাজ তাকে নির্দেশ দিল।

তার হাত থেকে যে ব্যাগটি তিনি নিয়ে যাচ্ছিলেন তা নিচে পড়ে গেল এবং সে তার দুই হাত তুলল। আস্তে আস্তে রাজের দিকে ফিরতে লাগল।

রাজ মনে মনে অনুমান করতে থাকে কে হবে? আর কেনই বা সে এই সব খুন করবে?

রাজের দিকে পুরোপুরি ঘুরে যেতেই মনিটরের আলোয় তার মুখটা দেখা গেল। তাকে দেখে ইন্সপেক্টর রাজের মুখে বিস্ময়ের ছাপ পড়ে।

সেই লোকটি আর কেউ নয় সুধীর, শারদ আর মীনুর বন্ধু, সহপাঠী!! রাজের মনে পড়ে গেল সে মীনু আর শরদের ক্লাসের গ্রুপ ফটোতে দেখেছে।

ইন্সপেক্টর রাজ একটি প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলেন, কিন্তু তার দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল ‘সে কেন এত খুন করবে?’ উত্তর তখনও বাকি।

ইন্সপেক্টর রাজ ও তার সঙ্গীরা ধীরে ধীরে এগোতে থাকে। রাজ ওয়্যারলেসে খুনিকে ধরার কথা পুরো টিমকে জানায়। তার চারদিক থেকে সুধীরকে ঘিরে ফেলে।

রাজ আর পবন তখন সুধীরের দুপাশে দাঁড়িয়ে। সুধীরের প্রতিরোধ এখন পুরোপুরি শেষ। রাজের দুই সঙ্গী তাকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যায়। রাজকে একটা প্রশ্ন তখনও বিরক্ত করছিল। রাজেরও মনে হয় তদন্ত তখনই শেষ হবে যখন এই প্রশ্নের উত্তরটি পাবে। অন্তত সবার মনের প্রশ্নের উত্তরটা পাওয়া উচিত। কেন? কেন সুধীর ওই চারজনকে মেরেছে?

সুধীর এখন পুরোপুরি বুঝতে পেরেছিল যে তার সব কিছু বলা ছাড়া উপায় নেই। সে তোতা পাখির মত সব বলতে লাগল।

 

….আমি মীনুর প্রেমে পড়েছিলাম। প্রফেসর ক্লাসে পড়াচ্ছিলেন এবং ছাত্রদের মধ্যে শারদ, মীনু ও সুধীর ক্লাসের বিভিন্ন জায়গায় বসে ছিল। সুধীর, সামনে তাকিয়ে, প্রফেসরের নজর তার দিকে নয় দেখে মেনুর দিকে ব্যঙ্গ করে। কিন্তু এটা কে? সে শারদের দিকে লুকিয়ে তাকাচ্ছে। জ্বলতে শুরু করে সুধীর।

আমি এই ক্লাসের একজন ভাল ছাত্র। একের পর এক মেয়েরা আমার উপর মরতে প্রস্তুত। কিন্তু যার মন চেয়েছে সে আমার দিকে তাকাতেও প্রস্তুত নয়? তার অহংবোধে আঘাত লাগে।

না এটা সম্ভব নয়।

 

১৭

একদিন বিকেলে, কলেজ থেকে বের হওয়ার সময়, আমি মীনুকে আমার প্রেমের কথা বলেছিলাম এবং তাকে বিয়ে করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলাম।

কিন্তু মীনু আমার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিল। আমি এটা আশা করিনি। সে আমাকে এত সহজে ফিরিয়ে দিল কী করে..? আমার অহংবোধে আঘাত হচ্ছিল।

কিন্তু কেন সে আমাকে বিয়ে করতে পারছে না, আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম তখন সে বললো আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি।

তারপর পরে আমি খুঁজতে লাগলাম এই অন্য ছেলেটি কে যার জন্য আমার ভালবাসা প্রত্যাখ্যান করেছে কিন্তু এটি জানতে আমার বেশি সময় লাগেনি। শারদ আর মীনু একটি পার্কে বসে প্রেম করছিল। আরও আমি আর একটি গাছের আড়ালে লুকিয়ে ছিলাম। আর ওর কথাগুলো শুনে আমার খুব রাগ হচ্ছিল।

“আমি ওকে অনেক ভালোবাসতাম। তার মানে আমার জীবনের চেয়েও বেশি।” সুধীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল।

“কিন্তু যখন জানলাম সে আমাকে চায় না কিন্তু শারদ। তখন আমি খুব হতাশ হলাম, নিরাশ হলাম, আমি তার উপর রেগে গেলাম। কিন্তু ধীরে ধীরে নিজেকে বোঝালাম যে আমি তাকে চাই, তার মানে এই নয় যে তারও উচিত আমাকে ভালবাসা। আমি যাকে চাই তাকে স্বাধীনভাবে চাই।” সুধীর বলল।

“কিন্তু ওই চারজনকে মারলে কেন?” আসল কথা জিজ্ঞেস করল রাজ।

“কারণ আমি যতটা ভালবাসি অন্য কেউ করতে পারে না।” সুধীর গর্বের সাথে বলল।

“শারদও তাকে ভালবাসত।” রাজ তাকে আরও জ্বালাতন করার চেষ্টা করে বলল।

“সে কাপুরুষ ছিল। মীনুকে ভালোবাসার ক্ষমতা তার ছিল না।” সুধীর বিরক্তি নিয়ে বলল, “জানেন? যখন তাকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছিল, শারদ আমাকে একটি চিঠি লিখেছিল।” সুধীর যোগ করে।

“কি লিখেছে?” রাজ জিজ্ঞেস করল।

“লেখা ছিল যে তাকে মীনুর ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিশোধ নিতে হবে। এবং সে ওই চার অপরাধীকে খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু সে প্রতিশোধ নেওয়ার সাহস করতে পারছে না। তাকে বন্ধু হিসেবে চিনতাম.. কিন্তু সে যে এত ভিতু, আমি কখনো ভাবিনি। তাহলে এমন পরিস্থিতিতে আপনি আমাকে বলে আমি কি করব? আমারই কিছু করার ছিল। কারণ সে আমাকে না চাইলেও তার জন্য আমার সত্যিকারের ভালোবাসা ছিল।” এই কথা বলে সে দুর্বল অনুভব করতে লাগল। এবং পা দুর্বল ছিল। সঙ্গে সঙ্গে বসে পড়ল। হাঁটুতে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে লাগল। এতক্ষণ নিজেকে আটকানোর চেষ্টা করেও আর আটকাতে পারেনা।

————————————————– ————————————————–

হাতকড়া পরা ও পুলিশ ঘেরাও হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে সুধীর। তার দিকে পুলিশ অস্ত্র তাক করে ছিল কারণ সে একজন সাধারণ খুনি নয় বরং একজন সিরিয়াল কিলার যে চার-চারজনকে হত্যা করেছে। পুলিশ সুধীরকে তাদের একটি গাড়িতে তুলে দেয়। গুদামের দরজার আড়ালে ইন্সপেক্টর রাজ থামে। রাজ এখন পর্যন্ত অনেক খুনের মামলা পরিচালনা করেছে, কিন্তু এই মামলায় তাকে বিভ্রান্ত বলে মনে হচ্ছে।

খুনিকে ধরার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ এখন শেষ হয়েছে। তাই এখন তার সঙ্গে গাড়িতে বসাটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ না। সে কিছুটা সময় একা কাটাতে চায় এবং সে পিছনে থেকে যায়। আর একবার এই গুদামের পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করতে চায়। সে তার সহকারী পবনকে ইশারায় বলল,

“তোমরা একে নিয়ে এগিয়ে যাও। আমি কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে পৌঁছে যাব।” রাজ বলল।

যে গাড়িতে সুধীর বসেছিল সেই গাড়িটা স্টার্ট দিল। পুলিশের বাকি গাড়িগুলোও তার পেছন পেছন ছুটতে থাকে। ওই গাড়িগুলো চলে গেল। রাজ গম্ভীর ভঙ্গিতে বসে ধুলোর মেঘের দিকে ধীরে ধীরে তাকিয়ে আছে।

সেখান থেকে সমস্ত যানবাহন চলে যাওয়ার সাথে সাথে আশেপাশের পরিবেশ শান্ত হওয়ার সাথে সাথে রাজ ওয়্যার হাউসের একটি রাউন্ড নেয়। হাঁটতে হাঁটতে আকাশের দিকে তাকাল। আকাশে লালিমা ছড়িয়ে পড়েছিল আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্য উঠতে চলেছে। এক রাউন্ড নিয়ে দরজার কাছে এসে প্রচণ্ড গতিতে গুদামের ভেতরে চলে গেল।

গুদামের ভিতরে তখনও অন্ধকার। কম্পিউটারের জ্বলজ্বলে মনিটরের আলোয় গুদামের ভেতরে একটা রাউন্ড নিয়ে তারপর সেই কম্পিউটারের কাছে এসে দাঁড়ালো। রাজ লক্ষ্য করলো কম্পিউটারে একটা সফটওয়্যার এখনো খোলা আছে। তিনি মাউসে ক্লিক করে সফটওয়্যারের বিভিন্ন অপশন দেখতে পান। একটি বোতামে ক্লিক করার সাথে সাথে কম্পিউটারের পাশে রাখা একটি ডিভাইসের আলো জ্বলতে শুরু করে। তিনি সেই টুলটি হাতে নিয়ে মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলেন। এটি একটি ডিসপ্লে সহ সংকেত রিসিভার। সেই ডিসপ্লেতে একটা মেসেজ জ্বলে উঠল। লেখা ছিল ‘সংকেত পরিসরে/নির্দেশ = বাম’। তিনি ডিভাইসটিকে আগের জায়গায় রেখে দেয়। আরেকটি সফটওয়্যারের বোতাম টিপল, যার উপরে ‘রাইট’ লেখা ছিল।

আবার সিগন্যাল রিসিভার ব্লিঙ্ক করে এবং বার্তাটি ছিল ‘ইন সিগন্যাল রেঞ্জ / নির্দেশ = লিখুন’। এরপর সে ‘অ্যাটাচ’ বোতামে ক্লিক করে। আবার সিগন্যাল রিসিভার ব্লিঙ্ক করে তাতে মেসেজ এলো। ‘সংকেত পরিসরে/নির্দেশ = আক্রমণ’। রাজ আবার সেই যন্ত্রটি হাতে নিল এবং এখন সে মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল। তারপর গুদামের বাইরে কিছু একটার আওয়াজ শুনতে পেল। সেই যন্ত্রটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেল।

গুদামঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখে অবস্থা। এখানে কেউ নেই। তাহলে কিসের আওয়াজ। কিছু একটা হবে। ছেড়ে দাও।

ওয়্যার হাউসে ফিরে যাওয়ার জন্য সে যখন আবার ঘুরে গেল, হঠাৎ তার মনোযোগ তার হাতের ব্লিঙ্কিং ডিভাইসের দিকে গেল। হঠাৎ তার মুখে বিস্ময়ের ছাপ ফুটে উঠল। সেই সিগন্যাল রিসিভারে ‘সীমার বাইরে / নির্দেশ = শূন্য’ এর মতো একটি বার্তা এসেছিল। সে অবাক হয়ে যন্ত্রের দিকে তাকাল। তার মুখ খোলা। নানা প্রশ্ন তার মনে ভিড় করে।

হঠাৎ কাছাকাছি কারো উপস্থিতিতে সে প্রায় হতবাক হয়ে গেল। দেখতে পায়, এটি একটি কালো বিড়াল এবং সে তার সামনে দৌড়ে গুদামঘরে প্রবেশ করেছে। একবার সে তার হাতে থাকা যন্ত্রটির দিকে তাকাল এবং তারপরে গুদামঘরের খোলা দরজার দিকে তাকাল যেখান দিয়ে কালো বিড়ালটি প্রবেশ করেছিল। ধীরে ধীরে, সাবধানে সেই বিড়ালটিকে অনুসরণ করে সে এখন ওয়ার হাউসের ভিতরে যেতে লাগল।

যেতে যেতে তার মনে একটা চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগল যে, গুদামের বাইরেই যদি সিগন্যাল যেতে না পারে, তাহলে খুন হওয়া চারজনের বাড়িতে সিগন্যাল পৌঁছল কী করে?

দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায় রাজ ধীরে ধীরে ওয়ার হাউসে প্রবেশ করল। ভেতরে যাওয়ার পর সে এদিক-ওদিক তাকিয়ে ওই বিড়ালটিকে খুঁজতে থাকে। সেখানে ইতিমধ্যেই অন্ধকার এবং বিড়ালটি আবার কালো রঙের। ওটাকে খুঁজে পাওয়া কঠিন। সে গুদামের সর্বত্র তাকে খুঁজে। এখন সকাল হয়ে গেছে। তাই গুদামে একটু আলো। এক জায়গায় দেখে ধুলোয় ঢাকা ফাইলের বান্ডিল। সে ফাইলের কাছে গেল। সেই বান্ডিলটা একটু উঁচুতে রাখা। রাজের কৌতূহল আরও বেড়ে গেল।

কি আছে ঐ ফাইলগুলোতে?

অবশ্যই এই ফাইলগুলিতে কেস সম্পর্কে আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু খুঁজে পাওয়া যাবে।

পায়ের আঙুল উঁচিয়ে ফাইলের বান্ডিলে পৌঁছানোর চেষ্টা করতে লাগল সে। তারপরও সে নাগাল পেল না। তাই লাফিয়ে উঠে সেই বান্ডিলটিতে পৌঁছানোর চেষ্টা করতে লাগল। সেই বান্ডিলটিতে পৌঁছানোর চেষ্টা করতে গিয়ে ধাক্কা খেয়ে উপর থেকে নিচে পড়ে যায়। কাঁচ ভাঙার মতো আওয়াজ হলো। সে নিচে হেলান দিয়ে দেখল কাঁচের টুকরোগুলো চারদিকে ছড়িয়ে আছে এবং নিচে একটা ফটোফ্রেম উল্টে পড়ে আছে। ওটা তুলে সোজা তাকাল.. এটা একটা গ্রুপ ফটো কিন্তু ওখানে আলোর অভাবে ঠিকমতো দেখা যাচ্ছিল না। সেই ছবি তুলে সে কম্পিউটারে গেল। কম্পিউটার মনিটরটি তখনও চালু এবং ফ্ল্যাশ করছিল। তাই সেই আলোতে ছবিটা ঠিকমতো দেখা সম্ভব হয়। মনিটরের আলোয় গ্রুপ ফটো দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় স। খোলা মুখ নিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সেই ছবির দিকে।

সে নিজেকে সামলানোর আগেই তার সামনের কম্পিউটার মনিটরটি বন্ধ হয়ে যেতে শুরু করে। বৈদ্যুতিক সমস্যা হবে। তাই কম্পিউটারের পাওয়ার সুইচ এবং প্লাগ পরীক্ষা করা শুরু করে। পাওয়ার প্লাগের দিকে তাকায় এবং হতবাক হয়ে পিছিয়ে আসে। তার জন্য আরও একটি চমক অপেক্ষা করছিল।

কম্পিউটারের পাওয়ার তারটি পাওয়ার বোর্ডের সাথে সংযুক্ত ছিল না এবং পাশে রাখা। তারপরও কিভাবে কম্পিউটার চালু আছে? নাকি এই পাওয়ার তারটি অন্য কিছুর? সেই পাওয়ার ক্যাবলটি তুলে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে গিয়ে দেখে এটি কম্পিউটারেরই পাওয়ার তার।

এবার তার হাত পা কাঁপতে লাগল। যা দেখছে তা সে তার সারা জীবনে কখনও দেখেনি। হঠাৎ কম্পিউটারের মনিটরটি বন্ধ হতে শুরু করে। মনিটরের দিকে তাকাল সে। তার মুখে তখনও ভয় আর বিস্ময়ের ছাপ।

হঠাৎ গুদামে প্রচণ্ড দমকা হাওয়া বইতে শুরু করল। এত প্রচন্ড দমকা বয়ে যাচ্ছিল আর এখানে রাজ ঘামে নেয়ে একাকার। বাতাস খুব জোরে বইছিল..

এবং এখন হঠাৎ মনিটরে অদ্ভুত ধরণের এবং ভয়ানক ছায়া দেখা দিতে শুরু করেছে।

 

১৮

রাজ বুঝে উঠতে পারল না কি ঘটছে.. যা ঘটছে তা তার বোধগম্য ও নাগালের বাইরে। অবশেষে মনিটরে এক সুন্দরী যুবতীর ছায়া ফুটে উঠল। যদিও সেই ছায়াটি সুন্দর ও লোভনীয় ছিল তবুও রাজের শরীরে ভয়ের কম্পন বয়ে গেল। সেই মোহনীয় ছায়া এখন ভয়ঙ্কর ও ভীতিকর ছায়ায় পরিণত হয়েছে। আবার দ্রুত একটা দমকা হাওয়া ঢুকল। এবার সেই দমকা হাওয়ার শক্তি ও প্রবাহ ছিল খুবই প্রবল। রাজ সেই দমকা হাওয়া সইতে না পেরে মাটি থেকে দুই ফুট ওপরে উঠে পড়ে যায়। যাই হোক, তার হাত পা আগে থেকেই দুর্বল ছিল। সেই আঘাতের ধাক্কা সামলানোর ক্ষমতা তার ছিল না। শুয়ে থাকতে সে বুঝতে পারল যে ধীরে ধীরে সে জ্ঞান হারাচ্ছে। কিন্তু পুরোপুরি জ্ঞান হারানোর আগেই মনিটরের দিকে তাকিয়ে মহিলার চোখে দুটি বড় অশ্রু গড়িয়ে পড়তে দেখল।

গুদামে, অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকা রাজের সামনে মনিটরে প্রতিটা পর্ব ফ্ল্যাশব্যাকের মতো চলতে লাগলো…

রাস্তার পাশে পড়ে থাকা ড্রেনেজ পাইপের মধ্যে লুকিয়ে ছিলে মীনু ও শারদ। হঠাৎ সে তাদের দিকে কারো ছুটে আসার শব্দ শুনতে পেল। তারা আর নড়তেও পারল না। যদি তারা তাদেকে খুঁজে পায়, তবে তাদের দখলে খারাপভাবে আটকে যাবে। তারা বিড়ালের মতো চোখ বন্ধ করে সেই ছোট জায়গায় যতটা সম্ভব সঙ্কুচিত করার চেষ্টা করল। তা ছাড়া তারা কী করতে পারত?

হঠাৎ সে বুঝতে পারে যে তাদেকে অনুসরণ করা লোকদের মধ্যে একজন তাদের পাইপের খুব কাছে ছুটে এসেছে। কাছে আসতেই শারদ আর মীনু বেশ চুপচাপ বসে, প্রায় হতবাক, প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে। সে এখন পাইপের খুব কাছাকাছি ছিল।

সে ছিল সেই চারজনের একজন, চন্দন। চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিল সে।

“শালি কোথায় উধাও হল?” নিজের উপর রাগ হল।

চন্দনের মনোযোগ পাইপের দিকে যায়। শালি নিশ্চয়ই এই পাইপে লুকিয়ে আছে। সে ভাবল.. সে পাইপের কাছে গেল। এখন সে মাথা নিচু করে পাইপের দিকে তাকাতে যাচ্ছিল এ সময়..

“চন্দন। তাড়াতাড়ি এখানে আয়।” ওখান থেকে শিখেন্দর তাকে ডাকল।

চন্দন শরীর বাঁকানো বন্ধ করে পাইপের দিকে তাকালো, যেদিক থেকে আওয়াজ পেল এবং ঘুরে সেদিকে দৌড় দিল। পায়ের শব্দ শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল মীনু আর শারদ।

চন্দন চলে যেতেই পকেট থেকে মোবাইল বের করল শারদ। কেউ যাতে তাকে খুঁজে না পায় সেজন্য সে ফোনটি বন্ধ করে রাখে। সে সুইচটা অন করে একটা নম্বর ডায়াল করল।

“কাকে ডাকছ?” মীনু নিস্তেজ কন্ঠে জিজ্ঞেস করল।

“আমার সহপাঠী সুধীর কে। সে এই গ্রামেরই।”

ঠিক তখনই ফোন বেজে উঠল, “হ্যালো।”

“আরে, শারদ? কোথায় হারিয়ে গেলে।

শারদ তাকে সংক্ষেপে সব খুলে বললো, “আরে আমরা এখানে একটা জায়গায় আটকে আছি।”

“ফাঁদে? কোথায়?” জিজ্ঞেস করল সুধীর।

“আরে কিছু দুষ্কৃতী আমাদের অনুসরণ করছে। এখন আমরা কোথায় আছি তা বলা একটু কঠিন।” শারদ বলছিল। মীনু তখন টাওয়ারের দিকে ইশারা করল, তার দিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল।

“…হ্যাঁ এখান থেকে একটা টাওয়ার দেখা যাচ্ছে যার উপর ঘড়ি স্থির। আমরা এর আশেপাশে কোথাও লুকিয়ে আছি।” শারদ তাকে জানাল।

“ঠিক আছে। আচ্ছা। চিন্তা করো না, আগে তোমার মন শান্ত করো এবং নিজের যত্ন নাও। আর এত বড় শহরে ওই দুষ্কৃতীরা তোমার ক্ষতি করতে পারে, এই ভয়টা মন থেকে একেবারে দূর করে দাও…হ্যাঁ বের করে দাও…?” ওখান থেকে বলল সুধীর।

“হ্যাঁ ঠিক আছে।” শারদ বলল।

“হুম। ভালো। এখন একটি ট্যাক্সি নাও এবং তাকে তোমাদেরকে হিল্টন হোটেলে নিয়ে যেতে বল। আমি ওই এলাকার কাছাকাছিই আছি।”

কিছুক্ষন সেখানে থাকার পর ঈশ্বরের কৃপায় একটি ট্যাক্সি তার দিকে আসতে দেখে ।

“ট্যাক্সি চলে এসেছে। আচ্ছা আমি তোমাকে পরে ফোন করব।” তাড়াতাড়ি ফোন কেটে দিল শারদ।

দুজনেই খুব দ্রুত পাইপ থেকে বেরিয়ে এল এবং শারদ ট্যাক্সিকে থামতে ইশারা করল। ট্যাক্সি থামতেই দুজনেই ট্যাক্সিতে ঢুকে।

“হোটেল হিলটন।” বলল শারদ আর ট্যাক্সি আবার চলতে শুরু করল। দুজনেই প্রাণ ফিরে পায়। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।

শিখেন্দর এবং তার তিন বন্ধু তখনও মীনু ও শারদকে পাগলের মতো খুঁজছিল। সর্বোপরি, খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে, শিখেন্দর এবং চন্দন যেখান থেকে তাদের খোঁজা শুরু করেছিল সেখানে আবার ফিরে এল।

“তোদের কাছে কোন খবর আছে কি ?” চন্দন জিজ্ঞেস করল।

সুনীল শুধু মাথা নাড়ল।

“খানকির বাচ্চারা গেল কোথায়?” শিখেন্দর রেগে বলল।

সে দেখতে পেল অশোক দূর থেকে তার দিকে এগিয়ে আসছে। সে তার দিকে খুব প্রত্যাশা নিয়ে তাকাল। কিন্তু সে দূর থেকে তার বুড়ো আঙুল নামিয়ে ইঙ্গিত দিল যে খুজে পায় নি।

“তুই কোন বালের খবর এসেছিস।

ঠিক তখনই শিকেন্দরের ফোন বেজে উঠল।

শিখেন্দর ফোন ধরল, “হাই।”

“আরে। আমি সুধীর বলছি।” মীনু আর শরদের ক্লাসমেট সুধীর ওখান থেকে কথা বলছিল।

“হ্যাঁ সুধীর বল।” শিখেন্দর বলল।

“এটা খুশির ব্যাপার.. আমি তোমার জন্য একটা খাবারের ব্যবস্থা করেছি।” ওখান থেকে বলল সুধীর।

“দেখ সুধীর। আমাদের এখন মেজাজ ভালো নেই। এবং তোর ট্রিট এটেন্ড করা সম্ভব না।” শিখেন্দর বলল।

“আরে তাহলে এই ট্রিটটি অবশ্যই তোর মেজাজ ঠিক করে দেবে। আগে শোন। আমার শহরে একটি নতুন পাখি এসেছে। আপাতত আমি এটিকে তোর জন্য বিশেষভাবে নিরাপদ জায়গায় পাঠিয়েছি।” সেখান থেকে সুধীরের কন্ঠস্বর ভেসে এলো।

“পাখি? এই শহরে নতুন। এক মিনিট.. এক মিনিট। সে কি তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে আছে?” শিখেন্দর জিজ্ঞেস করল।

“হ্যাঁ।” ওখান থেকে বলল সুধীর।

“তার গালে হাসির পরে ডিম্পল দেখা দিতে শুরু করে?” শিখেন্দর জিজ্ঞেস করল।

“হ্যাঁ।” বলল সুধীর।

“ওর ডান হাতে একটা সিংহের ট্যাটু আছে। রাইট?” শিখেন্দরের মুখ আনন্দে ফুলে উঠল।

“হ্যাঁ। কিন্তু তুমি এসব জানলে কি করে?” সেখান থেকে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল সুধীর।

“ওহ সে সেই একই মেয়ে। যাকে অশোক, চন্দন, সুনীল আর আমি সকাল থেকে ফলো করছিলাম।. আর কিছুক্ষণ আগে আমাদের বেকুব বানিয়ে এখান থেকে উধাও হয়ে গেছে। কিন্তু মনে হয় আমাদের ভাগ্যেই শালী লেখা আছে।”

“সত্যি?” সেখান থেকে সুধীরও বিস্ময়ে কথা বলে।

“ইয়ার সুধীর। আজ তুই আমার মনকে খুশি করেছিস। এটাকেই বলে সত্যিকারের বন্ধু।” শিখেন্দরও খুশিতে উত্তেজিত হয়ে কথা বলছিল।

“ওহ এই মুহূর্তে আমরা জানি না আমরা তাকে কোথায় খুঁজে পাব। কোথায় সে? সত্যি কথা বল। বিনিময়ে তুই যা চাইবি তাই দেব।” শিখেন্দর খুশি হয়ে কথা দিল।

“দেখ। পরে আবার কথা ফিরাইস না।” বলল সুধীর।

“আরে না.. এটা ভদ্রলোকের জবান ইয়ার।” রাজার মতো খুশি হয়ে বলল শিখেন্দর।

“বিশ হাজার টাকা। প্রত্যেকের কাছ থেকে। রাজি?” সুযোগটাকে কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নিল সুধীর।

“সহমত।” উদ্বেগহীন সুরে বলল শিখেন্দর।

 

শিখেন্দর, সুনীল, চন্দন আর অশোক একটা পুরনো বাড়িতে একটা টেবিলের চারপাশে বসে ছিল। তারা তাদের হাতে অর্ধ-পানীয় হুইস্কির জ্যাম ধরে আছে। চারজনই তাদের নিজেদের চিন্তায় হারিয়ে হুইস্কি পান করছিল। একটি উত্তেজনাপূর্ণ নীরবতা তাদের উপর ঝুলছে।

“তাকে মারলে কেন?” অশোক নীরবতা ভেঙে শিখেন্দরকে প্রশ্ন করল।

আগে তিনজনের মধ্যে কেউই শিখেন্দরকে এমন প্রশ্ন করার সাহস পায়নি। কিন্তু পরিস্থিতি চলে এসেছে।

“হুত, বোকার মতো বকবক করবি না.. আমি তাকে মারিনি। সে দুর্ঘটনায় মারা গেছে।” শিখেন্দর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল।

“দুর্ঘটনায়?”

যদিও শিখেন্দর প্রকাশ করছিল যে সে এই বিষয়ে উদাসীন, তবুও সে ভিতরে ভিতরে অস্থির।

নিজের অস্থিরতা লুকানোর জন্য হুইস্কিতে একটা বড় চুমুক নিল, “দেখ। সে খুব চিৎকার করছিল। আমি ওকে চেপে ওর মুখ বন্ধ করে দিয়েছিলাম। আর ওর মধ্যে নাক পুঁতে দিয়ে বুঝতে পারিনি।”

“তাহলে এখন কি করব?” চন্দন জিজ্ঞেস করল।

 

১৯

চারজনের মধ্যে চন্দন আর সুনীলকে সবচেয়ে বেশি ভয় পেয়েছে।

“আর পুলিশ যদি আমাদের ধরে ফেলে তাহলে?” সুনীল উদ্বেগ প্রকাশ করে।

“দেখ, কিছু হয়নি, এমন আচরণ কর। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে মনে রাখবি যে আমরা গত রাত থেকে এখানে তাস খেলছি। তারপরও যদি কিছু ভুল হয়, আমরা এর থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজে বের করব। এবং না। মনে কর এটাই আমার প্রথম.. আমি কাউকে মেরে ফেলেছি।” মিথ্যে বক্তব্য দেওয়ার চেষ্টা করে বলে শিখেন্দর।

“কিন্তু তুই ওকে মেরে ফেলিসনি, ওকে খুন করেছিস।” বলল অশোক।

“তো কি পার্থক্য। দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া আর মেরে ফেলা। খুন করা মানে মেরে ফেলা।” শিখেন্দর বলল।

ততক্ষণে দরজায় কারও আওয়াজ শোনা গেল। আর কেউ দরজায় হালকা টোকা দিল। রুমের সবাই কথা বলা ও মদ্যপান বন্ধ করে দিয়ে হতচকিৎ হয়ে যায়। তারা প্রত্যেকের দিকে তাকাচ্ছে।

কে হতে পারে?

পুলিশ না তো?

রুমে ছিল সম্পূর্ণ নীরবতা।

শিখেন্দর ইশারা করে চন্দন কে দেখার জন্য কে এসেছে।

ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে চন্দন দরজার কাছে গেল, খেয়াল করে যেন কোন শব্দ না হয়। সে বাইরে কে থাকবে তার একটা ধারনা নিয়ে আস্তে আস্তে দরজাটা খুলে দিয়ে বাইরে উঁকি দিতে লাগলো।

অশোক আরেকটা হুইস্কির জ্যাম ভরে বলল, “আরে…. চলো.. সুধীর আমাদের দোষর।”

সুধীর অশোকের দেওয়া হুইস্কি ড্রিংকটি নিয়ে তাদের সাথে বসল।

“চিয়ার্স।” সুধীরের জ্যাম দিয়ে নিজের জ্যাম মারতে মারতে বলল অশোক।

“চিয়ার্স।” সুধীর সেই জ্যামটা মুখে রাখল এবং সেও তাদের আসরে যোগ দিল।

শিখেন্দর, অশোক, সুনীল, চন্দন এবং সুধীর টেবিলের চারপাশে হুইস্কির জ্যাম খালি করে বসে ছিল। শিখেন্দর এবং তার তিন বন্ধু মদ্যপান করার পর মাথা একটু টাল হয়ে গেছে। সুধীর তার সীমার মধ্যে থেকে মদ্যপান করছিল।

“তো সুধীর। এত রাতে কোথা থেকে আসলি?” সুধীরের পিঠে হালকা আঘাত করে চন্দন জিজ্ঞেস করল।

“সত্যি কথা বলতে কি, আমি তোমাদের সাথে করা সেই ট্রিট সম্পর্কে কথা বলতে এসেছি।” সুধীর সুযোগের সদ্ব্যবহার করে আসল কথায় আসে।

“কোনটা?” সুনীল জিজ্ঞেস করল।

“আবে শালা, সেই মেয়েটার কথা বলছি….” সুধীর স্পষ্ট করার আগেই অশোক বাধা দিল।

“যা বে… তুইও কি খাবারের স্বাদ নিতে এসেছিস নাকি?”

সবাই সম্পূর্ণ স্তব্ধ, শান্ত এবং গম্ভীর হয়ে উঠেছে।

“দেখ তোর ট্রিট শুরুতে ভালই ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত….”

“আসলে মাঝে মাঝে স্যুপের স্বাদ শুরুতে ভালো লাগে, কিন্তু শেষে বসে থাকার কারণে এর মজা নষ্ট হয়ে যায়…..” অশোকের বাক্যটি শেষ হওয়ার আগেই বললেন শিখেন্দর।

“তোরা কি বলছিস আমি বুঝতে পারছি না।” সুধীর কিছু না বুঝতে পেরে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল।

শিখেন্দরের দিকে তাকিয়ে চন্দন জিজ্ঞেস করল, “একে কি বলা উচিত?”

“আরে কেন না। ওরও জানার অধিকার আছে। সর্বোপরি এই কাজে ওর সমান অংশীদার ছিল।” শিখেন্দর বলে

“কাজ? কোন কাজ?” উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল সুধীর।

“খুন!” অশোক ঠান্ডা সুরে বলল।

“আরে এর মধ্যে আবার খুন কোথা থেকে আসছে? সেটা একটা দুর্ঘটনা।” সুনীল বাধা দিল।

ভয়ে সুধীরের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

“তোরা মেয়েটাকে খুন করিসনি তো?” সুধীর একরকম সাহস জোগাড় করে বলল।

“তোরা না। আমরা। আমরা সবারই জড়িত আছি।” শিখেন্দর ওর বাক্য সংশোধন করল।

“এক মিনিট। এক মিনিট। তোরা যদি ওই মেয়েটিকে মেরে ফেলে থাকিস তো তার সাথে আমার সম্পর্ক কি?” সুধীর আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলল।

“দেখ। পুলিশ যদি আমাদের ধরে ফেলে। তাহলে তারা আমাদের জিজ্ঞাসা করবে কে আমাদের মেয়েটির হদিস দিয়েছে?” অশোক বলল (ওদের মধ্যে সেই ছিল সবচেয়ে বুদ্ধিমান ছেলে)।

“তাই যদিও আমরা না বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তবুও আমাদের বলতে হবে।” সুনীল অসম্পূর্ণ বাক্যটি সম্পূর্ণ করল।

“….যে আমাদের সবচেয়ে ভালো বন্ধু সুধীর আমাদের সাহায্য করেছে।” সুনীল মাতাল হয়ে বিড়বিড় করল।

“দেখ। তোরা বিনা কারণে আমাকে এর মধ্যে জড়াচ্ছিস।” সুধীর ভয়ে ঘাবড়ে গিয়ে এবার আত্মপক্ষ সমর্থন করছিল।

“কিন্তু বন্ধুরা। খুব অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটতে চলেছে।” শিখেন্দর মৃদু হেসে বলল।

“কোনটা?” অশোক জিজ্ঞেস করল।

“পুলিশ আমাদের ধরেছে এবং পরে আমাদের ফাঁসি দেওয়া হবে….” শিখেন্দর মাঝখানে থামল এবং তার বন্ধুদের দিকে তাকাল। তারা খুব সিরিয়াস হয়ে গিয়েছিল।

“আবে… শালা… মানে যদি আমাদের ফাঁসি দেওয়া হয়।” চন্দনের পিঠে হালকা চাপ দিয়ে শিখেন্দর বলল।

সুনীল অদ্ভুতভাবে নাচা শুরু করে, মদের গ্লাস হাতে নিয়ে বলে, “হা..হা..হা.হা। যদি আমাদের ফাঁসি হয়।”

সুধীর ছাড়া সবাই তাকে নিয়ে হাসতে লাগল। আবার ঘরের পরিবেশ আগের মতো হয়ে গেল।

“হ্যাঁ, যদি আমাদের ফাঁসি হয়। তাহলে তার জন্য আমাদের খারাপ লাগবে না। কারণ আমরা মিষ্টি খেয়েছি। কিন্তু সেই বেচারা সুধীর একটুও মিষ্টির স্বাদ পায়নি। তাকে বিনা কারনে ফাঁসি দেয়া হবে। শিখেন্দর বলল।

সুধীর ছাড়া ঘরের সবাই জোরে জোরে হাসতে লাগল।

“সত্যি বলতে, আমি তোদের প্রত্যেকের কাছ থেকে বিশ হাজার টাকা সংগ্রহ করতে এসেছি।” বলল সুধীর।

“বিশ হাজার টাকা? এখন সব ভুলে যাও বন্ধু।” বলল অশোক।

সুধীর তার দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকাল।

“দেখ, সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে, আমরা তোকে কখনই না বলতাম না। নিজেরাই খুশিতে তোকে টাকা দিতাম। কিন্তু এখন পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। মেয়েটি মারা গেছে।” অশোক ওকে বুঝতে পেরে নিচু স্বরে বলল।

“….মানে দুর্ঘটনাক্রমে।” চন্দন মাঝখানে যোগ করলো..

“তাই এখন সব ঠিক করতে টাকা লাগবে।” বলল অশোক।

“সত্যি কথা বলতে। এই সব মিটিয়ে ফেলার জন্য আমরাই তোর কাছে টাকা চাইছিলাম…” সুনীল বলল।

তারপর সুধীর ছাড়া সবাই জোরে জোরে হাসতে লাগলো। সে ইতিমধ্যেই যা বুঝার বুঝে নিয়েছে। নিজেকে এখন বাচাতে হবে ওদের কাছ থেকে। এখন তারা তাকে নিয়ে মজা করছে।

সুধীরের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। সে রেগে উঠে দাঁড়ালো আর ওখান থেকে জোর পা চালিয়ে দরজা দিয়ে বের হওয়ার পর সে রেগে দরজাটা ধরাম করে বন্ধ করল।

তারপরে সুধীর তাদের চারজনকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিল যেমনটা রাজ ডিসকভার চ্যানেলে দেখেছিল। সেই একই পরিকল্পনা তৈরি করেছিল সুধীর এবং সুধীর যখন এই সমস্ত পরিকল্পনা করছিল তখন তার মন গতকালের ঘটনা নিয়ে ব্যস্ত ছিল। সুধীর মাথা ঠান্ডা করে সব কিছু আবার এক এক করে ভাবতে লাগল।

এখনই যদি সে কিছু না করে এবং এই ঘটনা এভাবে চলতে থাকে, তাহলে এক সময় শিখেন্দর, অশোক, সুনীল এবং চন্দন ওকেও নিজেদের মধ্যে টেনে নিয়ে যাবে। ওকেও ফাসিয়ে দেবে। তাহলে সেও এই মামলায় ধরা পড়বে।

না এটা মোটেও হতে দেয়া যাবে না। আমাকে কিছু উপায় খুঁজে বের করতে হবে।

ভাবতে ভাবতে সুধীর তার চারপাশে খেলারত বিড়ালের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ তার মাথায় একটা চিন্তা ভেসে উঠল এবং তার মুখে একটা রহস্যময় হাসি ফুটে উঠল।

এই চারজনকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দিলে কেমন হবে? বাঁশ থাকবে না বাঁশিও বাজবে না।

সুধীর এই বিষয়টা পুরোপুরি পার করার মনস্থির করে। সর্বোপরি, তাকে নিজের জীবন বাঁচাতে হতে। সে মনে মনে ঠিক করে ফেলে কি করবে। কিন্তু তার আগে একবার মীনুর ভাইয়ের সাথে দেখা করা দরকার। তাই সে অঙ্কিতের বাড়িতে যেতে লাগলো।

২০

সুধীর এসে অঙ্কিতের দরজার সামনে দাঁড়াল। সে বেল টিপতে চলেছে, এমন সময় কেউ একজন জোরে চিৎকার করে উঠল এবং খুব অদ্ভুত ভাবে। এক মুহুর্তের জন্য সে হতবাক হয়ে গেল। কি হল? তার বেল চাপার হাতটি ভয় পেয়ে পিছনে টেনে নিয়ে গেল।

ব্যাপারটা একটু সিরিয়াস মনে হচ্ছে। বলেই সে ডোরবেল না টিপে অঙ্কিতের ঘরের জানালায় গিয়ে ভিতরে উঁকি দিয়ে দেখল।.

….ভিতরে অঙ্কিতের হাতে একটা পুতুল ধরা ছিল। (এর পর অঙ্কিত কী করে তা আপনারা সবাই জানেন। যারা জানেন না। গল্পটি আরেকবার পড়ুন। সব জানা যাবে।)

সুধীর জানালা দিয়ে এতক্ষণ এসব দেখছিল। তা দেখে হঠাৎ তার মাথায় একটা প্ল্যান এলো। ওর মুখে এবার একটা বুনো হাসি ফুটে উঠল। জানালা ছেড়ে দরজার কাছে চলে গেল। কিছু একটা ভেবে সে অঙ্কিতের ডোরবেল না বাজিয়ে সেখান থেকে ফিরে গেল…..

রাজ তখনও গুদামঘরে মাটিতে শুয়ে ছিল। কিন্তু এখন সে সেই ট্রান্সস্টেট থেকে বেরিয়ে এসেছে। তাড়াহুড়ো করে কম্পিউটারের মনিটরের দিকে তাকাল।. এখন কম্পিউটার বন্ধ। সে গুদামঘরের চারপাশে ঘুরে তাকাল। এখন বাইরে সকাল হয়ে গেছে এবং গুদামের ভেতরে ভালো আলো আসছে। কিছুক্ষণ আগের প্রবল বাতাসের দমকাও থেমে গেছে। সে এখন উঠে দাঁড়ালো এবং হাটা শুরু করলো ভাবতে ভাবতে। এভাবেই তার ভাবনা চলে গেল ছবির ফ্রেমের দিকে যেটা পড়ে আছে। সে ফ্রেমটা তুলে সোজা সেটার দিকে তাকাল। এটা একটা গ্রুপ ছবি। সুধীর এবং সেই মীনুর চার খুনিদের।

সে এখন অনেক পরিষ্কার হয়ে গেছে। যখন সে শুয়ে ছিল এবং সে যে সব দৃশ্য দেখেছিল, সম্ভবত মীনুর অদৃশ্য এবং অতৃপ্ত আত্মা তাকে বলতে হয়েছিল। কিন্তু ওর এটা তাকে বলার দরকার হল কেন? এখন পর্যন্ত মীনু যা চেয়েছিল তা তাকে না জানিয়েই পেয়েছে এবং আরও অর্জন করতে পারত।

তাহলে কেন সে তাকে এই কথা বলল?

নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে? এর মধ্যে তার একটি উদ্দেশ্য থাকতে হবে।

 

সুধীরের মামলার বিচার অনেক দিন ধরেই চলছিল আদালতে, সে জন্যই কি মীনু তাকেই বেছে নিয়েছিল সব বলার জন্য? আর মীনুকে এসব বলার উদ্দেশ্য কি ছিল?

আদালতে তার সব বলা উচিত সেটাই কি মীনু আশা করেছে?

কিন্তু সে যদি আদালতে সব বলে দেয় তাহলে তাকে কে বিশ্বাস করবে?

উল্টো, একজন দায়িত্বশীল পরিদর্শকের মুখ থেকে এমন কুসংস্কারপূর্ণ কথা শোনার পর, লোকেরা তাকে কী বলবে কে জানে।

সে ভাবছিল কিন্তু আজ তাকে ভাবনার জালে বেশিক্ষন আটকা পড়তে হয়নি। আজ তাকে আদালতের কার্যক্রম মনোযোগ দিয়ে শুনতে হয়েছে। কারণ আজকে মামলার ফল বের হওয়ার কথা ছিল।

এতদিন যখন মামলা চলেছে। রাজও কথা বলেছিল। সে সব বলেছিল যা প্রমাণ করা যায়।

অবশেষে সেই সময় এসে গেল। সেই মুহূর্তটি যার জন্য সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। মামলার ফলাফলের জন্য। আদালত কক্ষে উপস্থিত বাকি সবাই তাদের দম আটকে রেখে জাজের চূড়ান্ত রায় শোনার জন্য মরিয়া।

জাজের রায় শোনা গেল-

“সমস্ত প্রমাণ, সব প্রশ্ন উত্তর, এবং মি. সুধীরের দেওয়া বিবৃতিটি নোট করে আদালত এই সিদ্ধান্তে এসেছে যে মি. চন্দন, মি. সুনীল, মি. অশোক এবং মি. এই চারজনকে হত্যার ঘটনায়ও মি. সুধীরকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। সে খুনগুলো সম্পূর্ণ পরিকল্পনা ও সতর্কতার সাথে করেছে….”

“…..তাই আদালত অপরাধী সুধীরকে মৃত্যুদণ্ড দেয়।”

বিচারক শেষ সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। নিহত চারজনের স্বজনরা করতালি দিয়ে এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন, আবার অনেকেই এই সিদ্ধান্ত পছন্দ করেননি। মীনুর ভাই অঙ্কিত বিরক্তি প্রকাশ করে কোর্টরুম থেকে উঠে চলে গেলেন। কিন্তু রাজের মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই। না সুখ না দুঃখ। কিন্তু সিদ্ধান্ত শোনার পর যে প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল যা রাজকে বহুদিন ধরে অস্থির করে রেখেছিল। সুধীরকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। সেই তারিখটাও এখন জানে।

 

এখন অল্প সময়ের মধ্যেই সুধীরকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার কথা। ফাঁসির কক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন ইন্সপেক্টর রাজ, শাস্তি প্রদানকারী অফিসার, একজন ডাক্তার এবং কয়েকজন অফিসার। এ অবস্থায় হাতকড়া পরা দুই পুলিশ কর্মকর্তা সুধীরকে সেখানে নিয়ে আসেন। মৃত্যুদণ্ডের দায়িত্বে থাকা অফিসার তার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে পুলিশ অফিসারকে ইশারা করলেন। পুলিশ অফিসাররা সুধীরকে ফাঁসির মঞ্চের দিকে নিয়ে গেল।

তারপর জল্লাদ কালো কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে তার গলায় ফাঁসির মঞ্চ আটকে প্যানেল টানার জন্য প্রস্তুত হলো। তার কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেছে।। হঠাৎ সেই অফিসার জল্লাদকে ইশারা করলেন। জল্লাদ এক মুহূর্তও দেরি না করে প্যানেলটি টেনে নিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর সেই ফাঁসির দড়িতে ঝুলছে সুধীরের দেহ।

“ডাক্তার।” সেই অফিসার ডাক্তারকে ডাকলেন।

ডাক্তার তড়িঘড়ি করে লাশের দিকে এগিয়ে গেলেন। আর বললেন, “স্যার মারা গেছেন।”

অফিসারটি তৎক্ষণাৎ সে জায়গা ছেড়ে চলে গেল। সেই জল্লাদ তার পাশের একটি ঘরে চলে গেল। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজন স্টাফ সদস্য সেই চেম্বারে প্রবেশ করলেন, সম্ভবত চেম্বার পরিষ্কার করার জন্য। সবকিছু কেমন যেন একটা যন্ত্রের মতো চলছিল। যদিও তাদের সবার জন্য একটা রুটিন কাজ, কিন্তু রাজের জন্য না।

এবার ডাক্তারও সেখান থেকে চলে গেলেন।

সেখানে শুধু রাজ একাই রয়ে গেল। সে তখনও চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল, হয়তো তার মনে অন্যরকম কিছু চলছে।

হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন হুড়মুড় করে এসে পড়ল।

“ঠিক আছেন স্যার।” পিছন থেকে একটা আওয়াজ এল।

রাজ পিছন ফিরে তাকাল এবং তার মুখ বিস্ময়ে হা হয়ে গেল। জল্লাদ তার সামনে দাঁড়িয়ে….! সে সবেমাত্র সামনের পাশের ঘরে গেছে। তাহলে এই মুহূর্তে পেছন থেকে কোথা থেকে এসেছে?

“স্যার, আমি চিন্তিত ছিলাম যে আমার অনুপস্থিতিতে কে প্যানেলটি পরিচালনা করবে।” জল্লাদ বলল।

“কে প্যানেলটি পরিচালনা করেছিল?” জল্লাদ রাজকে জিজ্ঞেস করলো।

রাজ একের পর এক চমকে উঠছিল।

রাজ পাশের ঘরের দিকে তাকাল।

“কে অপারেশন করেছে মানে? তুমিই তো অপারেশন করেছ।” রাজ অবিশ্বাসের সাথে বলল।

“কিসের কথা বলছেন স্যার? আমি এইমাত্র এখানে আসছি। আমি একটা কাজে আটকে গিয়েছিলাম।” সেই জল্লাদ বলল।

রাজ আবার অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল এবং তারপর পাশের ঘরটির দিকে তাকাল যেখানে সে কিছুক্ষণ আগে জল্লাদকে যেগে দেখেছে।

“এসো আমার সাথে এসো।” রাজ ওকে পাশের ঘরে নিয়ে গেল।

রাজ ঐ ঘরের দরজা ঠেলে দিল। দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। সে দরজায় টোকা দিল। ভিতর থেকে কোন প্রতিক্রিয়া নেই। রাজ এবার জোরে জোরে দরজা ধাক্কা দিতে লাগল। তখনও ভিতর থেকে কোন প্রতিক্রিয়া হল না। রাজ সাধ্যমত চেষ্টা করল দরজা ঠেলে খোলার।

জোরে জোরে ধাক্কা দিয়ে, অবশেষে রাজ এবং জল্লাদ সেই দরজা ভেঙে দিল।

দরজা ভেঙ্গে যেতেই রাজ এবং জল্লাদ দ্রুত ঘরে প্রবেশ করল। তারা চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিল। রুমে কেউ নেই। তারা একে অপরের দিকে তাকালো। সেই জল্লাদের মুখে বিভ্রান্তি, তারপর রাজের মুখে কিন্তু এখন এক অগম্য ভয়ের অভিব্যক্তি দৃশ্যমান।

হঠাৎ ওপর থেকে কিছু একটা পড়ে গেল। দুজনেই হতভম্ব হয়ে তাকালো। ওটা একটা কালো বিড়াল, যেটা ওপর থেকে লাফ দিয়ে নিচে এসেছে। সেই বিড়ালটা এবার রাজের সামনে দাঁড়িয়ে রাজের দিকে তাকালো। ওরা অবাক হয়ে মুখ খুললো। বিড়ালের দিকে তাকাতে লাগলো। ধীরে ধীরে সেই কালো বিড়ালের রূপান্তর ঘটতে শুরু করলো মীনুর পচা লাশে। তারা দেখছিল, ধীরে ধীরে সেই পচা শরীরটা রূপান্তরিত হয়ে গেল সুন্দরী, অল্পবয়সী মেয়েতে.. হ্যাঁ, এটাই ছিল মীনু। অশ্রু তার গালে বয়ে যেতে লাগল। এবং ধীরে ধীরে সে অদৃশ্য হয়ে সেখান থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

শেষ

Leave a Reply