উপন্যাস পার্ট

কাঁচের প্রাসাদ – (২৫-৩৪)

সূচীপত্র || কাঁচের প্রাসাদ – (৩৫-৪১)

২৫

তার জ্বলন্ত চোখ এবং রাগী চেহারা দেখে রবি বুঝতে পারে যে নিক্কি তাকে কাঞ্চনের সাথে দেখেছে।

এভাবে চুরি ধরা পড়ায় তার পোট্টি নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু সে তার নার্ভাসনেস নিক্কিকে দেখতে দেয়নি। নিক্কির দিকে তাকিয়ে বললো- “নিক্কি, তুমি এখানে, এই সময়ে?”

“আমাকে সাথে কথা বলবে না তুমি।” নিক্কি রেগে চিৎকার করে উঠল। “আমাকে যখন তোমার পছন্দই না তাহলে এই মিথ্যা সম্মান কেন?”

রবি অবাক হয়ে তার রাগ দেখে। নিক্কি যে তার উপর এভাবে রেগে যেতে পারে তা সে ভাবেনি। কিন্তু সে রাগের পরোয়া না করেই বললো- “আমি কিছুই বুঝলাম না।”

“বুঝো না?” নিক্কি ব্যঙ্গ করে হাসল। তারপর সেই একই বাঁকা গলায় বললো- “নিরবে লুকিয়ে যদি পাপ করতেই হতো, তাহলে আমাকে প্রত্যাখ্যান করে অপমান করলে কেন?”

“কি বাজে কথা বলছ তুমি?” রবির দৃঢ়তার সাথে উত্তর দিল। সে তার জায়গা থেকে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠল।

নিক্কির কথার মর্ম বুঝতে পারার সাথে সাথে সে খুব রেগে গেল। নিক্কি তাকে চরিত্রহীন বলেছে বলে সে রাগ করেনি, সে রাগ করেছিল যে নিক্কি নিরপরাধ, নির্দোষ কাঞ্চনের উপর কাদা ছোড়ার চেষ্টা করেছিল। যে তার ঘনিষ্ট বান্ধবীও।

“এটা যদি বাজে কথা হয়, তাহলে তোমরা দুজন এখানে একা কি করছিলে?” নিক্কি কাঁটা দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল।

“আমি তোমার কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নই।” রবি ওকে দুই টুকরো উত্তর দিয়ে মেজাজ খারাপ করে বাইকের দিকে চলে গেল।

“কেন বলবে না, নাকি তোমার কাছে ব্যাখ্যা করার ভাষা নেই।” ওকে ঘুরে রেগে বলল নিক্কি।

তার কথায় বিরক্ত হয়ে রবি মুখ ফিরিয়ে নিল। কিন্তু রাগের চেয়ে বেশি কিছু বলতে পারল না। শুধু দাঁত কিড়মিড় করছে। বিদ্বেষে ভুগছে এমন একজন নারীকে কেউ কীভাবে বোঝাবে? এমন একটা পাথর তার বুদ্ধির উপর পড়ে আছে যে লাখ চেষ্টা করলেও সে পাথর সরবে না। সে নীরব থাকাই শ্রেয় মনে করে।

রবি তার বাইকের দিকে ফিরে গেল, নিক্কির দিকে একটা ব্যঙ্গাত্মক হাসি নিক্ষেপ করে।

রবির এই অবহেলার আচরণ সইতে পারল না নিক্কি। সে রেগে জিপ থেকে নেমে তার দিকে এগিয়ে গেল। “আমি জিজ্ঞেস করছি…… কাঞ্চনের মধ্যে এমন কি আছে যা আমার মধ্যে নেই? আমি কি সুন্দরী নই? আমার কি যৌবন নেই? দেখ, আমাকে আর বল। আমার মধ্যে কিসের অভাব?” এই বলে নিক্কি তার সামনে বুক উচু করে তুলল।

এটার করার ফলে তার স্তন সাদা টাইট ফিট টি-শার্টে পূর্ণ আকার প্রদর্শন করে। না চাইলেও রবির চোখ গেল তার পাহাড়ের মতো উঠে আসা পাহাড়ের দিকে। চোখের কাছে তার প্রসারিত স্তন দেখে রবির সারা শরীর কেঁপে ওঠে। কিন্তু পরের মুহুর্তে সে তার বুক থেকে চোখ সরিয়ে নিল।

“তোমার মধ্যে সবচেয়ে বড় দোষ হল তুমি লালসার মেয়ে।” নিক্কির চোখে ভেসে আসা আবেগের ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে রবি বললো- “তুমি কাঞ্চনের সাথে নিজেকে কিভাবে তুলনা কর?”

“আমি লালসায় ভুগছি তাই না? তো তুমি কি? তুমিও কিছুক্ষণ আগে কারো উষ্ণ কোলে শুয়ে ছিলে।” নিক্কি জ্বলন্ত গলায় বললো- “তুমি আমার সামনে ঋষি হয়ে পিছনে নষ্টামী করছো। আমি জানি না?”

“তোমার বাজে কথা বন্ধ করো।” রবি রেগে চিৎকার করে। “আমারকে বলছ ঠিক আছে কিন্তু কাঞ্চনের উপর অপবাদ দিবে না।”

“সে নিষ্পাপ, নিশ্চয়ই তোমার পাল্লায় পড়ে এসেছে। কিন্তু এতটুকু মনে রেখো… তুমি আমাকে প্রত্যাখ্যান করে অন্য কাউকে নিলে, তোমাকে শান্তিতে থাকতে দেব না।” নিক্কি দাঁত চিবিয়ে বলল।

রবির প্রতি তার আকুলতা আর শুধু শারীরিক আনন্দের বিষয় ছিল না। এখন সে রবিকে স্বামী হিসেবে পেতে চেয়েছে। কিন্তু আজ নিজের বদলে কাঞ্চনের দিকে রবির ঝোঁক দেখে সে রাগে পাগল হয়ে গেল।

সে নিজেকে সব দিক দিয়ে কাঞ্চনের চেয়ে ভালো মনে করত। কাঞ্চন তার মতো শিক্ষিতও ছিল না, তার মতো ধনীও ছিল না, তার বংশের চেয়ে কাঞ্চনের বংশও বড় ছিল না। সে নিক্কির চেয়ে ভাল পোশাক পরত না, সে নিক্কির চেয়ে ভালভাবে কথা বলতে জানত না। রবি তার অতিথি। তার বাড়িতে এসেছে তাদের কাজের জন্য। তারপরও সে তার বদলে কাঞ্চনকে ভালবাসে। নিক্কির অহংকারী মেয়েলি স্বভাব এতে দুঃখিত ও ক্রোধে ভরে উঠে।

কাঞ্চনকে সে তার শত্রু মনে করছিল না, কিন্তু যে কাঞ্চন তার প্রতি সর্বদাই মুগ্ধ ছিল, সেই কাঞ্চন যাকে সে কুঁড়েঘর থেকে তুলে এনে প্রাসাদে বসিয়েছিল, সেই কিনা… এই সত্যটা সে সহ্য করতে পারেনি। যার সাথে সে তার থালা ভাগ করে নিয়েছে, যার জন্য সে সব ভেদাভেদ মুছে দিয়েছে, আজ সেই কাঞ্চন তার উপর ভারী হয়ে উঠছে। এতে তার অহংকারী মন আঘাত পায়।

রবি তার সাথে আরও কথা বলা ঠিক মনে করল না। সে ঘুরে তার বাইকে উঠল।

“তুমি কোথায় যাচ্ছ?” নিক্কি তার কব্জি ধরে চিৎকার করে উঠল।

“যদি এখানেই রাত কাটাতে চাও, তবে আনন্দে কাটাও। আমি আমার মত করে চলে গেলাম।” সে বলে বাইকের চাবি ঘুরিয়ে দিল।

“তুমি এভাবে যেতে পারো না।” নিক্কি বলে উঠে।

“তাই…?” অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো রবি।

“তোমাকে কাঞ্চনের মতো করে আমাকে ঠোঁটে চুমু খেতে হবে।” এই বলে নিক্কি ওর ঠোঁট রবির ঠোঁটের কাছে নিয়ে গেল।

“মোটেই না।” অস্বীকার করে ঘাড় নাড়ল রবি।

“রবি!” নিক্কি সাপের মতো ফুঁসে ওঠে। “কসম করে বলছি। তুমি যদি আমাকে চুমু না দাও, আমি এখনই আমার জিপ নিয়ে এই পাহাড়ের নিচে লাফ দেব।”

“তামাশা বন্ধ কর এবং বাড়িতে যাও।” মনে মনে কেপে উঠে বলল রবি। নিক্কির মুখের কথায় কেঁপে উঠল সে।

“তুমি মনে করছ আমি মজা করছি।” নিক্কি হেসে বলল। তার চোখ জ্বলে উঠেছে – “আচ্ছা, আমার কথার সত্যতা যদি পরীক্ষা করতে চাও, তাহলে এখান থেকে এক কদম এগিয়ে দেখাও। আমি যদি এই পাহাড় থেকে লাফ না দিই, তবে আমি ঠাকুর জগৎ সিংয়ের মেয়ে নই।” পাথরের মত দৃঢ় ভাবে বলল – “তবে রবি মনে রেখ। সারাজীবন এই ভুলের জন্য তুমি অনুশোচনা করবে। কারণ আমি রসিকতা করি না।”

রবি মাথা থেকে পা পর্যন্ত কেঁপে উঠল। সে নিক্কির দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকাল। এ সময় নিক্কি খুব রেগে আছে। তার চোখে রাগের পাশাপাশি গভীর বেদনার স্তরও ছিল। রবি একজন সাইকিয়াট্রিস্, এটা বুঝতে তার বেশি সময় লাগেনি যে সে যদি নিক্কিকে আরও আঘাত করে, তাহলে সে সত্যিই তার জীবন দেবে।

প্রেমে অপমানিত একজন নারী, যৌন-আগুনে জ্বলন্ত শরীর যা কিছু করতে পারে। এর আগে একবার নিক্কিকে তুচ্ছ করেছিল। রবি চায়নি যে তার একটা ভুলের জন্য তার গলায় আবার কোনো বড় সমস্যা পড়ুক। নিক্কি যদি তার ভুলের জন্য কিছু করে বসে  তাহলে সে ঠাকুর সাহেবকে কী জবাব দেবে? ঠাকুর সাহেবের কি হবে যখন তিনি জানতে পারবেন যে তিনি যাকে তার স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের কাছে নিয়ে এসেছিলেন, সেই খুনি হয়ে তার মেয়েকে হত্যা করেছে।

এই উপলব্ধিতে রবি আবার কেঁপে উঠল। সে হতবুদ্ধি হয়ে ঠোঁট কামড়াতে লাগল। নিজেকে বাঁচানোর কোনো উপায় দেখতে পায় না।

সে নিক্কির দিকে তাকাল, সে তখনও রাগে জ্বলন্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে ছিল।

“ঠিক আছে।” রবি নিজের রাগ নিভিয়ে বললো – “কিন্তু এর পর তুমি আর তর্ক করবে না সোজা প্রাসাদে ফিরে যাবে?”

“আমি রাজি।” ঠোঁটে বিজয়ী হাসি দিয়ে বলল নিক্কি।

জবাবে রবি তার দিকে ঠোঁট এগিয়ে দিল। নিক্কি পেছন থেকে তার ঘাড় চেপে ধরে তার সাথে নিজের ঠোঁট মিলিয়ে দিল। তারপর পাকা আমের মত ওর ঠোঁট চুষতে লাগলো। একটা তীব্র শিহরণ রবির সারা শরীরে ভরে গেল। নিক্কির শরীরের উত্তাপ মুখ দিয়ে নামতে লাগল। নেশায় তার চোখ বন্ধ হয়ে যেতে লাগল। তার মনে হলো সে যেন অন্য জগতে পৌঁছে গেছে।

নিক্কি ঠোঁট চোষায় পারদর্শী ছিল। সে একইভাবে রবির ঠোঁট চুষতে থাকল। তারপর সম্পূর্ণ সন্তুষ্টির পর সে রবির থেকে আলাদা হয়ে যায়।

নিক্কি আলাদা হওয়ার সাথে সাথে রবি নিজের ভারী চোখের পাতা খুলে তার দিকে তাকাল। নিক্কির মুখে আনন্দ ঠোঁটে সাফল্যে গর্বের হাসি।

লজ্জায় রবির ঘাড় নিচু হয়ে গেল। কিছুক্ষণ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। নিক্কি তাকে দেখে হাসতে থাকে। রবি তার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বাইকে জোর করে একটা কিক দিল। সে এগোতে চাইলে নিক্কির কন্ঠ তার কানে লাগে – “থামো”

“আবার কি হয়েছে?” প্রশ্নবিদ্ধ চোখে রবি তার দিকে তাকায়।

“তুমি বলোনি কার স্বাদ আর গন্ধ ভালো? এই শহরের গোলাপ নাকি পাহাড়ি ফুল?” নিক্কির ঠোঁটে বিদ্রুপের হাসি।

রবি তার দিকে তাকিয়ে ব্যঙ্গ করে হাসল। তারপর বলে- “শহরের টবে ফোটা ফুলে সেই সুবাস কোথায় যেটা পাহাড়ের গাঁয়ে ফুটে থাকা ফুলে পাওয়া যায়? ”

রবির কথায় নিক্কির সমস্ত শরীর অপমানে জ্বলে উঠল। কিন্তু রবিকে কোন উত্তর দিতে পারার আগেই রবি এক ঝাঁকুনি দিয়ে এগিয়ে গেল। নিক্কি রাগ করে তাকে চলে যেতে দেখল।

 

২৬

কাঞ্চন যখন বাসায় পৌছে তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। রাতের খাবার রান্না করতে মাটির চুলায় আগুন জ্বালিয়েছিলেন শান্তা বুয়া। সুগনা তখনও বাড়ি ফেরেনি। চিন্টু বোধহয় ভিতরে পড়াশোনা করছিল।

কাঞ্চন শান্তাকে খুঁজতে রান্নাঘরে এলো। শান্তা ভাত রান্না করতে হাঁড়িতে পানি ভরছিল। সে শান্তাকে ডাক দিল – “বুয়া…. আজকে কি খাবার রান্না করছ?”

কাঞ্চনের কণ্ঠে শান্তা ঘুরে ওর দিকে তাকাল। তার চোখেওও একই প্রশ্ন। সেই সাথে তার মুখে কিছুটা অস্বস্তিও। – “তুই আজকে জিজ্ঞেস করছিস কেন? আমার হাতের তৈরি সব কিছুই তো তোর পছন্দ।”

“আরে…বুয়া! “কাঞ্চন আঙ্গুলে উড়না নাড়তে নাড়তে বলল – “বুয়া আজ ক্ষীর বানাও, আজকে ক্ষীর খেতে মন চাইছে।”

“ক্ষীর…?” শান্তা অবাক হয়ে তার দিকে তাকায় – “কিন্তু ক্ষীরের জিনিসপত্র কই?”

“তাহলে বুয়া নিয়ে এসো না। যা যা লাগে। আজ আমার বড় খেতে মন চাইছে…” কাঞ্চন ক্ষোভের সাথে বলল। তারপর আঙ্গুলে উড়না ঘুরাতে লাগলো।

শান্তা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে কাঞ্চনের দিকে। আজ কাঞ্চনকে একটু অদ্ভুত লাগছিল ওর। খাওয়ার এত অস্থিরতা ওর তো কখনো ছিল না। তাকে যা দেওয়া হত তাই খেত। কিন্তু আজ কেন সে ক্ষীর খেতে এত জেদ করছে?

শান্তা মনে মনে ভাবতে লাগলো- ওর বয়স আর কত, শুধু শরীরে বড় হয়েছে। বুদ্ধি এখনও বাচ্চাদের মতোই। হয়তো কারো বাড়িতে ক্ষীর তৈরি হতে দেখেছে। আর নিজেরও ক্ষীর খেতে ইচ্ছে করছে হয়ত। “আজ ক্ষীর খাওয়ার এত তাগিদ কেন?” শান্তা জিজ্ঞেস করল।

“অনেকদিন হয়ে গেছে না …!” কাঞ্চন সরলভাবে বললো “কি… বুয়া, বানাবে না?”

“তুই যে কি না। এত ভালোবাসা দিয়ে কথা বলছিস যখন।” শান্তা মুচকি হেসে বলল – “তোকে কিছু জিনিসের কথা বলি…. বনিয়ার দোকান থেকে নিয়ে আয়।”

কাঞ্চন মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। তারপর শান্তার কথা শুনে তাড়াতাড়ি উঠোনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। ততক্ষণে শান্তা অন্য কাজে ব্যস্ত।

প্রায় ৩০ মিনিট পর কাঞ্চন ফিরল। তার হাতে জিনিস ভর্তি ব্যাগ। ওকে দেখে শান্তার চোখ বিস্ময়ে বিস্তীর্ণ হয়ে গেল। “এত কি এনেছিস?”

শান্তা তাকে একদিনের জিনিস আনতেও বলেছিল। কিন্তু কাঞ্চন অনেকদিনের কথা ভেবে সারা সপ্তাহের মাল নিয়ে এসেছে। বুয়াকে বললো- “একবারে এনে দিলাম। ভালো হয়নি বুয়া। আবার যদি খেতে চাই?”

“তাহলে নিয়ে আয়।” ব্যাগ চেক করতে করতে শান্তা বলল। “এত! বেশিদিন রাখলে তো নষ্ট হয়ে যাবে না?”

কাঞ্চন চুপ করে গেল। এখন সে তার বুয়াকে কিভাবে বোঝাবে যে তার এখন প্রতিদিন ক্ষীর খেতে ইচ্ছে করবে।

তার মন খারাপ দেখে শান্তা বলল – “ভাল করেছিস মেয়ে তুমি এনেছিস। প্রতিদিন দোকানে যেতে কষ্ট হয়। এখন যখনই তোর ক্ষীর খেতে ইচ্ছে করবে, আমাকে বলবি আমি বানিয়ে দেব।”

শান্তা কাঞ্চনের কাছ থেকে ব্যাগটা নিয়ে সেখান থেকে জিনিসপত্র বের করতে লাগল। সে কখনও কাঞ্চনের কোন আবদার ফেলত না। ওর কোন দুঃখ যাতে না হয় সবসময় খেয়াল রাখত। মা হাড়া দুঃখী মেয়েটাকে সে সবসময় আগলে রাখে। ছোটবেলা থেকেই এইভাবে ছোটখাটো জিনিসের যত্ন নিত। যেন সে তারই গর্ভের সন্তান। কখনো শান্তা চিন্টুর উপর বৃষ্টি বর্ষণ করতো আবার কখনো তার দুষ্টুমির জন্য মারধর করতো, কিন্তু কখনো ভুল করেও কাঞ্চনকে বকাঝকা করতো না। আজও তার বিষণ্ণ মুখ দেখে যন্ত্রণায় সে কাতর।

কাঞ্চন তখনও শান্তার পিছনে দাঁড়িয়ে জিনিসপত্র বের করতে দেখছিল।

শান্তা ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হেসে বলল – “বেটি… আমি ক্ষীর বানাচ্ছি। তুই চিন্টুর সাথে বসে কিছুক্ষণ পড়াশুনো কর। ক্ষীর বানানোর সাথে সাথেই তোকে ডাকবো।”

“আমি তোমাকে ক্ষীর বানাতে দেখতে চাই বুয়া।” কাঞ্চন জোর দিয়ে বলল। – “কীভাবে ক্ষীর বানায়… আমি শিখতে চাই।”

“কেন তুই শিখতে চাস?” শান্তা জিজ্ঞেস করলো – “তোর কি মনে হয় আমি তোকে আর কখনো ক্ষীর খাওয়াবো না? ”

“সেটা নয়, বুয়া। আমি এখন ঘরের সব কাজ শিখতে চাই। তুমি আমাকে এখনও কিছু শেখাওনি।” অভিযোগ করে কাঞ্চন।

সে সত্যিই দুঃখিত যে তাকে কখনও ঘরের কাজ করতে দেয়নি। রান্না শেখায়নি। আর কিছু না হলেও সে যদি ক্ষীর বানাতে শিখে তাহলে অন্তত নিজের হাতে বানানো ক্ষীর রবিকে খাওয়াতে পারত।

ওখানে দাঁড়িয়ে শান্তা অবাক হয়ে ওকে দেখছিল। সে আজ কাঞ্চনের স্বভাবের অনেক পরিবর্তন দেখতে পেল। প্রথমে ক্ষীর খাওয়ার তাগিদ আর এখন ঘরের কাজের প্রতি আসক্তি…”কিছু তো একটা হয়েছে ওর।” সে মনে মনে ভাবল।

“হঠাৎ করে কেন তোর মনে হল ঘরের কাজ শিখতে?” শান্তা হেসে জিজ্ঞেস করলো।

“আমি যদি না শিখি….. আমি যখন শ্বশুর বাড়িতে যার, তখন আমার শাশুড়ি আমাকে বকাবকি করবে না? বলবে না… আমি ঘরের কোনো কাজ করি না।” কাঞ্চন বলতে থাকে “তাহলে বুয়া বল কত খারাপ হবে? তাহলে শাশুড়ি আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেবে। তাই এখন আমি তোমার সাথে রোজ রান্না শিখব আর ঘরের অন্যান্য কাজও করব।”

কাঞ্চনের নিষ্পাপ কথা শুনে একদিকে শান্তা মৃদু হাসছিল, অন্যদিকে সে বিস্মিতও যে কাঞ্চন আজ এত কিছু শিখল কোথা থেকে। সে আগে কখনো এভাবে কথা বলত না।

“তুমি হাসছ কেন?” শান্তাকে হাসতে দেখে কাঞ্চনের মুখে লজ্জার লালিমা ছড়িয়ে পড়ে।

“এমনিই।” শান্তা হেসে জবাব দিল। তারপর ওর নত মুখ দুহাতে চেপে ধরে সে বলল। “ঠিক আছে, আমি তোকে সব শিখিয়ে দেব। কিন্তু তোর মনে এই শ্বাশুড়ির ভয় কে ভরেছে?”

কাঞ্চনের সামনে রবির মুখ ঘুরে গেল। কিন্তু বুয়াকে তার কথা বলতে পারেনা। লজ্জিতভাবে চুপচাপ তাকিয়ে রইল শান্তার দিকে।

“ঠিক আছে, বলিস না, আমার সাথে বস, আমি আজ তোকে ক্ষীর বানিয়ে দেখাবো। তারপর তোর শ্বশুরবাড়িতে তোর শাশুড়ির জন্য বানিয়ে দিস।” এই বলে শান্তা কাঞ্চনের হাত ধরে চুলার কাছে নিয়ে গেল। তারপর সে তাকে একে একে সব পদ্ধতি বলা শুরু করল এবং কাঞ্চন তার নির্দেশ মতো ক্ষীর তৈরি করতে লাগল।

কাঞ্চন শান্তার বলা কথাগুলো পুরো মনোযোগ দিয়ে চালিয়ে যেতে থাকে। কাঞ্চন এই কাজে এতটাই হারিয়ে গিয়েছিল যে চিন্টু বারবার ডাকলেও সে তার কাছে যায়নি। এই সময়ে প্রতিদিন সে চিন্টুকে পড়াতো, কিন্তু আজ সে তার ভাইয়ের দিকে তাকায়নি।

অবশেষে! কাঞ্চনের কঠোর পরিশ্রম সম্পন্ন হল এবং তার মিষ্টি ক্ষীর প্রস্তুত হল। এর মধ্যে সুগনাও ফিরে এসেছে। উঠানে পা দিতেই ক্ষীরের সুগন্ধ নাকে এসে পড়ল।

“ওহহহ… তো আজকে ঘরেই ক্ষীর বানানো হচ্ছে।” সুগনার নাকে গন্ধ পেয়ে চুলার কাছে চলে এল। “এটা দারুণ গন্ধ।”

“ভাই সুগন্ধ আসবে না কেন। কাঞ্চনের হাতে যে তৈরি।” সুগনাকে জল দিতে দিতে শান্তা বলল।

“কি …..!” খুশিতে ভরা কণ্ঠস্বর বেরিয়ে এল সুগনার মুখ থেকে। সে কাঞ্চনের দিকে তাকাল, ঠোঁটে হাসি আর চোখে লজ্জা নিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। “এটা জেনে আমার ক্ষুধা দ্বিগুণ হয়ে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই খাবার খেয়ে নেব… তবে এখন বাটিতে খানিকটা ক্ষীর নিয়ে এসো। দেখি আমার মেয়ে কেমন ক্ষীর বানিয়েছে।”

সুগনা বলতে দেরি আর কাঞ্চন দৌড়ে গেল ক্ষীর আনতে। রান্নাঘর থেকে একটা বাটি এনে ক্ষীরে ভরে সুগনাকে দিল। তারপর সুগনার প্রশংসা শোনার জন্য কাছে দাঁড়াল।

সুগনা চামচ দিয়ে ক্ষীর তুলে মুখে নিল। তারপর জিভ নাড়িয়ে কাঞ্চনের দিকে তাকাল। কাঞ্চন একই দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। তার মনে হাজারো সংশয়…না জানি বাপুর ক্ষীর কেমন পছন্দ হয়েছে। খারাপ হলে বাপু রেগে যাবে। কিন্তু পরের মুহুর্তে তার সমস্ত সন্দেহ অমুলকত প্রমাণিত হয়… যখন তার চোখ পড়ে সুগনার ঠোঁটে ছড়িয়ে থাকা হাসির দিকে।

“বলো বাপু, কেমন লাগলো ক্ষীর?” কাঞ্চনের আর তর সইছে না। তার কঠোর পরিশ্রমের ফল জানার আগ্রহ ছিল চরমে।

“সুস্বাদু …. খুবই সুস্বাদু!” সুগনা খুশি হয়ে বললো- আমার মেয়ে এত ভালো ক্ষীর বানাতে পারে আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না।

কাঞ্চন আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে। বাবার মুখ থেকে নিজের হাতে বানানো ক্ষীরের প্রশংসা শুনে লোম শিহরিত হয়ে উঠে। মন চাইছিল ময়ূরের মতো নাচতে। কিন্তু বাবার সামনে থাকাতে তার সুখ হৃদয়েই সমাহিত করে রাখে।

তার খুশি শুধু এ কারণেই নয় যে সে ভালো ক্ষীর তৈরি করেছিল এবং তার বাবার প্রশংসা করেছিল। তার খুশির কারণ ছিল রবি….! আগামীকাল সে তার স্যারকে নিজ হাতে ক্ষীর বানিয়ে খাওয়াতে পারবে ভেবে সে আনন্দিত বোধ করছিল। তার মুখ থেকে নিজের সত্যিকারের প্রশংসা শুনতে পারবে। সে খুশি ছিল যে এখন সে রবিকে নিজের করে নিতে পারবে। বলতে গেলে, সে কেবল ক্ষীর বানাতে শিখেছে… তবে কেউ যদি তার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে তবে সে বুঝতে পারবে সেই ক্ষীরের মধ্যে কত অনুভূতি লুকিয়ে ছিল।

 

রবি যখন প্রাসাদে পৌঁছল, নিক্কিও তার পিছনে প্রাসাদে প্রবেশ করল। দিওয়ান ঠাকুর সাহেবের সঙ্গে হলঘরে বসেছিলেন। তারা নিজেদের মধ্যে কিছু কথা বলছিল তখন রবি তাদের হাত জোড় করে শুভেচ্ছা জানাল।

বাইরে থেকে রবি আর নিক্কিকে একসঙ্গে আসতে দেখে ঠাকুর সাহেবের চোখে আনন্দে হাসি ফুটল। “এসো রবি, আমরা তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। তোমার সাথে আমার কিছু জরুরি কাজ আছে।” ঠাকুর সাহেব রবিকে বললেন।

বিস্ময়ে রবির চোখ সরু হয়ে গেল। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নিক্কির দিকে তাকিয়ে সে দেখতে পেল তার ঠোঁটে বিষাক্ত হাসি। সে আবার ঠাকুর সাহেবের মুখের দিকে চোখ ফেরাল। তার মুখে গভীর তৃপ্তির ছাপ। রায়পুরে আসার পর এই প্রথম ঠাকুর সাহেবকে এত খুশি দেখে। কিন্তু তার সন্তুষ্টির কারণ ছিল তার বোধগম্যতার বাইরে।

 

২৭

“বস, রবি, দাঁড়িয়ে আছ কেন?” ঠাকুর সাহেব রবিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বসার ইঙ্গিত করলেন।

“জি ধন্যবাদ।” রবি ঠাকুর সাহেবকে উত্তর দিল, ধীরে ধীরে হেঁটে সোফায় বসল। তারপর ঠাকুর সাহেবের দিকে প্রশ্নাতীত দৃষ্টিতে তাকাল – “আমার সাথে কি কথা বলতে চেয়েছিলেন বলুন?” রবি জিজ্ঞেস করলো.. নিক্কির সাথে সংঘর্ষের উত্তেজনা তখনো মুখে ছড়িয়ে আছে।

“ব্যাপারটা তোমার, রবি।” ঠাকুর সাহেব বললেন – “যখন থেকে তুমি এই প্রাসাদে এসেছ। সবকিছুই আমাদের জন্য শুভ হয়ে উঠছে। সত্যি বলতে, এখন আমাদের মনে হতে শুরু করেছে যেন আমাদের সমস্ত সুখ তোমার মাধ্যমে চলে যায়।”

“বুঝলাম না … আপনি কি বলতে চাচ্ছেন?” হতভম্ব হয়ে বলল রবি।

“রবি ব্যাপারটা হল যে …..!” ঠাকুর সাহেব ব্যাপারটা অসম্পূর্ণ রেখে নিজের জায়গা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর হাঁটতে হাঁটতে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে কিছু একটা ভাবতে লাগলেন।

তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দিওয়ানজিও সোফা ছেড়ে উঠে গেলেন। কিন্তু রবি নিজের জায়গায় বসে ঠাকুর সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইল। ঠাকুর সাহেব তার কাছে পিঠ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং তার দুই হাত পিছনে বাঁধা ছিল।

“আসলে …আমরা চাই নিক্কি বিয়ে করুক।” ঠাকুর সেই ভাবে দাঁড়িয়ে বললেন। সে আসলে রবির সাথে সরাসরি কথা বলতে সে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছিল না।

“খুবই খুশির ব্যাপার ঠাকুর সাহেব।” জোর করে হাসার চেষ্টা করে বলল রবি। সে নিক্কির দিকে তাকাল যে তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল।

“ঠিক বলেছ রবি।” ঠাকুর সাহেব রবির দিকে মুখ ফিরিয়ে বলিলেন- “আসলে সুখের ব্যাপার, কিন্তু আমাদের সুখ এখনও অসম্পূর্ণ, তা তখনই পূরণ হবে যখন তোমার ইচ্ছাও এতে অন্তর্ভুক্ত হবে।”

“ম… আমার ইচ্ছা?” রবি নড়বড়ে হয়ে গেল। “আমি কিছুই বুঝলাম না। কিসের কথা বলছেন?”

“রবি, আমরা জানি না কিভাবে কথাটা বলব।” রবির নার্ভাসনেস উপেক্ষা করে ঠাকুর সাহেব বললেন – “আসল কথা হল আমরা নিক্কির জন্য তোমার সম্মতি চাই। নিক্কির জন্য আমরা যে সব গুণ চেয়েছিলাম তা সবই তোমার মধ্যে আছে। সত্যি হল রবি আমরা যা চাই। যেদিন তুমি ছেলে হওয়ার ভান করেছিলে- রাধার সামনে জামাই….সেদিন থেকে আমরাও তোমাকে জামাই হিসেবে দেখতে শুরু করেছি। এখন তুমি অনুমতি দিলে আমরা এই সম্পর্কটা নিশ্চিত করতে চাই।”

রবি তো মহা ভাবনায় পড়ে গেল। ঠাকুর তাকে যে এভাবে মুড়ে ফেলবেন সে ভাবতেও পারেনি। রবি বিভ্রান্ত হয়ে গেল। সে ঠাকুর সাহেবকে সকলের সামনে না বলে অপমান করতে চায়নি। আর হ্যাঁও বলতে পারেনি।

“কি হয়েছে রবি? কি ভাবছো?” হঠাৎ ঠাকুর সাহেবের কণ্ঠে রবি চমকে উঠল। ঠাকুর সাহেবের দৃষ্টি স্থির হইল তার উপর।

“ঠাকুর সাহেব, আপনাদের সবার প্রতি আমার অনেক শ্রদ্ধা, প্লিজ … আমার কথাগুলো খারাপ ভাবে নেবেন না।” রবি বিনীত কণ্ঠে ঠাকুর সাহেবকে বলে – “আমি এই মুহূর্তে আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব না। আমার কিছু বাধ্যবাধকতা আছে। আমার একটু সময় দরকার।” সে নিক্কির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আরও বলতে শুরু করল – “আপাতত আমি আপনার কাছে একটা জিনিসের অনুমতি দিতে চাই। আমি আমার মাকে এখানে ডাকতে চাই… যদি আপনার কোন সমস্যা না হয়?”

“সমস্যা নেই, রবি, আমাদের কোন তাড়া নেই। তুমি ঠিক করে ভেবে দেখো তারপর আমাদের বলবে।” ঠাকুর সাহেব তার দ্বিধা মুছে দিয়ে বললেন – “এখন যেহেতু তোমার মায়ের আগমনের ব্যাপার, তাহলে অবশ্যই তাকে ফোন করো…. আমাদেরও তার সাথে দেখা করার ইচ্ছা আছে। তার সাথে দেখা করে আমরা খুব খুশি হব।”

“ধন্যবাদ … ঠাকুর সাহেব।” রবি উঠে দাড়িয়ে বলল – মাকে ফোন করে কাল এখানে ডেকে আনব।

“রবি বাবু।” হঠাৎ দিওয়ান জি বললেন- “আমি একদিনের মধ্যে কিছু কাজে শহরে যাব।

“এর চেয়ে ভালো আর কি, দিওয়ান জি। আমি তার একা আসার চিন্তায় ছিলাম। কিন্তু এখন আমার দুশ্চিন্তা কেটে গেছে।” রবি দিওয়ান জির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

“ঠিক আছে রবি, এখন তুমি গিয়ে বিশ্রাম নাও। তোমার মা আসার পরই এ বিষয়ে কথা বলব।” ঠাকুর সাহেব বললেন।

“হ্যাঁ… নমস্কার।” রবি হাত জোড় করে ঠাকুর সাহেব ও দেওয়ান জিকে প্রণাম করল। তারপর নিক্কিকে দেখে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল।

“দেওয়ান জি আপনার কি মনে হয়? রবি কি এই সম্পর্ককে হ্যাঁ বলবে?” রবি চলে যাওয়ার পর, ঠাকুর সোফায় বসে দেওয়ান জিকে জিজ্ঞেস করলেন।

“সে হ্যাঁ বলবে না, বাবা!” দেওয়ান জির সামনেই নিক্কি বলল।

নিক্কির কথায়, দিওয়ানজি এবং ঠাকুর সাহেব একসাথে হতবাক হয়ে তার দিকে ফিরে তাকায়। দুজনের চোখ এক সাথে নিক্কির মুখের দিকে পড়ল। বিষাদের ঘন মেঘ তার মুখে ঝুলে ছিল। সে অসহায়ভাবে ঠোঁট কামড়াচ্ছিল।

নিক্কির এমন অবস্থা দেখে দুজনেই স্তব্ধ হয়ে গেল। ঠোঁট চিবিয়ে নিক্কি আরও বলল- “আমি রবির পছন্দ নই পাপা। ওর পছন্দ কাঞ্চন।”এই বলে নিক্কি ঘাড় ফেরাল। যেন সে ভয় পাচ্ছে যে তার চোখের বেদনা প্রকাশ পেয়ে যেতে পারে। সে তার বাবাকে চোখের জল দেখাতে চায়নি।

“কি বলছ নিক্কি?” ঠাকুর সাহেব আহত চোখে নিক্কির দিকে তাকিয়ে বললেন।

“এটা সত্যি বাবা, মেনে নাও। রবির সাথে এ নিয়ে কথা বলা বৃথা। তার স্বপ্ন এই প্রাসাদে থাকা নিক্কির নয়, সেই কুঁড়েঘরে থাকা কাঞ্চনের জন্য।” এই বলে নিক্কির গলা ভারী হয়ে গেল। তার চোখের জল লুকানো কঠিন হয়ে গেল। “আমি আমার রুমে যাচ্ছি বাবা।” নিক্কি বলে দ্রুত সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল।

ঠাকুর সাহেব ও দিওয়ানজী পাথরের মূর্তি হয়ে তা দেখতে থাকলেন।

“হঠাৎ কি হল দেওয়ান জি?” হুশ ফেরার সাথে সাথে ঠাকুর সাহেব দিওয়ান জিকে বললেন – “এই সব আমাদের পিছনে ঘটছে আর আমরা জানতেও পারিনি।”

“আমিও এ বিষয়ে জানতাম না, সরকার … তবে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। বিষয়টি এখনও সুরাহা করা যেতে পারে।” দেওয়ান স্যার ঠাকুর সাহেবকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন- “এই মুহূর্তে আমাকে নিক্কি বেটার সাথে কথা বলার অনুমতি দিন। প্রথমে তার হৃদয়ের অবস্থা আমার জানতে হবে।”

“যান ….. দেওয়ান জি, গিয়ে নিক্কিকে দেখে আসুন। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। জানি না কেন আমাদের কপালে সুখ সয় না।” ঠাকুর সাহেব হতাশ হয়ে বললেন।

“যদি আমি হতাম…. এইবার দরজা দিয়ে সুখ ফিরবে না। দেওয়ান জি আবার তাকে আশ্বস্ত করলেন- “আমি আগে নিক্কি বেটার সাথে দেখা করব তারপর আপনার সাথে কথা বলব।” এই বলে দিওয়ান জি নিক্কির ঘরের দিকে এগিয়ে গেল।

দরজায় পৌঁছে দেওয়ান জি দরজায় আলতো করে স্পর্শ করলেন, দরজা খুলে গেল। দিওয়ান জির চোখ ঢুকে গেল ভিতরে। নিক্কি বিছানায় মুখ থুবড়ে শুয়ে ছিল।

“নিক্কি বেটা।”দিওয়ান জি দরজা থেকেই কথা বললেন। নিক্কি মুখ ফিরিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা দেওয়ানজির দিকে তাকিয়ে বিছানায় বসে পড়ল।

“নিক্কি বেটা … .আমাদেরকে বলো….পুরো গল্পটা বলো….তোমার, রবি আর কাঞ্চনের মধ্যে যা কিছু আছে, সব বলো।” দিওয়ান জি অধৈর্য হয়ে কথা বললেন।

“তারা দুজনে একে অপরকে ভালোবাসে, চাচা…।” নিক্কি দেওয়ান জির দিকে তাকিয়ে ভারি গলায় বলে- “আমি নিজ চোখে দেখেছি দুজনের মিলন।”

“কিন্তু তুমি কি চাও, বেটা?” দেওয়ান জি নিক্কির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন – “যে যাই কিছু চাক… কিন্তু তুমি যা চাও তাই হবে। এটা আমার ওয়াদা।” হঠাৎ দিওয়ান জির কন্ঠে রূঢ়তা।

নিক্কি বিস্ময়ে দেওয়ানের দিকে তাকাল। এ সময় তার বুড়ো চোখেও একটা স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠল। নিক্কি তার চোখের দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বললো – ” চাচা আমি কাঞ্চনের খারাপ চাই না… তবে আমি রবিকে ছাড়া বাঁচতে পারব না। প্রথম দিকে আমি রবিকে পছন্দ করতাম না কিন্তু কেন আমি জানি না ওর কাছ থেকে যতটা দূরে থাকতাম আমি ততটাই কাছের অনুভব করতাম। কখন যে ওর প্রেমে পড়তে শুরু করি বুঝতেই পারিনি। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। রবি অন্য কারোর এখন।”

“ওকে তোমারই হতে হবে নিক্কি।” দেওয়ান জি নিক্কির মাথা ছুঁয়ে চুলে আদর করে বললেন। “সে অন্য কারো হতে পারে না। আমি তাকে অন্য কারো হতে দেব না।” কাঁপা কাঁপা দৃঢ় গলায় দিওয়ান জি বললেন।

“চাচা ….. ” দেওয়ানের রাগী কথা শুনে কেঁপে উঠল নিক্কি। – “আপনি কি… ক্ষতি করবেন কাঞ্চনে। সে আমার বন্ধু।

নিক্কির গলা শুনে দেওয়ান জি হাসলেন। – “তুমি চিন্তা করো না নিক্কি বেটা। আমরাও কাঞ্চনের খারাপ চাই না… আর ওর খারাপ করার কথাও ভাবতে পারি না।”

“এটা কি সম্ভব চাচা…?” নিক্কি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল দেওয়ানজির দিকে। “রবি কাঞ্চনকে খুব ভালোবাসে। ওকে কখনো ছেড়ে যাবে না।”

“ওকে নিয়ে চিন্তা করো না বেটা…!” দিওয়ান জি মৃদু হাসলেন। তারপর নিক্কির মুখটা দুহাতে নিয়ে ওর চোখে উঁকি দিয়ে বললো- “শুধু একটা প্রতিজ্ঞা করো যে আমরা শহর থেকে ফিরে না আসা পর্যন্ত তুমি তোমার পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেবে না। আর কাঞ্চন যেভাবে চলছে, যেতে দাও। তুমি শুধু ভরসা রাখো। আমি দেখছি।

“ঠিক আছে চাচা….” দেওয়ানজির কথায় নিক্কি রাজি হল – “আপনি যা বলবেন আমি তাই করব। আপনার শহর থেকে ফিরে না আসা পর্যন্ত আমি কিছু করব না। কিন্তু আপনি তাড়াতাড়ি ফিরে আসবেন।”

“একদম বেটা ….. আমার মাত্র তিন-চার দিন লাগবে। তবে আর একটা কথা মনে রেখো। এই ঘরে তোমার আর আমার মধ্যে যা কিছু হয়েছে… মালিককে বলো না। মালিক জিজ্ঞেস করলে বলতে পারো… যেটাতে রবি আর কাঞ্চন খুশি, তুমিও তাতেই খুশি। ওদের সম্পর্ক নিয়ে তুমি খুশি। মালিক এমনিতেই খুব দুঃখী…। .. তোমার দুঃখের কথা জানলে ওনি আরো ভেঙ্গে যাবে। তুমি সবসময় তার সামনে হাসি খুশি থাকবে।”

“হ্যা … বুঝলাম চাচা…” নিক্কি সম্মতিতে ঘাড় নাড়ল।

“ঠিক আছে বেটা …এখন যাচ্ছি। নিজের খেয়াল রেখো।” এই বলে দিওয়ান জি নিক্কির ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

 

২৮

রবি নিজের ঘরে বসে গভীর চিন্তায় মগ্ন। মায়ের আগমনের পর সে ঠাকুর সাহেবকে কী উত্তর দেবে তা বুঝতে পারছে না। ঠাকুর সাহেবের বড় আশা তার প্রতি। কিভাবে সে তা অস্বীকার করতে পারে? বেচারা এমনিতেই দীর্ঘদিনের স্ত্রীর দুঃখে ভুগছে…নিক্কিকে বিয়ে করতে অস্বীকার করলে তার কতটা কষ্ট হবে?

“যাই হোক …!” রবি নিজে নিজই বকবক করে। “আমি কাঞ্চনের প্রতি অবিচার করতে পারি না। নিক্কি একজন ধনী বাবার মেয়ে। সে খুব সহজেই ভালো সম্পর্ক করতে পারে। কিন্তু কাঞ্চন…? সে কুঁড়েঘরে বসবাসকারী গরীব কৃষকের মেয়ে। পৃথিবী এদিক ওদিক হয়ে গেলেও কাঞ্চনের পাশ ছাড়ব না। হ্যাঁ… ঠাকুর সাহেবের হৃদয়ে নিশ্চয়ই ব্যাথা হবে। তবে তিনি একজন বিচক্ষণ ব্যক্তি এবং আমার অনুভূতি বুঝবেন। এখন আমাকে শুধু মাকে বোঝাতে হবে”

ঠিক করে, কাঞ্চনের জন্য প্রয়োজন হলে সে মায়েরও বিরোধিতা করবে। যাইহোক, তার মায়ের প্রতি তার পূর্ণ বিশ্বাস ছিল যে সে তার সুখের বিরুদ্ধে যাবে না।

কাঞ্চনের কথা মনে পড়তেই ঠোঁটে হাসি ছড়িয়ে পড়ল। ওর মায়াবী মুখের কথা মনে পড়তেই সব দুশ্চিন্তা দূর হয়ে গেল। মস্তিস্কের সব ভার নেমে এসেছে। কাঞ্চনের স্মৃতিতে হারিয়ে যেতে থাকে সে।

 

বেলা ১ টা বাজে। শান্তা আপন মনে নদীর দিকে যাওয়া এবড়ো-খেবড়ো পথ ধরে হাঁটছিল। এ সময় সে তার ভাই সুগনার জন্য খাবার দিতে মাঠে গিয়েছিল। তাকে খাওয়ানোর পর সে এখন নদীর দিকে যাচ্ছিল।

এ সময় সুগনার জন্য খাবার নিয়ে প্রতিদিন মাঠে যেত শান্তা। কিন্তু আজ সেও মাঠে কিছু কাজ করেছে। মাত্র এক ঘণ্টার পরিশ্রম তাকে পুরোপুরি ক্লান্ত করে দিয়েছে। সে ঘামে ভিজে গেছে। এমতাবস্থায় বাড়ি যাওয়ার আগে নদীতে গিয়ে গোসল করাই সঙ্গত মনে করল।

সে কোন গভীর চিন্তায় হারিয়ে পথ দিয়ে যাচ্ছিল এমন সময় একটা পুরুষালী কণ্ঠ তার কানে এল। কন্ঠটা জোড়ালো ছিল আর সে ছিল নিজের ভুবনে ফলে চমকে উঠল। কণ্ঠের মালিকের চোখ পড়তেই তার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। তাকে দেখে শান্তার মনটা কেঁপে ওঠে।

“আচ্ছা, তুমি।” নিঃশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করে শান্তা বললো- “নালায়েক বিরজু, কেউ কি কাউকে এমন আওয়াজ দেয়? আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছ।”

“ভুল হয়ে গেছে বুয়া। কোথায় যাচ্ছেন?” বিরজু তার কালো দাঁত দেখিয়ে হাসল।

“এর সাথে তোমার কি সম্পর্ক? আমি যেখানেই যাই। কেন জিজ্ঞেস করছো?” বুয়া জিজ্ঞেস করল।

“আরে বুয়া, আমাদের যদি একটাই গন্তব্য হয় তাহলে আমরা একসাথে যাব না কেন।” বিরজু দুই অর্থপূর্ণ কথায় বলল।

শান্তা অদ্ভুত চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার মতো পাপীর চেয়ে আমি একাই ভালো আছি। ”

“আমি কি করলাম, বুয়া, আপনি আমাকে পাপী বলছেন?” বিরজু কাছে পৌঁছে বলল। “আমি কখনো আপনার শ্লীলতাহানি করিনি… আপনাকে হয়রানি করিনি, আপনাকে কখনো নোংরা কথা বলিনি, আপনার শরীর স্পর্শও করিনি। তাহলে আপনি আমাকে পাপী বলছেন কেন?” বিরজু ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত শান্তার শরীরের দিকে তাকিয়ে রইল।

শান্তা তার কামুক চোখের কাঁটা নিজের শরীরে অনুভব করে মৃদু কেঁপে উঠল। বিরজুর তৃষ্ণার্ত চোখ তার নাজুক অঙ্গে গড়িয়ে পড়তে দেখে তার শরীরে প্রবল শিহরণ জাগে। নিজের স্বামীর অনুভূতিতে ভেজা সেই মুহূর্তগুলোর কথা তার মনে পড়ে। কি একটি পাগল মুহূর্ত ছিল। সে কি মজার মধ্যে ডুবে ছিল। আজ আবার সেই একই জ্বর ধীরে ধীরে গ্রাস করছে তাকে। নেশায় তার চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছিল।

শান্তা তার ভারী চোখের পাতা খুলে বিরজুর দিকে তাকাল। তারপর বললো- “প্রথমে আমাকে বুয়া ডাকো না……! তুমি আমার থেকে মাত্র তিন বছরের ছোট।”

“তাহলে কি বলব? শান্তা…?” শান্তার বদলে যাওয়া মেজাজ দেখে বিরজু বলল।

সে ছিল একজন ঘাগু শিকারী। শান্তার চোখে আবেগের ঢেউ ছড়িয়ে পড়তে দেখেছে সে। শরীরে উত্তাপ বেড়েই চলেছে তার। শান্তার মনের স্ফুলিঙ্গে আরও একটু হাওয়া দেওয়া দরকার। তারপর সেই স্ফুলিঙ্গ শোলা হয়ে উঠতে বেশি সময় লাগবে না। সে এটাও জানতো যে শান্তা তার কথার বিরোধিতা করলেও সে কোনো আওয়াজ করবে না।

“তোমার মনে যা চায় বলো … কিন্তু বুয়া বলো না।” কাঁপা কাঁপা গলায় বলল শান্তা।

“ঠিক আছে, শান্তা … এখন বল… কোথায় যাচ্ছ?” বিরজু কামুক সুরে বলল।

“আমাকে বল তুমি ঠিক কি চাও?” শান্তা ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল।

“আমি তো চাই… আমি খুব দুষ্টু … .কিন্তু তুমি যা খুশি দিয়ে দাও, আমি তাই নেব…..শান্তা।” হাসিমুখে বলে। শান্তা কথাটার ওপর আবার জোর দিল।

মাথা থেকে পা পর্যন্ত কেঁপে উঠল শান্তা। বিরজুর সাহস দেখে সে অবাক হলো। কিন্তু কেন জানি রাগ হল না বিরজুর উপর.. বিরজুর চোখের দিকে তাকালো, সেখানে সে লালসা ছাড়া কিছুই দেখতে পেল না। মেয়েটা কিছু বলল না। শুধু স্তব্ধ হয়ে বিরজুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তার হৃৎপিণ্ড দ্রুত স্পন্দিত হচ্ছিল। বিরজুর চোখের উত্তাপ সে নিজের ভেতরে অনুভব করতে লাগল।

তারপর হঠাৎ এমন একটা ঘটনা ঘটল যা শান্তা কল্পনাও করেনি। বিরজু এক হাতে ওর ঘাড় ধরে ওর ঠোঁটে নিজের ঠোঁট রাখল।

শান্তা….বাকরুদ্ধ! এত তাড়াতাড়ি ঘটে গেল যে সে কিছুই বুঝতে পারল না। বিরজু ঠোঁট কামড়াতে শুরু করেছে।

শান্তা কিছু করার আগেই বিরজু আরেকটি বিপর্যয় ঘটিয়েছে। এক হাত ওর স্তনের উপর রেখে টিপতে থাকে।

শুধু শান্তার শরীর নয়, তার আত্মাও কেঁপে ওঠে। বিদ্যুতের গতিতে তার শরীরে লালসার প্রবল ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু তারপরও তার বিরোধিতা অব্যাহত ছিল। শান্তা তার সমস্ত শক্তি দিয়ে তাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছিল…..কিন্তু বিরজুর শক্ত হাতের কবল থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারছিল না।

বিরজু তার ঠোঁট চুষতে থাকে আর তার স্তন টিপতে থাকে। বিরজুর কঠিন হাতের স্পর্শ তাকে এখন উষ্ণ করে তুলছিল। এবার তার ঠোঁটও বিরজুর ঠোঁটের সাথে মিশে যেতে লাগল। তার প্রতিবাদ এখন নিছক ভান। বিরজু ঘাড় থেকে অন্য হাত সরিয়ে নিতম্বের ওপর রেখে কোমরের কাছে চেপে ধরল। শান্তা তার আরো কাছে চলে গেল। বিরজু ওর পাছা টিপতে আর ঘষতে লাগলো।

বিরজুর ঠোঁট এখন ঘাড় আর বুকে ঘুরছে। শান্তার মুখ থেকে একটা মিশ্র হিসি বের হতে লাগল। বিরজুর হাত তার সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আঁকড়ে ধরতে ব্যস্ত। শান্তার চোখ কখন বন্ধ হল টের পেল না। বিরজুর কারসাজিতে শুকনো পাতার মতো উড়ে যাচ্ছিল শান্তা।

বিরজু এখন দেরি করা সঙ্গত মনে করল না। সে তার দুই হাত শান্তার পাছার উপর রেখে তাকে উপরে তুলে দিল। হাতে নিয়ে ঝোপের দিকে এগিয়ে গেল। বিরজু তাকে ধরে মাটিতে লম্বা করে শুইয়ে দিতেই বিরজু একটি হাত তার উরুতে রাখল।

হঠাৎ! শান্তা ফিরে এসেছে! সে বিরজুকে একটা ধাক্কা দিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল। বিরজু অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল।

শান্তা তার শরীর আর নিঃশাষ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছিল। নেশার উচ্ছ্বাসে তার চোখ লাল ও ভারী হয়ে উঠল।

“কি হয়েছে শান্তা?”বিরজু প্রফুল্ল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল।

“এম … আমি এটা করতে পারবো না, বিরজু।” কাঁপা কাঁপা গলায় কথা বলল।

“কেন …..? সমস্যা কি?” বিরজু অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল।

“আমি এই মুহুর্তে খোলা জায়গায় এটি করতে পারি না …. দিবালোকে..আমি দুঃখিত।” শান্তা বলে বিরজুর উত্তরের অপেক্ষা না করে নদীর দিকে ছুটে গেল।

বিরজু তার মুঠি মুঠো করে তাকে যেতে দেখছিল। সে চাইলেই তাকে বাধ্য করতে পারত। কিন্তু তাকে শান্তাকে পেতে হবে শুধু ভালোবাসা দিয়ে। তাই এবারের মত নিজেকে নিয়ন্ত্রনে রাখে।

শান্তা নদীতে পৌঁছে গেছে। সে তাড়াতাড়ি কাপড় খুলে নদীতে ঝাঁপ দিল। বুক ভরা জলে দাঁড়িয়ে নিজের জ্বলন্ত শরীরটাকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করল। সে শুধু পানির নিচে পেটিকোট পরে ছিল।

শরীরে আদর করতে করতে শান্তা তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে জ্বালাতন করতে থাকে। একটি হাত তার স্তন শক্ত করে টিপছিল, অন্যটি তার যোনির দরজায় টোকা দিচ্ছিল।

শান্তার অস্থিরতা বাড়ছিল। সে হাতের আঙ্গুল দিয়ে যোনি খোঁচাতে লাগল। বছরের তৃষ্ণা যোনি স্পর্শে গলে যায়। শান্তা রস ঝড়াতে চাইল। এই সময় তার শরীরে যে আগুন জ্বলছিল… রস ঝড়ানো ছাড়া নিভবে না। দেরি না করে একটা আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিল যোনির ভিতর। আঙুলটা যোনিতে ঢোকার সাথে সাথেই ওর মুখ থেকে আনন্দের একটা হাল্কা চিৎকার বেরিয়ে এল। সেই সাথে ওর চোখ দুটো মজায় বন্ধ হয়ে গেল।

চোখ বন্ধ করতেই বিরজুর ছবি ভেসে ওঠে মনে। শান্তার হাত আরও দ্রুত চলতে থাকে। সে তার অন্য আঙুলটিও যোনির ভিতরে ঢুকিয়ে দিল। তারপর আঙুলের গতি বেড়ে গেল। ওর মনে হল যেন বিরজুর হাত ওর যোনির উপর দিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর তার শরীর কেঁপে উঠল… তারপর প্রবল চিৎকারে তার যৌবনের রস যোনি দিয়ে প্রবাহিত হয়ে জলে মিশে গেল। সেই রস নদীর জলে ভেসে যায়।

 

২৯

বেলা তিনটা বাজে। শান্তা তার ঘরে খাটে শুয়ে গভীর দুশ্চিন্তায় মগ্ন। শান্তার ভাবনার ভিত্তি হলো নদীর পথে বিরজুর সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা।

সে ভাবছিল আজ সে কেমন লাঞ্ছিত হল। সে কি করে এতটাই অসহায় হয়ে গেল যে বিরজুর মতো একজন লম্পট তার অঙ্গ স্পর্শ করতে থাকল… ঘষতে থাকল এবং সে তাকে প্রতিরোধ করতেও পারল না। সে আগে এতটা দুর্বল ছিল না…তাহলে আজ সে এতটা দুর্বল হল কিভাবে যে একজন পরপুরুষ তার সাথে যথেচ্ছ কাজ করতে থাকে এবং সে তাকে ইচ্ছামত সবকিছু করতে দেয়।

শান্তা খারাপ মহিলা ছিল না। সে ছিল উত্তম চরিত্রের নারী। যৌবনেও এমন জঘন্য কাজ সে কখনো করেনি, যে কারণে আজকের ঘটনা মনে পড়লে তার আত্মা রক্তাক্ত হচ্ছে। তবে এতে তার কোনো দোষ ছিল না। সর্বোপরি, সেও রক্ত মাংসের তৈরি। আবেগও ছুটছিল তার মধ্যে। সেও কাউকে খুঁজতে চেয়েছিল। তার শরীরও পুরুষমানুষের শরীরের নিচে পিষ্ট হতে চেয়েছিল। এটা একটা স্বাভাবিক প্রয়োজন… তার কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না।

৮ বছর ধরে শারীরিক সুখ থেকে বঞ্চিত শান্তা। একটি যুবতী শরীর কতক্ষণ ক্ষুধার্ত থাকতে পারে? কোনো না কোনো সময় তাকে ভেঙে পড়তে হয়।

যখন তার স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যায় তখন তার বয়স ছিল ২৮ বছর। পাশের গ্রামে বসবাসকারী দিনেশ চৌধুরীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল। তখন দীনেশের আর্থিক অবস্থা খুব ভালো ছিল। শান্তার পাশাপাশি সুগনাও এই সম্পর্ক নিয়ে খুশি ছিল।

বিয়ের কিছুদিন পর একসঙ্গে কিছু বদভ্যাসের শিকার হন দিনেশ। মদের পাশাপাশি তিনি বাইরের নারীদেরও স্বাদ নিতে শুরু করেন। একসময় এসবের মধ্যে ডুবে গেলে কাজে তার মনোযোগ ছিল না। ফলে তার আর্থিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। তার ফলে দু’বছরের মধ্যে তার আর কিছুই বাকি রইল না। বাড়ি নেই, ব্যবসা নেই। কিন্তু মদের অভ্যাস তখনও টিকে ছিল। বাড়ির অবনতি ও স্বামীর অভ্যাস দেখে ক্লান্ত হয়ে শান্তা তার ভাইয়ের বাড়িতে চলে যায়। শান্তার বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর দীনেশও তারপর শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে হুমকি দিয়ে সেখানে থাকতে শুরু করে। কিন্তু শ্বশুর বাড়িতে গিয়েও তার অভ্যাসের উন্নতি হয়নি। এখানেও তিনি মদ ও নারীদের পিছনে দৌড়াতে থাকেন। সুগনা তার অভ্যাসের সাথে পরিচিত ছিল, তবে সেও বোনের কথা চিন্তা করে খুব বেশি কিছু বলে না। কিন্তু একদিন তার সঙ্গে দীনেশের প্রচণ্ড ঝগড়া হয়। ফলে সুগনা তাকে মারধর করে। মারধরে আহত হয়ে দীনেশ শান্তাকে ছেড়ে চলে যায়। যাবার আগে শান্তার কাছে গিয়ে বলে সে আর ফিরে আসবে না। কিন্তু সে সময় শান্তা তার কথাকে সিরিয়াসলি নেয়নি। তার মনে হয় সন্ধ্যার মধ্যেই দীনেশের রাগ ও নেশা কমে গেলে সে বাড়ি ফিরবে। কিন্তু তা হয়নি। সেদিনের পর দীনেশ আজ পর্যন্ত ফিরে আসেনি। সে কোথায় গেছেন কেউ জানত না। সে বেঁচে আছেন কি না তাও ছিল রহস্য। গত ৮ বছর ধরে বিধবার মতো জীবন কাটাচ্ছিল শান্তা। দীনেশ যখন শান্তাকে ছেড়ে চলে যায় তখন চিন্টুর বয়স ছিল ২ বছর এবং শান্তার বয়স ২৮ বছর।

২৮ বছর বয়সে, শুধুমাত্র শান্তাই জানত যে স্বামী ছাড়া বেঁচে থাকা কেমন। কিভাবে এতদিন বিছানায় কাটিয়েছেন…এটা তার মত একজন মহিলাই বুঝতে পারবে। সে একজন প্রবল ইচ্ছাশক্তি সম্পন্ন মহিলা। কিন্তু গত কয়েকদিন থেকে সে নিজেকে খুবই দুর্বল ভাবতে শুরু করেছে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার নিঃসঙ্গতা এখন তাকে আরো বেশি কষ্ট দিচ্ছিল।

শান্তা তার ভাবনায় এতটাই হারিয়ে গিয়েছিল যে হঠাৎ কারো ডাকে সে চমকে উঠল। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল কাঞ্চন দাঁড়িয়ে আছে। ওর চেহারায় বিভ্রান্তির ছাপ। চোখে মুখে একটা প্রশ্ন আর কিছু বলার জন্য ওর ঠোঁট ছলছল করছে। “কি হয়েছে কাঞ্চন? কোনো সমস্যা? কিছু চাই? এদিকে আয়।” শান্তা একসাথে প্রশ্ন করে।

কাঞ্চন এলো। তারপর বুয়াকে দেখে মৃদু হেসে বললো- “বুয়া, এখন কোথাও যাবে?”

“না, জিজ্ঞেস করছিস কেন? কোনো কাজ ছিল?” খাটের উপর উঠে বসে শান্তা বলল।

“তুমি বলতে না বুয়া …. আমি কখনো বাসায় থাকি না তাই তুমিও কোথাও যেতে পার না। এখন আমি বাসায় আছি… কোথাও যেতে চাইলে যেতে পার।” নিষ্পাপ হয়ে বলল কাঞ্চন।

ওর কথায় শান্তার ঠোঁটে হাসি ফুটল। কাঞ্চনের দিকে আদর করে তাকিয়ে বলল- “না মা, আমি কোথাও যাচ্ছি না। আমি খুব ক্লান্ত তাই বিশ্রাম নিতে চাই। তুই গিয়ে তোর ঘরে বিশ্রাম কর। আমি এখন কোথাও যেতে চাই না।”

শান্তার কথায় কাঞ্চনের মুখে বিষাদ ভেসে উঠল। কাঞ্চনের মুখের দিকে শান্তা তাকিয়ে ছিল কিন্তু এবার শান্তা অন্য চিন্তায় ডুবে আছে তাই সে কাঞ্চনের মুখে বিষাদ দেখতে পেল না। সে আবার খাটের উপর ফিরে শুয়ে পড়ে।

কাঞ্চন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে, তারপর শান্তার দিকে তাকিয়ে বাইরে চলে যায়। বারান্দায় এসে অস্থিরভাবে হাঁটতে লাগল। সেখানে থাকতে থাকতেই চোখ যায় মাটির দেয়ালে ঘড়ির দিকে। ঘড়ির কাঁটা বুকে ঠকঠক করে হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে দিচ্ছিল।

তাকে রবির সাথে দেখা করতে যেতে হবে ৫টায়। সে আজ রবিকে নিজের হাতের বানানো ক্ষীর খাওয়াতে চেয়েছিল। কিন্তু সমস্যা হল শান্তা বাড়ীতে থাকাতে সে ক্ষীর বানাতে পারছে না। শান্তা তাকে ক্ষীর বানাতে দেখলে নানা ধরনের প্রশ্ন করতে শুরু করবে। কিন্তু ক্ষীর তো তাকে তৈরি করতেই হবে। ক্ষীর ছাড়া সে রবির সাথে দেখা করতে যেতে পারে না।

সে বারান্দায় ঘুরতে থাকে। কিছুক্ষণ পর আবার শান্তার ঘরের দরজা পর্যন্ত গেল। ভেতরে তাকাল সে। শান্তা খাটের উপর চোখ বন্ধ করে ঘুমাচ্ছিল। শান্তাকে ঘুমোতে দেখে কাঞ্চনের মনে ভাবনা ভেসে উঠল। সে আস্তে আস্তে শান্তার ঘরের দরজা ঠেলে দিল, তারপর ক্ষীর বানানোর সব উপকরণ বের করে উঠানে এল। অল্প সময়ের মধ্যে চুলা জ্বালিয়ে দেয়। চুলার আগুন ধরে যাওয়ার সময় সে অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সে ঠিক করে ফেলেছিল শান্তা ঘুম থেকে ওঠার আগেই ক্ষীর বানাবে। সে দ্রুত হাত নাড়ছিল। সেই সাথে সে মনে মনে প্রার্থনা করছিল যেন আজ তার বুয়া কুম্ভকর্ণের মত ঘুমায়। ৫ টার আগে যেন চোখ না খুলে।

প্রায় ১ ঘন্টা পরিশ্রমের পর কাঞ্চন ক্ষীর বানায়। তারপর একটা ছোট পাত্রে ক্ষীর রেখে অন্য সব পাত্র ধুতে বসল। যাতে বুয়া জানতে না পারে যে সে ক্ষীর বানিয়েছে।

সব কাজ শেষ করে ঘড়িতে সময় দেখলেন, ৪টা ১৫ মিনিট। শান্তা তখনও নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছিল। উঠানে এসে আকাশের দিকে তাকাল। আকাশের দিকে তাকাতেই তার হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠল। সূর্য আকাশ থেকে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। আর তার জায়গায় কালো মেঘ তাদের চাদর বিছিয়ে দিতে শুরু করেছে।

কাঞ্চনের মন খারাপ হয়ে যায়। রবির সাথে দেখা করতে যেতে তখনো ৪৫ মিনিট বাকি। তার আগে যদি বৃষ্টি শুরু হয়, তাহলে বড় সমস্যা হয়ে যাবে। অসহ্য দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। ক্ষীর বানানোর পর ওর মুখে যে সুখ ছিল তা এখন কেটে গেছে, এখন তার জায়গায় দুঃখের মেঘ ঢালতে শুরু করেছে। কাঞ্চন বিষন্ন মনে বারান্দায় এসে অস্থির হয়ে হাঁটতে থাকে। বারবার চোখ গেল ঘড়ির দিকে। আজ ঘড়ির কাঁটাও যেন আজ থেমে গিয়েছে।

কাঞ্চন আবার উঠানে গেল আবহাওয়ার অবস্থা দেখতে। আকাশের দিকে তাকালে তার মুখ পাতলা হয়ে গেল। আকাশে ঢেউ খেলানো কালো মেঘ আরও ঘন হয়ে উঠেছে। সে ভাবতে থাকে ”এখনই আমার স্যারের সাথে দেখা করতে যাওয়া উচিত….এমন না হয় যে বৃষ্টি শুরু হয়…আর বৃষ্টির শব্দে বুয়া জেগে ওঠে। তখন আমার আর বের হওয়া হবে না। হ্যাঁ এটাই ঠিক হবে।

কাঞ্চন তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে এসে প্রথমে ক্ষীরের বাক্সটা তুলে নিজের উড়নার ভিতর লুকিয়ে রাখল। তারপর শান্তার ঘরের ভিতর তাকাল। শান্তা তখনও ঘুমাচ্ছিল। কাঞ্চন ধীরে ধীরে যেমন ছিল তেমনি দরজা বন্ধ করে উঠোনে প্রবেশ করল। চিন্টু খেলতে বেরিয়েছে। কাঞ্চন আস্তে আস্তে উঠোনের দরজা ঠেলে দ্রুত উপত্যকার দিকে এগিয়ে গেল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই কাঞ্চন সেখানে পৌঁছে গেল যেখানে সে প্রতিদিন রবির সাথে দেখা করত। সে ঝর্নার তীরে অবস্থিত একই পাথরের উপর বসে, যে পাথরের উপর বসে সে প্রতিদিন ঝরে পড়া ঝর্না দেখত। এ সময় তার শরীরে ছিল একই রঙের একটি গোলাপি কুর্তি ও পাইজামা। তার হাতে ক্ষীরের বাক্স।

পাথরের ওপর বসে কাঞ্চন বারবার ফিরে তাকাচ্ছে। সে অধীর আগ্রহে রবির জন্য অপেক্ষা করছিল। বারবার সে ক্ষীরের বাক্সের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে। ভাবছিল রবি তার তৈরি করা ক্ষীর পছন্দ করবে কিনা। ক্ষীর বানানোর পর কাঞ্চন স্বাদ নিয়েছিল। রাতের বেলা বুয়ার নির্দেশে তৈরি করা ক্ষীরের মতো সুস্বাদু হয় নি। তাড়াহুড়ো করে কাঞ্চন ক্ষীর রাতের মতো ভালো বানাতে পারেনি।

ক্ষীরের সাথে সাথে কাঞ্চনকে হয়রান করছিল আরেকটি উদ্বেগ। দ্বিতীয় উদ্বেগটি ছিল আকাশে ঘোরাফেরা করা কালো মেঘ, যা দ্রুত বায়ুমণ্ডলকে গ্রাস করছে, এটিকে একটি ভয়ঙ্কর চেহারা নিয়েছে। প্রবল বাতাস আর আবহাওয়ার পরিবর্তনে কাঞ্চনের ছোট্ট মনটা অস্থির হচ্ছিল।

ঘাড় তুলে আকাশে মেঘের উড্ডয়ন দেখছিল, তখন তার মুখে বৃষ্টির ঘন ফোঁটা পড়ল। তারপর কিছুক্ষণের মধ্যেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়।

কাঞ্চন যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখান থেকে একটু দূরে ফাঁপার মতো একটা বিশাল পাথর। পাথরটি এত বড় ছিল যে এর নীচে কয়েক ডজন লোক বৃষ্টি থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারত। কাঞ্চনের মনে হল সেই পাথরের আড়ালে চলে যাবার, কিন্তু পরের মুহুর্তের চিন্তায় তার পা থেমে গেল যে, স্যার যদি এই সময়ে এসে তাকে দেখতে না পান, পাছে স্যার হতাশ হয়ে ফিরে যান। হয়ত বুঝবে বৃষ্টির কারণে কাঞ্চন আসতে পারেনি। এমতাবস্থায় স্যারের সাথে দেখা হবে না। এই ভেবে কাঞ্চন ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল। পাথরের আশ্রয় নেওয়ার ধারণা ছেড়ে দেয়।

বৃষ্টির ফোঁটা এখন তীব্র হতে শুরু করেছে। কাঞ্চন ক্ষীরের জন্য চিন্তিত ছিল, পাছে বৃষ্টিতে ভিজে তার ক্ষীর ঠান্ডা হয়ে যায়। সে ঘাড় থেকে উড়না খুলে ফেলল এবং ক্ষীরের বাক্সটা শক্ত করে মুড়ে দিতে লাগল। তারপর রাস্তার দিকে একদৃষ্টি রেখে পাথরের উপর বসে পড়ল। সে তার গর্ভে ক্ষীরের বাক্স লুকিয়ে রাখছিল। নিজের ভিজে যাওয়া নিয়ে সে চিন্তিত ছিল না…. সে ক্ষীরের জন্য চিন্তিত। এভাবে ভিজে যাওয়ার কারণে সে যে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে সে চিন্তাও তার ছিল না….. সে চিন্তিত ছিল যে ক্ষীর ভিজে ঠান্ডা হয়ে না যায়…… স্বাদ না নষ্ট হয়ে যায়। স্যার না বলে যে তুমি ক্ষীর বানাতে জান না, কাঞ্চন। এ সময় নিজের চেয়ে ক্ষীর নিয়ে বেশি চিন্তিত। একইভাবে বসে সে বৃষ্টিতে ভিজতে থাকল।

বৃষ্টি এখন পূর্ণ গতিতে পৌঁছেছে। মুষলধারে বৃষ্টি আর সাঁই সাঁই দমকা হাওয়ায় পরিবেশ সঙ্গীতে ভরে ওঠে। কিন্তু বৃষ্টির এই মিউজিক এ সময়ে কাঞ্চনকে মোটেও পছন্দ হচ্ছিল না। বৃষ্টির ঠান্ডা এবং প্রবল বাতাসের কারণে সে মারা যাচ্ছিল। বাতাসের সাথে পানির ছিটা তার শরীরে পড়লে তার মনে হয় কেউ তার শরীরে শত শত সূঁচ দিয়ে বিদ্ধ করেছে। ঠান্ডায় তার শরীর কুঁচকে যাচ্ছিল। সারা শরীরে প্রবল কাঁপুনি। দাঁতগুলো এমনভাবে বাজছিল যেন চোয়াল থেকে বেরিয়ে আসবে।

ঘণ্টাখানেক একই পাথরের ওপর বসে থাকা কাঞ্চন বৃষ্টির প্রহারে ভুগতে থাকে। এক ঘণ্টা পৃথিবী ডুবিয়ে রেখে বৃষ্টি চলে গেল। বৃষ্টি থামতেই কাঞ্চন কাঁপা পায়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর স্যারকে তার চোখে দেখার আশায় সে পথের দিকে তাকাল যেখান থেকে রবি আসবে। কিন্তু দূরে কোথাও রবিকে দেখা যাচ্ছিল না। ব্যথায় তার চোখ ভিজে ওঠে। তার স্যার তখনও আসেননি।

প্রবল বৃষ্টিতে কাক ভেজা, তার ওপর রবির অনুপস্থিতি। যন্ত্রণা কাঞ্চনের গভীরে পৌঁছতে থাকে। সে অনেকক্ষণ ধরে পথ চেয়ে খুঁজতে থাকে। হতাশায় তার মন ভরে উঠছিল। তার মনে হলো তার স্যার আর আসবেন না। এত বৃষ্টিতে এখানে আসার বোকামি সে দেখাবে না। স্যার তার মত পাগল নন যে এমন আবহাওয়ায় তার সাথে দেখা করতে আসবে। কিন্তু অন্য মন বলছিল স্যার অবশ্যই আসবেন। সে আমাকে ভালোবাসে, সে আমাকে এভাবে যন্ত্রণা দিতে পারে না, একটু অপেক্ষা করি সে অবশ্যই আসবে।

ভেজা কাপড়ে আটকে কাঞ্চন আবার সেই একই পাথরের ওপর বসল। হাঁটুতে মাথা রেখে কাঁদে। এই মুহুর্তে তার মনে হলো কেউ যেন তার সব কিছু কেড়ে নিয়েছে…যেন সে পুরোপুরি ছিনতাই হয়ে গেছে… তার মনে হলো সে যেন সমুদ্রের মাঝখানে একা নৌকায় বসে ডুবে যাচ্ছে কিন্তু কেউ তাকে বাঁচাতে আসছে না। কাঞ্চন ঠান্ডায় কাঁপতে থাকে।

 

৩০

কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল। এবার বৃষ্টির আওয়াজ শেষ হয়ে গেল। পাখিরা বাসা থেকে বের হয়ে এদিক ওদিক আনন্দে কিচিরমিচির করতে লাগল। বৃষ্টির পরে, প্রতিটি বস্তু নরম-বিন্দু এবং ধুলোময় দেখা গেছে। বাতাসে সুবাস ছড়িয়ে পড়ল। পরিবেশ এতটাই মনোরম হয়ে উঠেছিল যে, এখানে যে কোনো ক্লান্ত মানুষ এলে এখানকার অপরূপ দৃশ্য দেখে তার সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে যায়।

কিন্তু এসব বিন্দুমাত্র ভাল লাগছে না কাঞ্চনের। প্রকৃতিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পুরো সৌন্দর্যটাই এ সময় তার কাছে বিবর্ণ হয়ে গেছে। পাখির কিচিরমিচির তার কানে বিষ ঢেলে দিচ্ছিল। এখানে সবকিছুই তার ইচ্ছার বিপরীত মনে হয়।

কাঞ্চন হঠাৎ তার পেছনে কারো পায়ের আওয়াজ শুনতে পেল। সে হন্তদন্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল। পিছন ফিরে দেখে রবি আসছে।

রবি তার ট্রাউজার উঁচিয়ে ওর দিকে এগিয়ে আসছে, ভেজা মাটিতে সাবধানে পা বাড়াচ্ছে। তাকে দেখে কাঞ্চনের কান্নার তীব্রতা আরো বেড়ে গেল। তবে এবার আনন্দে।

কাঞ্চন রবিকে দেখে তার দিকে তাকাল যেন সে একটি ছোট মেয়ে। আর কেউ হয়ত তাকে একা ফেলে চলে গেছে ঘন জঙ্গলে। যেখানে সে ভয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা একা একা ভেসে বেড়াচ্ছে। আর এখন রবিকে দেখে ছুটে এসেছে তার আশ্রয়ে।

রবি যখন তাকে তার দিকে আসতে দেখে, সেও হাত ছড়িয়ে দেয়। কাঞ্চনকে বাহুতে আটকে নেয়। সে খেয়ালও করেনি যে তার জামাকাপড় ভিজে গেছে। এই সময়ে রবির জামাকাপড়ও ভিজে যাচ্ছে।

কিন্তু রবি একটু পরেই বুঝতে পারে সে ভিজে গেছে। সে অবাক হয়ে কাঞ্চনের দিকে তাকাল। বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে কাঁদছিল। রবি তার কান্না দেখে ভয় পেয়ে গেল। কাঞ্চনকে কাঁদতে সে সহ্য করতে পারে না। সে কাঞ্চনকে দুহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। ওকে আতঙ্কিত লাগছিল। রবি কিছুক্ষণ কাঁদতে দিল। আর ভাবতে থাকলো কাঞ্চন কাঁদছে কেন? কেমন করে সে ভিজে গেল?

এক হাতে কাঞ্চনকে বুকের কাছে ধরে অন্য হাতে মুখ তুলল। তারপর গালে আদর করতে করতে জিজ্ঞেস করলো – “কি হয়েছে কাঞ্চন? কাঁদছো কেন? ভিজে গেলে কেমন করে?”

“আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম স্যার… কিন্তু আপনি যখন সময়মতো আসেননি, তখন আমি খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।” কাঞ্চন কান্না মাখা গলায় বলল।

“আমি মাত্রই প্রাসাদ থেকে বের হচ্ছিলাম, কাঞ্চন… তখনই বৃষ্টি শুরু হলো। আর আমি সেখানেই থেমে গেলাম।” রবি ওর চোখের জল মুছাতে মুছাতে বলল- “কিন্তু ভিজলে কেমনে? বৃষ্টিতে ভিজতে ভালো লাগে?”

কাঞ্চন অস্বীকারে মাথা নাড়ল, ভেজা চোখে রবির দিকে তাকিয়ে আছে।

“তাহলে ভিজে গেলে কেন? গাছের নিচে গেলে না কেন?” রবি আবার জিজ্ঞেস করল।

“তোমার জন্য…”

“আমার জন্য…? মানে?” অবাক দৃষ্টিতে কাঞ্চনের দিকে তাকাল রবি।

“আমি এখানে অনেক আগেই এসেছি। আমার আসার কিছুক্ষণ পরই বৃষ্টি শুরু হলো। মনে হচ্ছিলো পাথরের নিচে চলে যাই। কিন্তু তুমি এলে, পাছে আমাকে না পেয়ে ফিরে যাও। তাই আমি ওই উঁচু পাথরের উপর বসেছিলাম। তারপর আমি ভিজে….” এই বলে কাঞ্চন রবির দিকে তাকাতে লাগলো।

কাঞ্চনের কথা শুনে রবির মন ভরে গেল। সে অনিয়ন্ত্রিতভাবে কাঞ্চনের প্রেমে পড়ে যায়। জোড়ে কাঞ্চনকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দিয়ে বললো – “কেন ভাবছো আমি তোমার সাথে দেখা না করে চলে যাবো? তোমার কি মনে হয় আমি তোমাকে ভালোবাসি না? আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। তাই এখন একটা জিনিস খেয়াল করো। আমার জন্য কখনো নিজেকে কষ্ট দিও না। এখন তোমার জীবন শুধু তোমার নয়। তুমি নিজেকে কষ্ট দিলে আমি তোমার উপর রাগ করব।” রবি কথা বলে আলগা হাতে ওর একটা গাল আঁচড়ালো।

কাঞ্চন হাসল।

“স্যার…” হাতের বাক্সটা খুলতে খুলতে কাঞ্চন বলল- “আপনার জন্য ক্ষীর এনেছি। নিজের হাতে বানিয়েছি। এখনো গরম আছে স্যার। আমি বাক্সটা ভিজতে দেইনি। ”

ক্ষীরের বাক্সটা খুলে রবিকে দেখাল সে।

রবি অবাক হয়ে কাঞ্চনের দিকে তাকিয়ে থাকে, মাঝে মাঝে ক্ষীরের বাক্সের দিকে তাকায়। ঠাট্টা করে বলা কথাটা কাঞ্চন কতটা মনে রেখেছে সে অবাক হল। এবং তিনি তার জন্য ক্ষীর তৈরি করে প্রবল বৃষ্টিতে ভিজেছে কিন্তু ক্ষীর ভিজতে দেয়নি। সে ভাবতে লাগলো – “কাঞ্চন আমাকে এতটা ভালোবাসে। সে আমার ছোট্ট সুখকে কতটা মনেপ্রাণে সম্মান করে। সে কষ্ট নিজে নেয় যাতে আমার কোনো কষ্ট না হয়।”

এই উপলব্ধি রবির হৃদয়কে ওর প্রতি শ্রদ্ধায় ভরিয়ে দিয়েছিল। কাঞ্চনের মতো কোমল হৃদয়ের অপ্রতিরোধ্য প্রেমময়ী মেয়েকে পেয়ে সে নিজেকে গর্বিত মনে করলো।

“কি হয়েছে স্যার?” রবিকে চুপ করে দেখে কাঞ্চন বলল। কোন এক অজানা আশংকা থেকে তার হৃৎপিণ্ড অনিচ্ছাকৃতভাবে স্পন্দিত হচ্ছিল। “খেয়ে দেখেন স্যার….আমি নিজেই বানিয়েছি।”

রবি হাসল। তারপর কাঞ্চনের হাত থেকে বাক্সটা নিয়ে বলল- “আমি অবশ্যই খাব। ক্ষীর আমার খুব প্রিয়। আর তুমি বানিয়ে দিলে স্বাদ আরোও ভালো হবেই।”

কাঞ্চন মৃদু হেসে মাথা নাড়ল। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে চিন্তায় নার্ভাস হয়ে যাচ্ছিল যে, রবি তার ক্ষীর কেমন পছন্দ করে? সে কৌতহল ভরা রবির দিকে তাকিয়ে ছিল। রবি ক্ষীরের বাক্সে আঙুল ঢুকিয়ে ক্ষীরটা মুখে ভরে দিল। কাঞ্চনের কৌতূহল বেড়ে গেল। সে টাক-টকি দেখতে থাকল। তার হৃৎপিণ্ড এমনভাবে স্পন্দিত হচ্ছিল যে এটি তার পাঁজর ভেঙে বেরিয়ে আসবে।

“উমমম… ওয়াও…!” হেসে উঠল রবি। “আমার ভাগ্য খুলেছে কাঞ্চন, তুমি এত সুস্বাদু ক্ষীর বানাও। আহা….. এখন বিয়ের পর তোর হাতের তৈরি ক্ষীর রোজ খাব।”

কাঞ্চনের মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তার শুকনো মুখের তেজ ফিরে এল। স্যারের মুখ থেকে প্রশংসা পেয়ে গর্বে বুকটা ভরে গেল।

তবে ক্ষীর তেমন সুস্বাদু ছিল না। রবি কাঞ্চনের প্রশংসা করলো শুধু তাকে খুশি করার জন্য। সে চায়নি কাঞ্চনের হৃদয়ে বিন্দুমাত্র আঘাত হোক। না চাইলেও রবি সব ক্ষীর চাটতে থাকে। ক্ষীর খেতে খেতে কাঞ্চন আগ্রহের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল। যে মন কিছুক্ষণ আগে নানা রকম সন্দেহে ভুগছিল, সেই মন এখন সুখের দোলায় চড়ে আকাশের উচ্চতায় ভ্রমণ করছে। এখন আর কিছু নিয়ে চিন্তিত ছিল না। পরিবেশটা আবার মনোরম হল। পাখিদের টুইট এখন পছন্দ করতে শুরু করেছে। প্রকৃতিতে ছড়িয়ে থাকা সৌন্দর্য এখন তার চোখেও ভালো লাগছিল।

“জল.. জল কোথায়?” হঠাৎ রবির কণ্ঠে চমকে উঠল কাঞ্চন। সে তাড়াহুড়ায় হুট করে পানি আনতে ভুলে গেছে। কাঞ্চন ডানে-বাঁয়ে দেখতে লাগল। তার মুখ আবার বিষণ্ণ হয়ে উঠল। রবির বুঝতে বেশি সময় লাগেনা। সে তাড়াতাড়ি বললো “সমস্যা নেই, জল আনো নি ভালো হয়েছে। জল খাওয়ার পর আমার মুখ থেকে ক্ষীরের স্বাদ চলে যেত। যা আমার ভালো লাগে না।” এই বলে রবি একটা গর্তে জমে থাকা বৃষ্টির জলে হাত ধুতে লাগল।

“স্যার, আমি আগামীকাল আবার জলের সাথে আপনার জন্য ক্ষীর বানাবো।” কাঞ্চন বলল।

“না … মোটেও না।” রবি উঠে দাঁড়িয়ে রুমাল দিয়ে মুখটা মুছে দিয়ে বললো- “এখন তোমার ক্ষীর আনতে হবে না। আজকের পর তোমার আমার জন্য কষ্ট করতে হবে না। এখন যা খাওয়াতে চাও, বিয়ের পর আমার বাড়িতে এসে খাইয়ে দিও। এখন তুমি শুধু একটা কাজ করো, আমাকে ভালোবাসো, আমার কাছে এসো, আমার সাথে বসে গল্প করো।” এই বলে রবি দুই হাতে মুখ ভরে নেয়। আর তার চোখের দিকে তাকায়।

কাঞ্চনের চোখও থমকে যায় রবির দিকে। সেও লজ্জায় চোখ বুজে রবির দিকে তাকাতে থাকে। তখন কোথাও একটা প্রবল বজ্রপাত হয় আর কাঞ্চন রবিকে জড়িয়ে ধরে। রবিও তাকে তার শক্ত বাহুতে নেয়।

আবহাওয়া আবারও ঘুরে দাঁড়ায়। কিন্তু এবার প্রচণ্ড গর্জন। আকাশে আবার মেঘ জমতে শুরু করে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়।

রবি দ্রুত কাঞ্চনের সাথে পাথরের দিকে এগিয়ে গেল, যেটি ঝর্নার খুব কাছে এবং বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য একটি ফাঁপা জায়গা ছিল। সেখানে পৌঁছাতে তাদের প্রায় দুই মিনিট লাগে। কিন্তু ততক্ষনের মধ্যেই বৃষ্টির প্রবল ফোঁটা তাদের ভিজিয়ে দিল। কাঞ্চন এমনিতেই ভিজে গিয়েছিল, কিন্তু এখন রবিও প্রায় ভিজে গিয়েছিল।

 

কাল্লুর চোখ ভেজা। বৃষ্টির ফোঁটার কারণে না। এই মুহূর্তে তার হৃদয় যে ব্যথা অনুভব করছিল তাতে তার চোখ ভিজে গেছে।

কাল্লু অনেকক্ষণ ধরে গোপনে কাঞ্চন আর রবিকে দেখছিল। কাঞ্চন যখন একা দাঁড়িয়ে রবির জন্য অপেক্ষা করছিল তখন থেকেই সে সেখানে।

কাঞ্চনকে সেখানে একা অস্থিরভাবে দেখে কাল্লু বুঝল কাঞ্চন ওখানে কারো সাথে দেখা করতে এসেছে। কিন্তু সে কার সাথে দেখা করতে এসেছে তা জানার আগ্রহ তাকে সেখানে দাড় করিয়ে রাখে। গোপনে সব দেখছিল। কাঞ্চন একা বৃষ্টিতে ভিজেনি। সেও ভিজে গেছে। কাঞ্চনের সাথে সাথে তার চোখ থেকেও অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছিল এই ভেবে যে সে ছোটবেলা থেকে যাকে ভালোবেসেছে। যাকে দেখে এখন পর্যন্ত সে বেঁচে আছে, সে অন্য কারো কাছে অকেজো। ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে সে, বৃষ্টিতে ভিজে কাঞ্চনের কান্না, তারপর রবির আগমন, কাঞ্চনকে জড়িয়ে ধরে, তাকে ক্ষীর খাওয়ানো এবং তারপর গুহার ভিতরে যাওয়া। সে নিজের চোখে সব দেখেছে। আর এসব দেখে তার মন ভেঙ্গে কেঁদে উঠল। কিন্তু আজ সে একা কাঁদতে চায়নি। আজ সে এমন একটা কাঁধ খুঁজছিল যার উপর মাথা রেখে কাঁদতে পারে।

সেখান থেকে ভারী পদক্ষেপে ঘুরে দাঁড়াল। সে যখন উপরে উঠল, দেখল নিক্কি তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে মুখে অসংখ্য প্রশ্ন। কাল্লু তাকে দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল। তারপর চোখ নামিয়ে দ্রুত পথে চলে গেল। নিক্কি তাকে চলে যেতে দেখল।

৩১

পাথরের আশ্রয়ে আসতেই রবি ও কাঞ্চন কাপড় থেকে জল মুছতে থাকে। দুজনেই কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ রবির চোখ গেল কাঞ্চনের দিকে। তাকে দেখার সাথে সাথে তার শরীর মৃদু কাঁপতে থাকে। কাঞ্চনের ভেজা কাপড়ের ভিতর থেকে উঁকি দিতেই তার নরম পেট দেখা যাচ্ছিল।

কাঞ্চনের মনোযোগ ওর দিকে ছিল না, সে ঘাড় বেঁকিয়ে চুল থেকে জল ঝাড়তে ব্যস্ত। চুল থেকে জল বের করার জন্য সে বারবার মাথা নাড়ছিল। এতে করে তার উঁচু বুক দোলা খাচ্ছে। রবি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তার সুন্দর পাহাড়ের দিকে। তার শরীরে প্রবল শিহরণ দেখা দিল। কাঞ্চনের উপর থেকে চোখ সরিয়ে বৃষ্টির ফোঁটায় মনোযোগ দেয়। তারপর পাথরের উপর হেলান দিয়ে মাটিতে বসে পড়ল।

কাঞ্চনও কিছুক্ষণের মধ্যে তার কাছে এসে তার পাশে বসল। কাঞ্চনের খুব ঠান্ডা লাগছিল। ঠান্ডায় বারবার কুঁচকে যাচ্ছিল সে।

রবি মনোযোগ দিয়ে ওর দিকে তাকাল, ওকে এই সময় খুব সুন্দর লাগছে। কয়েকটা ভেজা চুল তার মুখে লেগে ছিল, যা তার মুখের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। অপলক কাঞ্চনের দিকে তাকিয়ে রইল।

“কি দেখছেন স্যার?” কাঞ্চন রবিকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে লজ্জা পেয়ে জিজ্ঞেস করলো।

“কাঞ্চন।” রবি ওর সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল। “কেউ বলেছে তুমি কত সুন্দর?”

রবির এই প্রশ্নে কাঞ্চন বিব্রত হয়। যাইহোক, সবাই তার সৌন্দর্যের প্রশংসা করত। কিন্তু রবির মুখ থেকে তার সৌন্দর্যের প্রশংসা শুনে কাঞ্চনের মন লাফিয়ে উঠল। সে রবির মুখ থেকে আরও প্রশংসা শুনতে চাইল। “স্যার, আপনি খুব ভালো, আপনি খুব ভালো কথা বলেন। আমি আপনার মুখ থেকে নিজের সম্পর্কে শুনতে ভালোবাসি। আমার মন চায় আপনি শুধু কথা বলতে থাকুন এবং আমি বসে বসে শুনি।”

“তুমি খুব সুন্দর, কাঞ্চন।” মুখের ওপরে ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে রবি বলল। তারপর একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আরও বলে- “মাঝে মাঝে মনে হয় কাঞ্চন, তোমার সাথে দেখা না হলে আমার কি হতো? কোথায় যেতাম? কেমন হতো আমার জীবন? তোমার দেওয়া ভালোবাসা আমি কখনো ভুলতে পারবো না। তোমার কাছে ঋণী আমি… যে তুমি আমাকে তোমার যোগ্য মনে করেছিলে।”

“আপনি কি বলছেন, স্যার? আমি আপনার কোন উপকার করার যোগ্য নই। আপনার মত একজন সঙ্গী পেয়ে আমি ধন্য।”

“তুমি জানো না কাঞ্চন, তোমায় পেয়ে আমি কী পেলাম। তোমার আগমনে আমার প্রাণ ভরে গেছে, কাঞ্চন। তোমার আগে আমার জীবন ছিল নির্জন মরুভূমির মতো।” আবেগে ভরা কথা বলল রবি।

“স্যার…!” রবির কাঁধে মাথা রেখে কাঞ্চন বললো- “ভালোবাসা, ভালোবাসা, স্নেহ সম্পর্কে আমি তেমন কিছু জানি না, আমি শুধু জানি তুমি আমার পৃথিবী, আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারব না, যদি আমি কখনও ভুল করি, তুমি যা চাও শাস্তি দিও। কিন্তু আমার উপর কখনো রাগ করো না, নইলে মরে যাবো।”

কাঞ্চনকে কোলে জড়িয়ে নিল রবি। কাঞ্চনও বিনা লজ্জায় কোলে পড়ে গেল। রবির কোলে এসে কাঞ্চন সবদিক থেকে নিরাপদ বোধ করত। তার শক্তিশালী অস্ত্রের বৃত্তে এসে সে কিছুতেই ভয় পেল না। সব ভয় থেকে মুক্ত।

কাঞ্চন তার উষ্ণ কোলে চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল। তাদের উভয়ের জন্য, সেই মুহূর্তটি স্থবির হয়ে এসেছিল। তারা নীরব কিন্তু তাদের হৃদস্পন্দন নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। চোখ বন্ধ করে দুজনে একে অপরের গায়ে শুয়ে পড়ল। তারা আর কোন কিছুতেই অবগত ছিল না। সময়ের জ্ঞানও ছিল না তাদেরর। আবহাওয়াও নয়।

প্রায় ১ ঘন্টা কেটে গেল। বৃষ্টির শব্দও থেমে গেছে। অন্ধকার গ্রাস করছিল আলোকে।

কিছুক্ষণ পর রবির চোখ খুলল। সে বাইরে তাকাল। আবহাওয়া পরিষ্কার দেখে আস্তে আস্তে ডাকে কাঞ্চনকে। “কাঞ্চন ওঠো, বাইরে দেখো বৃষ্টি থেমে গেছে। আর সন্ধ্যাও হয়ে গেছে। তুমি বাড়ি যাবে না?”

রবির কন্ঠে কাঞ্চন সতর্ক হল। রবির কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাইরে তাকাল। “হাই রাম! কতক্ষন হলো। বুয়া আমাকে মেরে ফেলবে।” এই বলে কাঞ্চন ক্ষীরের বাক্সটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর রবিকে দেখে বলল। “স্যার, এখন আমাকে যেতে হবে। নইলে বাবা আর বুয়া সত্যিই মন খারাপ করবে।”

“ঠিক আছে। চল চল যাই।” রবি বলে কাঞ্চনের হাত ধরে বেরিয়ে গেল।

রাস্তায় পৌঁছে কাঞ্চন রবির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির পথে রওনা দিল। রবিও বাইকে বসে প্রাসাদের দিকে এগিয়ে গেল।

 

কাল্লু তার বাড়ির দিকে দ্রুত হাঁটছিল। তার হৃৎপিণ্ড বিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। এ সময় তাকে খুব একা মনে হচ্ছিল। আজকের আগে কখনো এত একা লাগেনি তার। কারণ তখন তার সাথে কাঞ্চন থাকতো, স্বপ্ন থাকতো। কিন্তু আজ তার কাছ থেকে সব কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এখন না তার সেই ইচ্ছা ছিল, না সেই স্বপ্ন।

সে প্রথম থেকেই জানত কাঞ্চনের সাথে তার কোন মিল নেই। সে কখনই তার হতে পারেনি… কিন্তু তবুও তার মনে একটা আশা ছিল, যেটা তার জীবনের ভরসা ছিল। কাঞ্চনকে নিজের মনে করে সব ধরনের কল্পনা করত। প্রতিদিন নতুন স্বপ্ন বুনত। নিজের স্বপ্ন আর কল্পনার জোরে দিন কাটাত। কিন্তু এখন কাল্লু আর এমন কিছু ভাবতে পারেনা। কারণ এখন সে জানে কাঞ্চনের হৃদস্পন্দন শোনার অধিকার অন্য কারো। অন্য কারো শক্ত বাহু তার সুন্দর শরীরকে ঘিরে রেখেছে। কে তার ফুলের চেয়ে নরম ঠোঁটে চুমু দিতে পারে, সে ঠোঁট অন্য কারো।

এইসব ভাবনায় হাহাকার করতে করতে কখন যে তার ভাঙা কুঁড়েঘরে পৌঁছে গেল সে নিজেও জানে না। দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে।

তার মা ভাঙ্গা খাটের উপর শুয়ে ছিলেন। বাড়ির সব জায়গায় বৃষ্টির পানি জমে গেছে। জমে থাকা বৃষ্টির জল তখনও তার টালির ছাদ থেকে ফোঁটা ফোঁটা ঝরছে।

কাল্লুর আসার শব্দে তার মা ঘুম থেকে উঠে খাটের উপর বসলেন। কাল্লু ভারী পায়ে হাঁটতে হাঁটতে মায়ের কাছে গেল। তারপর মায়ের পায়ের কাছে ভেজা মাটিতে বসে মায়ের হাঁটুতে মাথা রাখল। তার মা তার বুড়ো এবং দুর্বল আঙ্গুলগুলো তার চুলে নাড়াতে লাগল।

ধাত্রীর চোখ থেকে যেমন পেট লুকিয়ে থাকে না, তেমনি মায়ের সামনে সন্তানের দুঃখও লুকিয়ে থাকে না। কাল্লুর মা এক নজরে জেনে গেল কাল্লুর আজ মন খারাপ। যাইহোক, তিনি কাল্লুর ব্যথা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। কিন্তু তার মনের মধ্যে কাঞ্চনের জন্য যে আকুল আকুতি তা তার অজান্তেই।

“কি হয়েছে কাল্লু? তোর এত মন খারাপ কেন?” মাথার ভেজা চুলে আদর করতে করতে মা জিজ্ঞেস করলেন।

“আমার মন খারাপ না মা। আজ আমি খুব ক্লান্ত। আজ মনে হচ্ছে তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমাই। আমাকে তোমার কোলে নাও না মা।” কাল্লু শত চেষ্টাতেও নিজের মনে দুঃখ গোপন করতে পারল না।

ওর মা বুঝতে পেরেছে। আজ আবার কেউ তার কলিজার টুকরোর হৃদয়ে আঘাত করেছে। আজ আবার কেউ এর দারিদ্র্য নিয়ে মজা করেছে। সে মাথা নিচু করে তার কপালে চুমু দিল। “আমার লাল…..আমি জানি আজ আবার কেউ তোমাকে হয়রানি করেছে। আমার কোলে মাথা রাখো।”

কাল্লু উঠে খাটের উপর শুয়ে পড়ল। তারপর মায়ের কোলে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করল। চোখ বন্ধ করতেই কাঞ্চন আর রবির প্রেমে ভরা মিলন তার সামনে নেচে উঠল.. বুকের মধ্যে একটা ব্যাথা জেগে উঠে চোখ ধাঁধিয়ে গেল, গলা শুকিয়ে গেল যেন সে কয়েক মাস ধরে পিপাসার্ত ছিল। তার শত চেষ্টার পরও চোখ থেকে অশ্রু ঝরতে শুরু করে। তার চোখ থেকে অশ্রু প্রবাহিত হয়ে তার মায়ের বাহু ভিজিয়ে দিতে থাকে।

ছেলের চোখ থেকে অশ্রু প্রবাহ দেখে তার মাও কেঁদে ফেললেন। কিন্তু তাকে সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া সে আর কিছু করতে পারেনি।

কিছুক্ষণ মায়ের কোলে মাথা রেখে চোখের জল ফেলার পর কাল্লুর মনটা একটু ধুকপুক করে উঠল। সে একইভাবে মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পরে।

 

পরবর্তী দিন ১১ টা হবে। নিক্কি তার জিপে বসে প্রাসাদ ছেড়ে চলে গেল। তার দিক ছিল সরপঞ্চের মাঠ। গতকাল থেকে তার হৃদয়-মনে একজনই। ওটা ছিল কাল্লু।

গত সন্ধ্যায় যখন সে কাল্লুর মুখোমুখি হয়, তখন সে তার চোখে এমন ব্যথার প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়, যা তাকে অস্থির করে তুলছিল। যখনই সে চোখ বন্ধ করত, তখনই সে দেখতে পেত কাল্লুর বিষণ্ণ মুখ আর ক্ষতবিক্ষত চোখ।

গতকাল থেকে সে রবি আর কাঞ্চনের কথা ভাবছিল না। যেহেতু দিওয়ান জি তাদের ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত নিতে নিষেধ করেছেন। সে শুধু দিওয়ান জির ফিরে আসার অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু আজ তার কাল্লুর সাথে দেখা করার ইচ্ছা হচ্ছিল। কাল্লুর দুর্দশা সম্পর্কে সে কিছুটা ধারণা করতে পেরেছে। এবং এখন সে তার দুঃখের সাথে নিজের চেহারা মেলাচ্ছিল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই জীপ এবড়োখেবড়ো রাস্তা দিয়ে সরপঞ্চের ক্ষেত পেরিয়ে সেখানে পৌঁছে গেল।

কাল্লুকে দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল। প্রখর রোদে সে খালি শরীরে ভেজা মাঠের মাটি কাটতে ব্যস্ত। আশেপাশের মাঠে একটা লোকও দেখা যাচ্ছিল না। সরপঞ্চ জি সবসময় কাল্লুকে দিয়ে কিছু না কিছু কাজ করিয়ে নিতেন। কাল্লুও কখনো অস্বীকার করেনি। কারন ক্ষেতে কাজ করার পরই তার ঘরের চুলা জ্বলতো। যদিও সরপঞ্চ জির কাছ থেকে খুব কম টাকাই পেত। কিন্তু তা ছাড়া কাল্লুর কাছে আর কোনো উপায়ও ছিল না। অন্য কেউ তাকে কাজ দিত না। গ্রামের অন্যান্য লোকেরা নিজেরাই নিজ নিজ মাঠে কাজ করত। কেবল একজনই আছে সর্দার যার কিছু কাজা করার ছিল। সে অন্য কোন কাজ করতে পারত না, কারণ সে ছিল বোকা। মাকে ছেড়ে গ্রামের বাইরে কাজে যাওয়ার সাহসও তার ছিল না। এ কারণেই বিকেলে মুখিয়া যখনই কোনো কাজের কথা বলত, কোনো প্রশ্ন না করেই সে কাজে লেগে যেত। এ সময়ও তার নির্দেশে কাজে ব্যস্ত। সে ঘামে ঢেকে গেছে। ঘামে ভেজা তার কালো শরীর সূর্যের আলোয় চকচক করছিল।

নিক্কি জীপ থেকে নেমে মাঠের অর্ধেক আঁকাবাঁকা পাহাড়ের ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কাল্লুর কাছে পৌঁছে গেল। কাল্লু তার কাজে এতটাই হারিয়ে গিয়েছিল যে সে নিক্কির আগমনের খবরও টের পায়নি।

নিক্কি তাকে নড়াচড়া করে দেখতে থাকে। কাল্লুর হাত বেলচা দিয়ে তুললে তার শরীর থেকে সমস্ত নেশা দূর হয়ে যেত, বাহু ফুলে চওড়া হয়ে যেত। নিক্কি ছোটবেলা থেকেই মানুষকে কঠোর পরিশ্রম করতে দেখতে পছন্দ করে। কিন্তু এই সময়ে সে খুব অবাক হল যে সে এসেছে ১০ মিনিট হয়ে গেছে, কিন্তু কাল্লু তাকে দেখতে ফিরেও তাকায়নি।

৩২

কাল্লু ঘামে ভিজে বেলচা চালাচ্ছিল। বেলচা দিয়ে দুহাত উপরের দিকে তুলে মাটিতে জোরে মারে। সে মাটিকে এমনভাবে কোপাচ্ছিল যেন সে তার জন্মের জন্য এই মাটিকে ঘৃণা করে।

কিছুক্ষণ নিক্কি ওকে বেলচা চালাতে দেখে তারপর আস্তে আস্তে ডাকল। “কেমন আছো কাল্লু?”

কাল্লু নিক্কির কণ্ঠে চমকে ফিরে তাকায়। নিক্কির দিকে তাকালেই তার চোখ বিস্ময়ে ভরে ওঠে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল- “আপনি?”

নিক্কির চেহারা তার মুখের দিকে স্থির। সে কাল্লুর দিকে মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল। তার চোখ ফুলে গেছে এবং লাল হয়ে গেছে। যেন সারারাত ঘুমায়নি, নাকি গভীর রাত পর্যন্ত কেদেছে। সেই একই যন্ত্রণা এখনো তার চোখে মুখে। যা ছিল গতকাল সন্ধ্যায়। নিক্কি জিজ্ঞেস করলো – “এত রোদে কাজ করছিলে কেন?”

নিক্কির কথায় মৃদু হাসল কাল্লু। তার হাসিতে বিরক্তি ছিল। নিজের অসহায়ত্বে ব্যঙ্গ করে হাসে। “গরীব শ্রমিক যদি রোদ-বৃষ্টির খেয়াল রাখা শুরু করে, তবে তার ঘরের চুলা কখনো জ্বলবে না, নিক্কি জি।” তার কণ্ঠে কাঁপুনি। আরও বলে- “আপনি বলুন? এখানে কিসের জন্য এসেছেন?”

“আমি তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি, তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিল।” নিক্কি উত্তর দিল – “তুমি কি আমার সাথে ওই গাছের নিচে বসতে পারবে? এখানে খুব রোদ, আমি এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারব না।”

“চলুন।” কাল্লু বলল ও বেলচাটা ওখানে মেধের উপর রেখে পাত্রটা হাতে নিয়ে গাছের ছায়ায় চলে এল। তারপর নিক্কিকে জিজ্ঞেস করলো – “বলুন কি বলতে চান?”

“গতকাল ঝর্নার ধারে যখন তোমাকে দেখেছিলাম, তুমি খুব দুঃখ পেয়েছ। তোমার চোখে গভীর যন্ত্রণা দেখেছি। কিন্তু কারণটা জানতে পারিনি। বল তো গতকাল কিসের জন্য মন খারাপ ছিল?” নিক্কি কাল্লুর মুখে চোখ রাখল।

“এটা জেনে আপনি কি করবেন …?” কাল্লু একটা মৃদু হাসি ছেড়ে বললো “দুঃখ আর কষ্ট দরিদ্রের গহনা, নিক্কি জি। এগুলো ছাড়া তাকে বিধবার মতো লাগে।”

“কাল্লু ….. আমি তোমার কষ্ট বুঝতে পারছি। কারণ আজ আমিও একই কষ্ট পাচ্ছি।” কাল্লুর কথায় আবেগে আপ্লুত হয়ে নিক্কি বললো- “তুমি কাঞ্চনকে ভালোবাসো, তাই না?”

কাল্লু হতভম্ব! সে অবাক হয়ে নিক্কির দিকে তাকাল। সে নিক্কির মুখে গভীর দুঃখের মেঘ দেখতে পেল। সেও তার চোখে একই ব্যথা অনুভব করে। যে যন্ত্রণায় সে সারারাত হাহাকার করছিল।

“হ্যাঁ কাল্লু, আমি রবিকে ভালোবাসি। আমি তাকে বিয়ে করতে চাই। কিন্তু সে আমাকে নয় কাঞ্চনকে ভালোবাসে।” কাল্লুর বিভ্রান্তি দূর করে নিক্কি বললো – “আমি গতকালই বুঝতে পরেছি তুমি কাঞ্চনকে ভালোবাসো। কিন্তু আমি তোমার মুখ থেকে শুনতে চেয়েছিলাম। বলো, তুমি কি কাঞ্চনকে ভালোবাসো?”

কাঞ্চনের স্মৃতিতে তার চোখ ভিজে যায়, সকাল থেকেই সে কাঞ্চনের চিন্তায় মগ্ন। কিন্তু এখন নিক্কির আদর পেয়ে তার কষ্ট বেরিয়ে এসেছে। কিছু বলার আগেই তার চোখ থেকে দু ফোঁটা জল বেরিয়ে গালে ছড়িয়ে পড়ল। সে অসহায়ভাবে ঠোঁট কামড়াতে লাগল। নিক্কির দিকে তাকাল সে। নিক্কি তার দিকে তাকিয়ে। কাল্লু নিক্কিকে কিছু বলতে চেয়েছিল কিন্তু মন তাকে সমর্থন করেনি।

“কিছু বলো না কাল্লু, আমি সব বুঝি। তোমার চোখ থেকে অশ্রু বয়ে যাওয়া আমাকে সব বলেছে যা আমি জানতে চাইছি।“ কাল্লুর যন্ত্রণায় নিক্কির নারী হৃদয় গলে গেল। কাল্লুর দুঃখ টের পেয়ে তার চোখও বর্ষিত হলো।

“নিক্কি জি। আমি খুব হতভাগ্য মানুষ, ছোটবেলা থেকে দুঃখ ছাড়া কিছুই পাইনি। যেই আমার সাথে দেখা করেছে, সবাই আমাকে তুচ্ছ করেছে, কেউ আমাকে জড়িয়ে ধরেনি।” কাল্লু স্তব্ধ কন্ঠে বললো- “আজ আমি কাঁদছি শুধু এই জন্য যে আমি ছোটবেলা থেকে যাকে চেয়েছি সে অন্য কাউকে চায়। কিন্তু আজ আমার চোখ কাঁদছে কারণ আজ কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করেছে কেন আমি দুঃখিত। কেউ জানতে চেষ্টা করেছে আমি কি চাই। আমি তখনই আবেগি হই যখন কেউ আমাকে সহানুভূতি দেখায়। আমার সাথে স্নেহপূর্ণভাবে কথা বলে। কারণ আমি এতে অভ্যস্ত নই নিক্কি জি। আমি ছোটবেলা থেকে মানুষের গালাগালি খেয়ে বড় হয়েছি। আমি কারো সহানুভূতি পছন্দ করি না। মানুষের ভালোবাসার কথা আমাকে কাঁদায়। তাই হাত জোড় করে অনুরোধ করছি আমার সাথে এমন কথা বলবেন না যাতে আমার কষ্ট বাড়বে। কাঞ্চনকে ভালোবাসাটা আমার ভুল ছিল। আমি এখন তাকে ভুলে যেতে চাই। আপনিও ভুলে যান কি দেখেছেন, কি দেখেননি।  এই গরীবের প্রতি দয়া করুন এবং আপনার সহানুভূতি থেকে আমাকে দূরে রাখুন।  আমি এটা সহ্য করতে পারি না.. আমি মারা যাব।” কথাটা বলে থেমে গেল কাল্লু।

একটা ছুরি ঢুকে গেল নিক্কির বুকে।  সে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল।  তার মনে হলো কেউ যেন তার বুকে ছুরি দিয়ে তার হৃদয় বিদ্ধ করছে।  “আমার সাথে কি হচ্ছে?” সে বিড়বিড় করে বললো- “এটা কেমন ব্যথা আমার বুকে উঠছে? এটা কাল্লুর ব্যথা নাকি অন্য কিছু?” নিক্কি হাসছে।  সে তার বুকে ঘষতে লাগল।  নিজের ভেতরে কিছু পরিবর্তন অনুভব করে।  সে জানত না তার সাথে কি ঘটছে তবে সে যন্ত্রণার মধ্যে ছিল।

কাল্লুর কান্না থামলে সে নিক্কির দিকে তাকাল।  নিক্কির মুখের দিকে তাকিয়ে তার চোখে বিস্ময়।  নিক্কির চোখে জল ছিল।  “নিক্কি জি আপনি… কাঁদছেন কেন?”

“না কাদছি না, কান্নার মত মনে হলো।” নিক্কি চোখের জল মুছতে মুছতে বললো – “কিন্তু আজকের পর থেকে আর কখনো নিজেকে একা ভাববে না।  আজ থেকে আমি রোজ তোমার সাথে দেখা করবো, তোমার সাথে এভাবে কথা বলবো।  পরে যত খুশি কাঁদো।” বলে নিক্কি চলে যেতে লাগলো।

কাল্লু স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে নিক্কির চলে যাওয়া দেখে।  হঠাৎ নিক্কি ঘুরে  তারপর দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে কাল্লু পর্যন্ত এসে বলল।  – “আমাকে চুমু দাও।”

“হ্যাঁ …!” কাল্লু বলে উঠল।

“তুমি বুঝতে পারছ না নাকি?” নিক্কি চোখ বুলিয়ে নিল।  “আমি চুমু খাওয়ার কথা বলছি।  আমাকে চুমু দাও।”

কাল্লুর মাথা কেঁপে উঠল।  সে বুঝে উঠতে পারল না নিক্কির কি হয়েছে? কাঁপা কাঁপা গলায় বললো- “নিক্কি জি, বেচারা আমাকে নিয়ে মজা করছেন কেন?”

“দেখো, আমি জোকস পছন্দ করি না।  আমি যাই বলছি আমি খুব সিরিয়াসলি বলছি।” নিক্কি গম্ভীর হয়ে বলল।

কাল্লু বোকার মত নিক্কির দিকে তাকিয়ে ছিল।  সে বুঝতে পারছিল না কেন নিক্কি তার প্রতি এত দয়া দেখাচ্ছে।  সে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

“দেখ, আমি তোমার প্রতি কোন মায়া করছি না, আমিও বুঝতে পারছি না যে আমি তোমাকে ভালবাসতে শুরু করেছি।  শুধু এখন আমার তোমাকে চুমু খেতে ইচ্ছে করছে। তাই বলছি। আমাকে চুমু দাও।” নিক্কি চোখ রাঙ্গালো।

কাল্লু তখনও বিভ্রান্ত। নিক্কি এগিয়ে গিয়ে ওর ঘাড় ধরে ওর ঠোঁটে ঠোঁট রাখল।

তার ঠোঁটে দীর্ঘ চুম্বনের পর সে তার থেকে আলাদা হয়ে গেল। তারপর মুচকি হেসে বলল – “এখন কেমন লাগছে?”

কাল্লু কিছু বলল না। সে পাগলের মত নিক্কির দিকে তাকিয়ে ছিল। নিক্কি একটা হাসি দিয়ে সেখান থেকে চলে গেল।

 

৩৩

নিক্কি চলে যাওয়ার পর ১০ মিনিট কেটে গেছে, কিন্তু কাল্লু তখনও একই জায়গায় দাঁড়িয়ে, গভীর চিন্তায়। কিছুক্ষণ আগের ঘটনাটা তার কাছে সিনেমার মত লাগছিল। সে তখনও বিশ্বাস করতে পারছে না। তার কাছে মনে হলো এখানে যা কিছু ঘটেছে তা স্বপ্ন। নিক্কি এখানে এছেসে, তার সাথে আবেগে ভরপুর কথা বলা, তারপর ধনী-গরিব, সাদা-কালো ভেদাভেদ মুছে তার ঠোঁটে চুমু খাওয়া। এই সব তার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল।

হ্যাঁ, এটা তার জন্য সত্যিই একটা স্বপ্ন। যে মানুষটা ছোটবেলা থেকেই মানুষের স্নেহ-ভালোবাসার জন্য আকুল। যাকে মানুষ সর্বদা হাসির পাত্র হিসেবে বিবেচনা করেছে। যাকে বারবার তুচ্ছ তাচ্ছিল্ল করেছে। সে কিভাবে এটাকে বাস্তব হিসেবে মেনে নিতে পারে? তার জন্য এটা কেবল একটি স্বপ্ন।

কাল্লু অবাক হয়ে ভাবল যে আজ পর্যন্ত গ্রামে কাঞ্চন ছাড়া আর কোন মেয়ে তার সাথে এমনভাবে কথা বলে নি। কেন আজ এমন হতভাগ্য ব্যক্তির উপর নিক্কি এত ভালবাসা বর্ষণ করল? তার কালো কুৎসিত চেহারা দেখে গ্রামের সব মেয়ে মুখ ফিরিয়ে নিত, আজ কেন নিক্কি তাকে চুমু দিল?

কাল্লুর কাছে এর কোনো উত্তর ছিল না। কিন্তু এই ভেবে তার চোখ আবার জলে ভরে গেল যে সে সবার বিদ্বেষী নয়। সেও একজন মানুষ, তারও অধিকার আছে কাউকে চাওয়ার, কাউকে ভালোবাসা, কারো স্বপ্ন দেখার। অন্যরা যা করে তা সেও চায় উপভোগ করতে।

কাল্লু ভেজা চোখে নিক্কি যে পথ দিয়ে গিয়েছিল সেই পথেই তাকিয়ে ছিল। আজ তার হৃদয় নিক্কির প্রতি শ্রদ্ধায় ভরে গেল। তার কাছে সে দেবীর চেয়ে কম ছিল না। যার মধ্যে ছিল না সম্পদের অহংকার, না ছিল সৌন্দর্যের অহংকার। কিছুক্ষণ পথের দিকে তাকিয়ে থেকে কাল্লু আবার মাঠে নামে ঘাম ঝরাতে।

 

যখন থেকে নিক্কি কাল্লুর সাথে দেখা করতে এসেছে, তখন থেকেই সে তার কথা ভাবছিল। তার জীবনের কথা জেনে গভীরভাবে মর্মাহত। সে ভাবছিল- এত কষ্ট করেও মানুষ বাঁচে কী করে? ছোটবেলা থেকেই সে একাকিত্বের শিকার। একাকীত্বের যন্ত্রণা কী তা আমি ভালো করেই জানি। শুধু মা বাবার কাছ থেকে দূরে থাকতেই কত দুঃখ পেতাম। নিস্তেজ লাগত জীবন। আর কাল্লু সারা জীবন একাই কাটিয়েছে। বন্ধু নেই, বান্ধবী নেই। তার জীবন কতটা দুঃখজনক। মানুষ কেন তাকে হীনমন্যতা নিয়ে তাকায়? কুৎসিত বলে? সে কি মানুষ নয়? আমি অন্যদের মত তার হৃদয়ে আঘাত করব না। কিন্তু আজ আমার কি হল? ওর কথা শুনে আমার অদ্ভুত লাগতে লাগল। মনে হচ্ছিল কেউ যেন আমার শরীরে ঢুকে মনের তারে জ্বালাতন করছে। আমার কি হয়েছিল কে জানে। কি যে বেদনা জাগে মনে মনে। কেমন যেন একটা অনুভুতি হচ্ছিল, যে স্রোতে বয়ে আমি ওর ঠোটে চুমু খেয়ে বসে আছি। সে কতটা নোংরা ছিল তাও আমি পরোয়া করিনি।

দরজায় হঠাৎ মঙ্গলুর আওয়াজ শুনতে পেলে “বিবিজি”।

নিক্কি চমকে উঠে দরজার দিকে তাকাল। সেখানে মঙ্গলুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে।

“মঙ্গলু কি হয়েছে?” নিক্কি জিজ্ঞেস করল।

“বিবিজি …. খাবারটা এখানে আনবো নাকি নিচে।” মঙ্গলু নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল।

“এখানে নিয়ে এসো।” নিক্কি মঙ্গলুর বলে উঠে বিছানায় বসল।

কিছুক্ষণ পর দুপুরের খাবার দিয়ে মঙ্গল্লু চলে গেল। নিক্কি খুব ক্ষুধার্ত ছিল। সে মন থেকে কাল্লুর সাথে সম্পর্কিত সমস্ত বিষয় সরিয়ে খেতে ব্যস্ত হয়ে গেল।

 

শান্তার পা এগোচ্ছিল সুন্দরীর বাড়ির দিকে। আজ সুন্দরীর সাথে কথা বলার মুডে ছিল। কিছুক্ষণ পর শান্তা সুন্দরীর দরজায় পৌছে তার পা থেমে গেল। সাধারণত গ্রামের মানুষ ঘরের দরজা খোলা রাখলেও সুন্দরী তার ঘরের দরজা সবসময় বন্ধই রাখে।

শান্তা দরজার কড়া নাড়ে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর দরজা খুলে গেল। দরজা খুলে দিল সুন্দরী নিজেই।

“আসো দিদি, আজকে আমাদের বাড়ির পথে কিভাবে?” সুন্দরী তাকে দেখা মাত্রই হেসে বলল।

“বাড়িতে একা থাকতে ভালো লাগছিল না ভাবী। তোমার সাথে একটু দেখা করতে আসলাম। ভেতরে আসবো?” শান্তা দরজায় দাঁড়িয়ে বলল।

“আরে দিদি, কেমন কথা বলছ? ভিতরে আনো… কিসের এতো জিজ্ঞাসা করো? এটা তো তোমারই বাড়ি।” এই বলে সুন্দরী শান্তার হাত ধরে ভিতরে নিয়ে গেল।

শান্তা যেয়ে সোফায় বসল। সে আগেও এ বাড়িতে এসেছে। কিন্তু সেই সময় সুন্দরী মাত্র বউ হয়ে এসেছে এ বাড়িতে। এরপর থেকে সে আর এ বাড়িতে আসেনি।

বাড়ির সাজসজ্জার সমস্ত জিনিসপত্র রেখেছে প্রধানজি। এ বাড়িতে কোনো কিছুর অভাব নেই। শান্তা কিছুক্ষণ ঘরের জাঁকজমকের দিকে তাকিয়ে রইল।

“দিদি তোমার কি হয়েছে?” সুন্দরী তাকে বাধা দেয়।

ওর দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে শান্তা বলল – “কিছু না ভাবী। অযথা বিচলিত হয়ো না। আমি শুধু তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি।”

“তাহলে তোমার কষ্টের কথা বলো দিদি। আমি ওর চিকিৎসা করিয়ে দেব।” রহস্যময় হাসি ছেড়ে বলল সুন্দরী।

“আমার কোন কষ্ট নেই, ভাবী। তোমরা থাকতে আমার কোন সমস্যা হতে পারে।” শান্তা একটা মৃদু হেসে বলল।

“তুমি যদি বলতে না চাও, ঠিক আছে।” সুন্দরী মুচকি হেসে বললো- “কিন্তু আমি তোমাকেও জানি আর তোমার কষ্টগুলোও।”

শান্তা কিছু বলল না। সে শুধু একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিল। তিনি সত্যিই সমস্যায় পড়েছে। সে এখনে শুধু শুধু দেখা করতে আসেনি। তার একাকীত্ব তাকে সুন্দরীর কাছে নিয়ে এসেছে। সে কারো সঙ্গ চেয়েছিল। সে সুন্দরী হোক বা বিরজু। কিন্তু বলতে ভয় পাচ্ছিল। নির্লজ্জভাবে নিজের কষ্ট সুন্দরীর সামনে তুলে ধরতে পারেনা। এটা তো লজ্জার কথা।

“কি ভাবছ দিদি?” তাকে হারিয়ে যেতে দেখে সুন্দরী জিজ্ঞেস করলো- “কিছু একটা কথা বল। তুমি তোমার মনের মধ্যে চলছে বলো দিদি। হয়তো হেল্প করতে পারি” সুন্দরী তার উরুতে হাত রেখে বললো।

শান্তা ভাবতে থাকলো!

“যদি অন্য কারো সমর্থন চাও, আমি তাও করতে পারি। এখনই।” সুন্দরী তার উরুতে চাপ দিয়ে বলে।

শান্তা অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল। সুন্দরীর ঠোঁট দুষ্টুমি করে হাসে। সুন্দরীর কথা আর কাজ দুটোই শান্তার শরীর গরম করতে থাকে।

“আমি সত্যি বলছি। বিরজু এসেছে। রুমের ভিতরে।” সুন্দরী তার কানে ফিসফিস করে বলল। শান্তার সারা শরীরে একটা স্ফুলিঙ্গ বয়ে গেল। বিরজু রুমের ভিতরে আছে বুঝতে পেরে, তার আসার আগে সুন্দরী একটা বন্ধ ঘরে বিরজুর সাথে সেক্স করছিল…..তার শরীরে ধোঁয়া উঠে। নিঃশ্বাস গরম হয়ে দ্রুত চলতে থাকে। চুল্লির মত শরীর গরম হতে লাগল এবং কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হতে লাগল।

“চলো…..” মেজাজ আন্দাজ করে ওর হাত ধরে বললো – “ভিতরে কি হচ্ছে কেউ জানবে না। যতক্ষন চাও, তোমার ইচ্ছা পূরণ করতে থাকো। আমি বাইরে পাহারা দিচ্ছি।”

“না ভাবী … আমি এটা করতে পারবো না।” শান্তা আতঙ্কিত হয়ে তার কব্জি ছাড়ানোর চেষ্টা করে কিন্তু ব্যর্থ হয়। তার হৃৎপিণ্ড দ্রুত স্পন্দিত হচ্ছিল। অসহায়ভাবে শান্তা বললো- “সত্যি বলছি, আমি এটা পারব না। কপালে টিকা দিতে পারবো না, কিন্তু আমি কষ্টে আছি ঠিকই।”

শান্তা বলল কিন্তু তার কথায় সেই দৃঢ়তা ছিল না যা একজন ধার্মিক নারীর মধ্যে থাকে। তার শরীর পুরুষ মিলনের জন্য আকুল হয়ে উঠছিল। সে এখন ছুটে গিয়ে বিরজুর কাছ থেকে তার যন্ত্রণাদায়ক শরীরের তৃষ্ণা মেটাতে চাইছিল। মানুষ কি বলবে এবং কি ভাববে তা ভুলে যেতে থাকে। যে আগুন কয়েকদিন ধরে তার শরীরে ধীরে ধীরে জ্বলছিল, সেই আগুন বিরজুর দেহে আবৃত হয়ে নিভিয়ে দেয়ার বাসনা জাগে।

সুন্দরী শান্তার মুড সম্বন্ধে পুরোপুরি অবগত। শান্তার প্রত্যাখ্যান যে একটা ভান সে বুঝতে পারে। শান্তাকে আর বোঝানোর দরকার মনে হলো না। সে তাকে টেনে ঘরের ভিতরে নিয়ে গেল।

বিরজু ভেতরে বিছানায় শুয়ে ছিল। শান্তাকে ভিতরে আসতে দেখে তার কামুক চোখ আনন্দে জ্বলে উঠল। সেই সাথে শান্তার হৃদপিন্ড জোরে জোরে স্পন্দিত হল। আতঙ্ক আর উত্তেজনায় তার সারা শরীর কাঁপছিল।

“শান্তা, এখন লোকেদের লজ্জা ছাড়তে হবে। এখন দেখা করার পালা। দেখ তোমার রসিয়া কেমন রেডি হয়ে বসে আছে।” সুন্দরী বিরজুকে দেখে ঠোঁটে বাঁকা হাসি দিয়ে বলল। “বিরজু খেয়াল রেখো। খুব দুঃখী বেচারা। আজ তার সব দুঃখ দূর করে দাও। কোনো অভিযোগ যেন না পাই।”

এই বলে সুন্দরী বেরিয়ে গেল। দরজাটা ভিরিয়ে দিল।

শান্তাকে দেখে বিরজু নেশায় ভরে গেল। সে মাতালের মত লাফিয়ে উঠে শান্তার দিকে এগিয়ে গেল।

বিরজুকে তার দিকে এগোতে দেখে শান্তার মনটা কেঁপে উঠল। পা কাঁপতে লাগল। তার মনে হয়েছিল যেন সে তার পায়ের শক্তি হারিয়ে ফেলেছে এবং সে শুধু দোলা দিয়ে নিচে পড়ে যাবে।

বিরজু এগিয়ে গিয়ে শান্তাকে কোমরে জড়িয়ে ধরল। তারপর এক নিমিষেই নিজের কাছে নিয়ে নিল… শান্তার পক্ষে আর পিছিয়ে যাওয়া সম্ভব হল না। তার যৌবনের চেতনা তার মন ত্যাগ করেছিল। শান্তা বিরজুর শরীরে মিশে যেতে থাকে।

বিরজু শান্তাকে শক্ত হাতে তুলে বিছানায় ফেলে দিল। তারপর নিজেই বিছানায় উঠে শান্তার দিকে ঝুকে মুহুর্তে শান্তার ঠোঁট নিজের ঠোটের ভিতরে নিয়ে নেয়। শান্তার গরম নিঃশ্বাস বিরজুর মুখে আঘাত করছিল। আর বিরজু দিওয়ানার মত ঠোঁট চুষতে থাকে। সেই সাথে কোমর ও উরুতে হাত দিয়ে আদর করছিল।

শান্তা প্রায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। বিরজুর অবস্থাও তাই। শান্তার ঠোঁট চুষতে চুষতে ঘাড়ের কাছে এসে জ্বলন্ত ঠোঁটে ওর গলায় চুমু খেতে লাগলো।

“আজ পেয়েছি কাঞ্চন, তুমি জানো না তোমার এই শরীর আমাকে কত নির্ঘুম রাত দিয়েছে। আজ আমি তোমার সমস্ত সুধা পান করব।” এই বলে বিরজু তার ব্লাউজের বোতাম খুলতে লাগল।

শান্তার মনে একটা তীব্র ধাক্কা লাগল। স্তব্ধ হয়ে যে কথাগুলো সে শুনেছে তার কানে এখনো প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। বিরজু তাকে কাঞ্চন বলে সম্বোধন করেছে।

একজন মানুষ যখন কাউকে নিয়ে অতিরিক্ত ভাবতে শুরু করে, তখন সে অন্য কারো নামের জায়গায় তার নাম নেয়। বিরজুও একই ভুল করেছে। শান্তার নামের বদলে কাঞ্চনের নাম নিয়েছে। কথাটা শুনে শান্তার হুঁশ উড়ে গেল।

কিন্তু বিরজু বোধহয় নিজের ভুল বুঝতে পারেনি। ওর আঙ্গুলগুলো দ্রুত শান্তার ব্লাউজের বোতাম খুলছিল। তখন শান্তা হাত দিয়ে বিরজুকে একটা জোরে ধাক্কা দিল। বিরজু সামলাতে না পেরে বিছানা থেকে পড়ে গেল। শান্তা তাড়াহুড়ো করে দাঁড়ালো এবং স্ফুলিঙ্গ বৃষ্টির চোখে মেঝেতে পড়ে থাকা বিরজুর দিকে তাকাতে লাগলো।

বিরজু তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। শান্তার জ্বলন্ত চোখ দেখে ঘাম ঝরছে। কিন্তু হঠাৎ এই পরিবর্তনের কারণ তখনো বুঝতে পারেনি সের। অস্থির ভাষায় বললো- “কে… কি হয়েছে শান্তা?”

“কি চলছে তোমার মনে?” শান্তা রেগে বিরজুর দিকে তাকাল। “তোমার ঠোটে কাঞ্চনের নাম এলো কি করে? কাঞ্চনকে নিয়ে কি কোন খারাপ কিছু ভাবছো?”

“কি বলছ শান্তা?” বিরজু আতঙ্কে থুথু গিলে ফেলল। “কাঞ্চনকে নিয়ে খারাপ ভাববো কেন। ভুল করে কাঞ্চনের নামটা নিশ্চয়ই আমার জিভে চলে এসেছে। কিন্তু সত্যি বলছি, ওর জন্য আমার কোনো খারাপ চিন্তা নেই।”

“এটাই তোমার জন্য উপযুক্ত হবে, বিরজু। কাঞ্চনের কথা ভুলেও ভাববে করবে না।” শান্তা হুমকির সুরে বললো – “এখন আমি চলে যাচ্ছি.. তবে যাওয়ার আগে শেষবারের মতো তোমাকে সতর্ক করে দিই। তুমি কাঞ্চনকে স্পর্শ করারও চেষ্টা করেছ তো তোমার খুব খারাপ মৃত্যু হবে।”

এই বলে শান্তা দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। সুন্দরী তাকে হলের মধ্যে বাধা দেয়। কিন্তু শান্তা কোন উত্তর না দিয়ে সোজা তার বাসায় চলে গেল।

সারাটা পথ সে একই কথা ভাবতে থাকে। তার মন বিশ্বাস করতে প্রস্তুত ছিল না যে কাঞ্চনের নামটি বিরজুর মুখ থেকে দুর্ঘটনাক্রমে বের হয়েছে। নিশ্চয়ই কাঞ্চনের প্রতি তার খারাপ চিন্তা আছে, তাই তার মনের কথা ঠোঁটে চলে এসেছে। শান্তা মনে মনে বলল- এখন আমাকে সতর্ক হতে হবে। পাপীষ্ট কাঞ্চনের সাথে যেন খারাপ কিছু করতে না পারে। কাঞ্চন আমার মেয়ে না হলে কি হবে? চিন্টুর থেকেও বেশি ভালোবেসেছি ওকে। আমি থাকতে কেউ তার দিকে খারাপ দৃষ্টিপাত করার আগেই আমি তার চোখ উপড়ে ফেলব।

এইসব ভাবনায় হাঁটতে হাঁটতে শান্তা পৌঁছে গেল তার দোরগোড়ায়। তারপর বাইরের দরজা দিয়ে ঢুকল উঠানে। কিন্তু উঠোনে আসতেই তার চোখ ছানাবড়া। সে বিশ্বাসই করতে পারছিল না তার চোখ কী দেখছে। অশ্রুসিক্ত চোখে স্বামী দীনেশের দিকে তাকিয়ে ছিল শান্তা। বারান্দায় থাকা বিছানায় কে যেন শুয়ে ছিল। চোখ ছাদের দিকে। শান্তার আগমনের শব্দে তার মনোযোগ ভেঙ্গে গেল। ঘুরে তাকাল। শান্তাকে দেখা মাত্রই খাটের উপর উঠে পড়ল।

শান্তা কাঁপা কাঁপা পায়ে ওর কাছে গিয়ে দাঁড়াল। সে তখনও বিস্ময়ে স্বামীর দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে দেখেও সে তখনও বিশ্বাস করতে পারছে না।

তাকে দেখে দীনেশ হাসল। তার পর বলল “কেমন আছো শান্তা? কোথায় গিয়েছিলে? কবে থেকে তোকে খুঁজছি। সারা বাড়ি ফাঁকা পড়ে আছে, সুগনা দাদা কোথায়। কাঞ্চন আর চিন্টুকেও দেখা যাচ্ছে না। এভাবে চুপ করে আছো কেন? তুমি কিছু বলবে না, দাঁড়িয়েই থাকবে?” দীনেশ একসাথে প্রশ্ন করে।

শান্তা কি বলবে? এমন সময়ে তার রাগ করা উচিত নাকি খুশি প্রকাশ করা উচিত তাও সে বুঝতে পারছিল না।

“আমাকে দেখে খুশি হওনি যে এভাবে চুপ করে আছ?” দীনেশ খাট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল – “আমি জানি আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। আমার পাপ ক্ষমার যোগ্য নয়, তবুও পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও।” দীনেশ শান্তার সামনে হাত গুটিয়ে বসে।

“এটা বলো না।” স্বামীর হাত দুটো ধরে শান্তা বললো- “ভগবানের কৃপায় তুমি ফিরে এসেছো, এটাই আমার জন্য যথেষ্ট। এখন আমার সামনে হাত জোড় করে আমাকে অপরাধী করো না।” বলতে বলতে কেঁদে ফেলে শান্তা।

শান্তা যে তার স্বামীর উপর রাগ করেনি তা নয়। সে ৮বছর একা একা কাটিয়েছে, দিনে একশবার মারা গেছে এবং বেঁচেছে। কিন্তু কিছুক্ষণ আগে বিরজুর কাছে যেয়ে সে যে ভুল করেছিল সেই অপরাধে তার দমবন্ধ হয়ে যায়। কিভাবে সে তার স্বামীকে দোষ দিতে পারে যখন সে নিজেই অপরাধী।

বছরের পর বছর স্বামীর কাছ থেকে বিচ্ছেদের আগুনে তার হৃদয় পুড়ছিল। সে গিয়ে দীনেশের পায়ে প্রণাম করল। দীনেশ ওটা তুলে বুকে জড়িয়ে ধরল। তখন খোলা দরজা দিয়ে কাঞ্চন ঢুকল। দুজনে ওর আওয়াজ থেকে আলাদা হয়ে গেল।

“তুমি চিনতে পেরেছ?” শান্তা মুচকি হেসে কাঞ্চনের দিকে ইশারা করে দীনেশকে বলল- এই কাঞ্চন।

“কি…? কত বড় হয়ে গেছে।” কাঞ্চনকে দেখে দীনেশ শান্তাকে বলল।

কাঞ্চন কাছে এসে অবাক হয়ে দীনেশকে দেখতে লাগল।

“কাঞ্চন, ওকে চিনতে পারছিস? এ তোর ফুফা।” কাঞ্চনকে শান্তা বলল।

কাঞ্চন মনোযোগ দিয়ে দীনেশের দিকে তাকাল। দীনেশকে শেষ দেখেছে যখন তার বয়স ছিল ১২ বছর। দীনেশের বয়স তখন ত্রিশ বছর। এত বছর পরও তার মধ্যে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। একই রঙ, একই উচ্চতা। শুধু মাথার চুল কোথাও কোথাও সাদা হয়ে গেছে।

কাঞ্চন এগিয়ে গিয়ে দীনেশের পা স্পর্শ করল। দীনেশ তাকে আশীর্বাদ করে। তারপর চিন্টুর কথা জিজ্ঞেস করল। তখনও সে স্কুল থেকে ফেরেনি।

“শান্তা, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছ, এখন যদি সুগনা দাদা এসে ক্ষমা করে, তাহলে আমার চিন্তা শেষ হয়ে যাবে।” দীনেশ শান্ত গলায় বলল।

“সে এই সময়ে মাঠে থাকে। সন্ধ্যার মধ্যে ফিরে আসবে।” শান্তা তাকে বলল।

“আমি সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারব না। আমিই তার কাছে যাই এবং তার পা স্পর্শ করি।” দীনেশ বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।

 

পরেরদিন সন্ধ্যা ৭ টা বাজে।

কাঞ্চনের সাথে দেখা করে রবি প্রাসাদে পৌঁছে তার খুশির সীমা রইল না। ভিতরে পা ফেলতেই চোখ পড়ে মায়ের দিকে। সোফায় বসে ঠাকুর সাহেবের সঙ্গে কথা বলছিলেন। দেওয়ান জি এবং নিক্কিও পাশের অন্য সোফায় বসে ছিল। রবিকে দেখে সেও খুশিতে উঠে দাঁড়ালো।

“মা…” বলে রবি এগিয়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরল। “কেমন আছো মা? আসতে কোনো সমস্যা হয়নি তো?”

“আমি ভালো আছি আমার বাচ্চা।” কমলাজী রবির কপালে চুমু দিয়ে বললেন ” কেমন আছিস?”

“আমি ভালো আছি মা।” রবি মুচকি হেসে উত্তর দিল এবং সোফায় তার পাশে বসল।

হলের মধ্যে কিছু আনুষ্ঠানিক কথাবার্তা বলার পর রবি মাকে নিয়ে গেল তার ঘরে।

“এখন বলো কেমন আছো?” সোফায় বসে মাকে জিজ্ঞেস করল রবি।

“আমাকে নিয়ে আর কতদিন চিন্তা করবি?” রবির মা আদর করে ওর মাথায় হাত রাখল। “আমার জন্য একটা বউ নিয়ে আয় যে আমার দেখাশোনা করবে।”

“তুমি যেহেতু এসেই পড়েছ তাহলে তোমার পুত্রবধূর সাথে পরিচয় করিয়ে দিব।” রবি লজ্জা পেয়ে বলল। “তোমার জন্য একটা বউ বেছে নিয়েছি, সে খুব ভালো, তুমি অস্বীকার করতে পারবে না।”

“আমি আপনার ছেলের পছন্দ দেখেছি এবং আমারও পছন্দ হয়েছে।” রবির মা স্নেহভরে বলল, রবির দিকে ভারী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।

“কার কথা বলছো মা?” রবি অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকাল।

“আমি ঠাকুর সাহেবের মেয়ে নিক্কির কথা বলছি, তুই কি অন্য কারো কথা বলছিস?”

“হ্যাঁ মা।” রবি উত্তর দিল – “নিক্কি আমার পছন্দ নয়, আমার পছন্দ অন্য কেউ।”

“ওটা কে?” মা জিজ্ঞেস করে।

“তার নাম কাঞ্চন, সে একটা বসতিতে থাকে, তার বাবা একজন কৃষক, মা নেই, তার এক বুয়া আছে যে একই বাড়িতে থাকে এবং সে কাঞ্চনকে মায়ের মতো লালনপালন করেছে।” রবি এক নিঃশ্বাসে মাকে সব বলে দিল।

“রবি, তুই ঠাকুর সাহেবের মতো পরিবারের লোককে ছেড়ে একজন সাধারণ লাঙলচাষীর সাথে সম্পর্ক করতে চাস, তোর কি হয়েছে? তুই আকাশের দিকে না তাকিয়ে মাটির দিকে তাকাচ্ছিস কেন?” সোফা থেকে উঠে বলল কমলা জি।

“মা, যাকে তুমি সাধারণ লাঙল চাষী বলছো ….. রবিও সোফা থেকে উঠে মার কাছে যেতে যেতে বলল। “মা মানুষ কাজ দিয়ে ছোট হয় না। ভাব দিয়ে হয়। আমার চোখে সেই ছোট যার চিন্তা ছোট। আর তোমার ভাবনা বড়, মা। তাহলে আজ এত ছোট কাজ কেন করছো? তুমি কি চাও? আমি কাঞ্চনকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তা ভঙ্গ করে তার চোখে ছোট হই? রবি মায়ের কাঁধ ধরে গম্ভীর গলায় বলল।

“কিন্তু … বেটা!” কমলা জি কিছু বলতে চাইল। কিন্তু বলার আগেই থেমে গেল।

“মা, তুমি ধনী-গরীব এইসব রাখো আর কাঞ্চনের সাথে একবার দেখা করো, যদি ওকে তোমার পছন্দ না হয়, তবে তুমি যা বলবে তাই করবো।” হেসে বলল রবি।

“ঠিক আছে … .আমি কাল ওর বাসায় যাব। কিন্তু তুই আমার সাথে থাকবি না, ওকে বলবি না যে আমি ওর সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। আমি দেখতে চাই সে আমার সাথে কেমন আচরণ করে।” কমলাজি কড়া গলায় বললেন। সে তখনও রবির সিদ্ধান্তে খুশি ছিল না।

“ধন্যবাদ মা।” রবি খুশি হয়ে বলল – “তুমি যা বলবে তাই করবো। আমি জানি কাঞ্চনকে তোমার খুব ভালো লাগবে।” রবি মাকে জড়িয়ে ধরে।

“তাই, খুব আনন্দ করার দরকার নেই। আমি যদি তাকে পছন্দ না করি তবে আমি তাকে আমার পুত্রবধূ হিসাবে গ্রহণ করব না।” হাসিমুখে বললেন কমলাজী।

মায়ের কথা শুনে রবি হাসল।

 

কাঞ্চন আজ স্কুলে যায়নি। আজকাল পড়ালেখায় মন ছিল না তার। প্রায়শই স্কুলে না যাওয়ার জন্য কোনও না কোনও অজুহাত তৈরি করেত। আজ তার একটা ভালো অজুহাত ছিল। আজ সে তার বুয়াকে বলেছে যে সে আজ স্কুলে যাবে না। কারণ ফুফা জি এসেছে। তার সাথে গল্প করব। শান্তাও ওকে জোরাজুরি করেনি। কাঞ্চনকে দেখে চিন্টু স্কুলেও যায়নি। খেলার জন্য তারও একটা অজুহাত দরকার ছিল। সুগনাও এদিন বাড়িতেই। শুধু দীনেশজিই কোথাও গিয়েছে।

তখন বেলা ১১টা, শান্তা খাবার রান্না করে নদীতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সুগনা ভেতরে বিছানায় শুয়ে। আর কাঞ্চন সকাল থেকেই ঘরের কাজে ব্যস্ত ছিল। শান্তা ওকে ঘরের কাজকর্ম করতে দেখে খুব খুশি হল, কিন্তু চিন্টু খুশি হল না। গত কয়েকদিন ধরেই সে অস্থির। আজ তার সাথে খেলা না করায় মন খারাপ ছিল তার। আগে যখনই কাঞ্চনকে খেলতে বলত, তখনই কাঞ্চন তার সঙ্গে খেলতে শুরু করত। কিন্তু গত কয়েকদিন থেকে কাঞ্চন তার সঙ্গে খেলা বন্ধ করে দিয়েছে। এখন সে একা। সে বুঝতে পারে না কেন দিদি আজকাল আমার সাথে খেলছে না, সে হয় ঘরের কাজ করে বা একা একা নিজের মনে হারিয়ে যায়।

এ সময় কাঞ্চন বারান্দার খোসার ওপর তৈরি মাকড়সার জাল ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করছিল, কাঠের স্টুলের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, চিন্টু এসে তার পাশে দাঁড়ায়। কাঞ্চন তার দিকে তাকালো না।

চিন্টু কিছুক্ষন কাঞ্চনের দিকে তাকিয়ে থেকে তারপর সাহস করে বললো – “আজকে দিদি চলো কাঞ্চা খেলি। কয়দিন তুমি আমার সাথে কাঞ্চা খেলোনি”

কাঞ্চন একবার চিন্টুর দিকে তাকিয়ে বললো- দেখছিস না আমি ঘরের কাজ করছি, তাহলে আমাকে খেলতে বলছিস কেন?

“দিদি, তুমি এখন আমার সাথে খেলো না কেন? আগে তুমি রোজ খেলতে। কখনো ঘরের কাজ করতে না। এখন কেন ঘরের কাজ করো?” অভিযোগ করে চিন্টু।

উত্তরে কাঞ্চন হেসে বললো – “আমি কি সারা জীবন খেলতে থাকবো, ঘরের কাজ কবে শিখবো? এখন তোর সাথে খেলতে পারবো না? অন্য কারো সাথে খেলগে।”

“তুমি এখন আমার সাথে খেলতে চাও না কেন? আমি তোমার সাথে খেলতে পছন্দ করি দিদি, চলো না দিদি।” চিন্টু কাঞ্চনের পা ধরে জোরে কাঁপাতে কাঁপাতে বলল।

চিন্টুর ঝাকানোর কারণে সে হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে থাকে।

“চিন্টু কি করছিস, আমাকে এভাবে নাড়াস না, আমি পড়ে যাব।” কাঞ্চন ঘাবড়ে গিয়ে বলল।

“আমার সাথে খেলো নইলে ফেলে দিবো।” কাঞ্চনের পা নাড়তে নাড়তে আবার বলল চিন্টু

চিন্টুর ঝাকানোতে কাঞ্চন বিড়বিড় করে উঠল, ছটফট করতে করতে পা একদিক থেকে উঠে গেল, পরের মুহূর্তেই কাঞ্চন চিৎপটাং। সোজা মাটিতে।

তাকে পড়ে যেতে দেখে চিন্টুর হুঁশ উড়ে গেল। এটা বুঝতে তার বেশি সময় লাগেনি যে এখন তার মার খাওয়া নিশ্চিত। সে দৌড়ে বাইরে গেল।

কাঞ্চনও পিঠ ঘষতে ঘষতে তাড়াতাড়ি উঠে ঝাড়ু নিয়ে চিন্টুর পিছনে দৌড়ে গেল। চিন্টু বাইরের দরজায় পৌঁছে গেছে। কাঞ্চনও তার একটু পেছনে। চিন্টু দরজা পেরিয়ে ফুড়ুৎ। কাঞ্চন ঝাড়ু দোলাতে দোলাতে আজ তোকে খাইছি বলে দরজায়। আর তখনই হঠাৎ দরজায় হাজির রবির মা। কাঞ্চনের চোখ পড়ল তার দিকে, কমলাজী ঠিক কাঞ্চনের ঝাড়ুর নিশানায় ছিলেন। কাঞ্চন তার হাত থামাতে চাইল… কিন্তু তার হাতের গতি এতটাই দ্রুত ছিল যে সে ঝাড়ু থামাতে পারেনি। বিস্ময়ে কমলার চোখ বড় বড় হয়ে গেল।

Leave a Reply