উপন্যাস পার্ট

কাঁচের প্রাসাদ – (১-১২)

সূচীপত্র || কাঁচের প্রাসাদ – (১৩-২৪)

ঘুট ঘুটে অন্ধকার নেমে এসেছে। রাত কেটে যাচ্ছিল ধীর গতিতে। চারিদিকে নিস্তব্ধতা। হ্যাঁ, মাঝে মাঝে শেয়ালের কান্না আর কুকুরের ঘেউ ঘেউ করে পরিবেশের নিস্তব্ধতা ক্ষণিকের জন্য বিলীন হয়ে যায়।

রাত ১০ টা বাজে। রায়পুরের বাসিন্দারা প্রায় সবাই নিজেদের ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছে। কেউ বা চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছেন। শর্মিলী তার স্বামী সরজুর সাথে তাদের বাড়ির উঠানের খাটে শুয়ে ছিল। তার চোখে থেকে ঘুম হারিয়ে গেছে। সে অন্যদিকে ফিরে শোয়। তাঁর দৃষ্টি স্থির তাঁর বাড়ি থেকে অল্প দূরে অবস্থিত চমৎকার কাঁচের প্রাসাদে, যা ঠাকুর জগৎ সিং তাঁর স্ত্রী রাধা দেবীর মুখরূপে তৈরি করেছেন। অনেকটা শাহজাহান যেমন মমতাজের জন্য তাজমহল তৈরি করেছিলেন। এখানে পার্থক্য শুধু এই যে ঠাকুর সাহেব তার স্ত্রীর জীবদ্দশায় এই কাচের প্রাসাদটি তৈরি করেছেন।

ঠাকুর সাহেব রাধাদেবীকে খুব ভালবাসতেন। বিয়ের দিনই ঠাকুর সাহেব রাধা দেবীকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তিনি তার জন্য একটি প্রাসাদ নির্মাণ করবেন যা মানুষ যুগ যুগ ধরে মনে রাখবে। এবং তিনি তার কথা রেখেছেন। বিয়ের দেড় বছরের মধ্যে ঠাকুর সাহেব তার প্রতিজ্ঞা পূরণ করলেন। এই প্রাসাদটি তৈরি করে রাধা দেবীর কাছে উপস্থাপন করেন। যখন এই প্রাসাদটি সম্পন্ন হয়, তখন মানুষদের চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল। প্রাসাদ দেখে তারা রাধা দেবীর ভাগ্যের প্রতি ঈর্ষাম্বিত হয়।

শর্মিলী প্রতিদিন প্রাসাদের দিকে তাকিয়ে ঠাকুরের হৃদয়ে রাধাদেবীর প্রতি ঠাকুরের অপরিসিম ভালোবাসা অনুমান করে। এখনও তার দৃষ্টি স্থির ছিল প্রাসাদের দিকে। অন্ধকার রাতেও এই প্রাসাদটি তার আভা ছড়াচ্ছে। প্রাসাদের দেয়াল তার বাহ্যিক আলোয় মিটমিট করছিল। আর প্রাসাদের ভিতর থেকে নির্গত আলো প্রাসাদের রংধনু রঙ দিচ্ছিল।

শর্মিলী মুখ ফিরিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা তার স্বামী সরজুর দিকে তাকাল। সে মৃদুস্বরে ডাকল সরজুকে

“ঘুমিয়েছো?”

সরজু তখনও হালকা ঘুমে, হালকা গলায় বলল

“কি?”

“একটা কথা জিজ্ঞেস করি, সত্যি বলবে?” স্বামীর দিকে আদরি দৃস্টিতে তাকিয়ে বলল শর্মিলী। এ সময় তার হৃদয়ে প্রেমের সাগর প্রকম্পিত হয়।

কিন্তু সরজু তার মনোভাব বুঝতে পেরেও সাড়া দেয় না। সারাদিনের ক্লান্তিতে ঘুমানোর চেষ্টা করছিল। নিজের অজান্তেই সে বললো-

“তোমাকে মিথ্যে বলে আমার কি লাভ? আমি সত্যই বলবো।”

“তুমি সোজা কথা বল না কেন?” অসন্তুস্ট স্বরে শর্মিলি বলল। এ সময় স্বামীর মুখ থেকে এমন কথা তিনি আশা করেননি।

“তাহলে সরাসরি জিজ্ঞেস করো না কেন, কি জিজ্ঞেস করতে চাও জিজ্ঞেস করো।”

সে এই সময়ে লড়াই করার মেজাজে ছিল না। শান্ত কন্ঠে বললো – “আমার মৃত্যুর পর আমার স্মৃতিতেও কি কিছু করবে?” শর্মিলীর এই কথাগুলো ছিল ভালোবাসায় নিমজ্জিত। কথায় লুকিয়ে ছিল লাখো ইচ্ছা।

“হ্যাঁ…!” মৃদুস্বরে বলল সরজু।

স্বামীর মুখ থেকে হ্যাঁ শুনে শর্মিলীর মন লাফিয়ে উঠল। মনটা প্রেমের পাক্ষীর মতো উড়তে থাকে। এই হাঁ শুনে সে যে পরিমান সুখ পেয়েছিল তা অনুমান করা কঠিন। এখন যদি এই হ্যা এর বিনিময়ে সারজু তার জীবন চায় তাহলে সে স্বামীর জন্য খুশিতে জীবন বিসর্জন দিয়ে দিত। সে সারজুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল – “কি করবে?”

“মালিকের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নিয়ে তোমার জন্য একটা সুন্দর কবর বানাবো। তারপর যে টাকা থাকবে তা দিয়ে সারা গ্রামে মিষ্টি বিতরণ করবো।”

শর্মিলীর মন মুহুর্তে তিক্ততায় ভরে গেল। চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। স্বামীর মনে নিজের জন্য এমন চিন্তা জেনে তার আত্মা কেঁদে উঠল। সে কাঁদতে কাঁদতে বললো – এই কি পনের বছর তোমার সাথে থাকার পুরস্কার?

শর্মিলীর আজে বাজে কথায় সরজুর ঘুম ছুটে গেল। সে রেগে বলল “আমি মালিকের মত ধনী নই, না তুমি মালকিনের মত সুন্দরী। তাহলে আমার মাথা খাচ্ছ কেন?”

সারজুর তিরস্কারে শর্মিলীর মনটা দমে যায়। কিন্তু কিছু বলার আগেই রাতের নিস্তব্ধতায় প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল এক প্রচণ্ড মহিলার চিৎকার, যা আত্মাকে নাড়া দিয়েছিল। প্রাসাদ থেকে এই চিৎকার এসেছে। শর্মিলীর সাথে সাথে সরজুও তড়িগড়া করে খাট থেকে উঠে পড়ল।

“মালকিন…!” সারজু বিড়বিড় করে খাট থেকে নামল- “মালকিনের মনে হয় আবার স্ট্রোক হয়েছে। আমি রাজবাড়িতে যাচ্ছি।” ধুতি শক্ত করে দ্রুত বলল। তারপর কুর্তা তুলে ছুটল প্রাসাদের পথে।

শর্মিলী তখনও দাঁড়িয়ে থাকা প্রাসাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। তার হৃৎপিণ্ড ধড়ফড় করছিল। ভয়ে তার শরীর কাঁপছিল। তারপর আবার সেই একই হৃদয় বিদারক আর্তনাদ কানে এল।

শর্মিলী কাঁপতে কাঁপতে খাটের উপর শুয়ে পড়ল। প্রাসাদ থেকে নির্গত চিৎকার তাকে তার সমস্ত দুঃখ ভুলিয়ে দিয়েছে। এখন রাধা দেবীর দুঃখ সেই জায়গায় জায়গা করে নিয়েছে। ভাবতে লাগলেন রাধা দেবীর কথা।

রাধা দেবী – কি অদ্ভুত কাকতালীয়। ঠাকুর সাহেব রাধা দেবীর মুখ দেখানোর জন্য যে প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন তার আনন্দ তিনি পাননি। বেচারা যেদিন এই প্রাসাদে এসেছিলেন, সেদিন রাধা দেবী মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। সেদিন এমন কোন ঘটনা ঘটেছিল তা কেউ জানে না। তারপর থেকে তিনি পুরো ২০ বছর ধরে একটি ঘরে তালাবদ্ধ। আর এই ধরনের চিৎকার আসতেই থাকে। তার এমন চিৎকারের কথা সবাই জানে কিন্তু কেন? সেই রাতে প্রাসাদে কি এমন ঘটনা ঘটেছিল যে সে পাগল হয় গেল কেউ জানে না। এটি একটি রহস্য যা আজো সবার কাছে অজানা রয়ে গেছে।

 

সারজু হাঁপাতে হাঁপাতে প্রাসাদে ঢুকে সোজা মালকিনের ঘরের দিকে চলে গেল। মালকিনের ঘরের দরজায় পৌঁছে সে থামল। সেখানে হাভেলীর অন্য চাকরগণও ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে দাঁড়িয়ে ছিল। ভেতরে গিয়ে কী ঘটছে তা দেখার সাহস তাদের কারও ছিল না। সারজু কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তার নিঃশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করে, তারপর কম্পিত হৃদয়ে ভিতরে তাকাল। ভেতরের দৃশ্য দেখে তার চিত্তি-পিত্তি হয়ে গেল। মালকিন লাল চোখে হিংস্র সিংহীর মত ঠাকুর সাহেবের দিকে তাকিয়ে আছে। ঠাকুর সাহেব দাঁড়িয়ে কাঁপতে কাঁপছিলেন। মালকিন ডানে বামে তাকাচ্ছে আর যা কিছু পাচ্ছে তুলে ঠাকুর সাহেবের দিকে ছুঁড়ে মারছেন।

“রাধা …. হুশে আসো রাধা।” মালিক, ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে, ধীরে ধীরে মালকিনের দিকে এগিয়ে গেল। “আমার জান রাধা… আমি তোমার স্বামী জগৎ সিং।”

“মিথ্যা …..” রাধা দেবী চিৎকার করে বলে- “তুমি খুনি….. আমার কাছে এলে আমি তোমাকে মেরে ফেলব। আমি জানি তুমি আমার মেয়েকে মারতে চাও, কিন্তু তার আগেই তোমাকে মেরে ফেলব। ” এই কথা বলার পর সে আবার কিছু খুঁজতে লাগলো… যাতে সে ঠাকুর সাহেবকে ছুড়ে মেরে ফেলতে পারে। কিছু না পেয়ে ভয়ে পিছু হটে। তার হাতে কাপড়ের তৈরি একটি পুতুল ছিল, যাকে সে তার মেয়ে ভেবে বুকে জড়িয়ে রেখেছিল। ঠাকুর সাহেবকে তার দিকে অগ্রসর হতে দেখে তার চোখে ভয় জেগে উঠে। রাধা পুতুলটিকে বাহুতে লুকিয়ে রাখতে লাগল। তারপর কিছু একটার খোঁজে চারিদিকে তাকাতে লাগলো। হঠাৎ তার চোখ জ্বলে উঠল, সে দেখল মাটিতে একটা গ্লাস পড়ে আছে। সে তাড়াতাড়ি গ্লাসটা তুলে বিদ্যুতের বেগে ঠাকুর সাহেবের দিকে মারল। রাধা দেবী গ্লাসটি এত দ্রুত ছুড়ে মেরেছিলেন যে ঠাকুর সাহেব আত্মরক্ষা করতে পারেননি। গ্লাসটা তার কপালে লেগে গেল। সে চিৎকার করে পিছু হটে। তার কপাল থেকে রক্তের ধারা নেমে আসে। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা সরজু তাদের কাছে গিয়ে ঠাকুর সাহেবকে টেনে বাইরে নিয়ে গেল। অন্য চাকররা তড়িঘড়ি করে বাইরে থেকে তাদের মালকিনের ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল।

সরজু ঠাকুর সাহেবকে হলের মধ্যে নিয়ে এসে কপাল থেকে বয়ে যাওয়া রক্ত পরিষ্কার করতে লাগল। অন্যান্য সেবকরাও ওষুধ ও ব্যান্ডেজ নিয়ে ঠাকুর সাহেবের কাছে এসে দাঁড়াল। এসময় দরজা দিয়ে ঢুকলেন দিওয়ান জি। তিনি এসে সরাসরি ঠাকুর সাহেবের পাশে বসলেন। ঠাকুর সাহেবের অবস্থা দেখে তার ঠোঁট কুঁচকে উঠল।

“আপনি মালকিনের ঘরে গেলেন কেন সরকার?” দিওয়ান জি কপালের ক্ষতের দিকে তাকিয়ে বললেন।

“দিওয়ান জি, রাধাকে শেষ দেখেছি এক মাস হয়ে গেছে। ওর মুখ দেখার খুব ইচ্ছে ছিল… আমি সহ্য করতে পারছিলাম না।” ঠাকুর সাহেব ব্যাথায় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন। কপালে আঘাতের কারণে তার ব্যথা হয়নি। তার যন্ত্রণা তার হৃদয়ে আঘাতের কারণে হয়েছিল যা তিনি নিজেই করেছিলেন। নিজের সর্বনাশের জন্য তিনি নিজেই দায়ী ছিলেন। স্ত্রীর আজকের এই অবস্থার জন্য সে নিজেই দায়ী। ঠাকুর সাহেব ছাড়া দিওয়ানজিও এ কথা জানতেন। আর তিনি এটাও জানতেন যে ঠাকুর সাহেব তার স্ত্রী রাধা দেবীকে কতটা ভালোবাসেন। তাই ঠাকুরের দুঃখ-দুর্দশার কথা তাঁর মতো আর কেউ জানত না। ঠাকুর সাহেবের কথায় দিওয়ান জী চুপ হয়ে গেলেন। বলার কোন ভাষা ছিল না তার, শুধু সহানুভূতিশীল চোখে তাকিয়ে রইল।

“দিওয়ান জি… আপনি বোম্বেতে একজন দক্ষ ডাক্তারের কথা বলেছেন, তার কি কোন খবর আছে? কখন আসবেন?” নিজের ক্ষতকে পাত্তা না দিয়ে তিনি দিওয়ান জিকে জিজ্ঞেস করলেন।

আসবে, কয়েকদিনের মধ্যে আসবে। দিওয়ানজি তাকে আশ্বস্ত করলেন।

“এই ডাক্তার কিছু করতে পারবে কি না জানি না। যে আসে, সবাই টাকা খেতে আসে। আজকাল ডাক্তারি  পেশায়ও কোন সততা নেই।” ঠাকুর সাহেব হতাশ হয়ে বললেন।

“আমি এই ডাক্তারকে নিয়ে অনেক আলোচনা শুনেছি। লোকে বলে যে খুব অল্প বয়সে অনেক জ্ঞান অর্জন করেছে। অনেক জটিল কেস সমাধান করেছে। মালকিনের মতো রোগীদের সুস্থ করেছেন। আমার মন বলছে মালিক, আপনার মালকিন সুস্থ হয়ে উঠবে। এর উপর আস্থা রাখুন।”

দেওয়ান জির কথায় ঠাকুর সাহেব একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন তারপর বললেন- “এখন আর কিছুতেই ভরসা নেই, দেওয়ান জি। এখন মনে হচ্ছে আমাদের রাধা কখনো ভালো হবে না। আমরা বাকিটা জীবন এভাবেই কষ্ট করতে থাকব। আমার জীবন। আমার বেঁচে থাকার কোনো আশা নেই… আমি জানি না আমার মৃত্যুর পর রাধার কি হবে।

“বিশ্বাসের চেয়ে বড় কিছু নেই, মালিক। বিশ্বাস রাখুন, মালকিন একদিন ভালো হবে। আর মরার কথাও ভাববেন না… কেন ভুলে গেলেন আপনার মেয়েও আছে।”

ঠাকুর সাহেব দিওয়ান জির দিকে তাকালেন। দেওয়ান জির কথা মলমের মতো কাজ করে। মেয়ের কথা মনে পড়তেই শুকিয়ে যাওয়া মুখটা ফুলে উঠল, দেওয়ান জিকে বললেন- “কেমন আছে আমাদের নিক্কি? দেওয়ান জি। আমার দুর্ভাগ্য যে আমি আমার বাবার দায়িত্বও ঠিকমতো পালন করতে পারিনি। সে কখন আসছে?”

“নিক্কি মা আগামীকাল আসছে। সন্ধ্যার মধ্যে বেটি আপনার সামনে থাকবে।” দিওয়ান জি হাসলেন।

অনেকদিন ঠাকুর সাহেব নিক্কির মুখ দেখেননি। যখন ওর বয়স ৬ বছর, তখন তিনি তার প্রিয় মেয়েকে বোর্ডিংয়ে পাঠিয়েছিলেন। এখানে থাকলে ওর মায়ের অসুস্থতাতে প্রভাবিত হতে পারে তাই। আজ যখন দিওয়ান জি নিক্কির আসার খবর দিলেন, তখন তাঁর মন তাঁর মেয়েকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল। কিন্তু একদিকে যেমন তিনি তার মেয়ের সাথে দেখা করতে উদগ্রিব ছিলেন, অন্যদিকে নিক্কি ওর মায়ের সাথে দেখা হলে ওর মনের কী হবে তা নিয়েও তিনি চিন্তিত ছিলেন। “এখন আপনি বাড়িতে যান, দেওয়ান জি, অনেক রাত হয়ে গেছে।” ঠাকুর সাহেবকে এখন হালকা লাগছে। দিওয়ান জিকে অকারণে বসিয়ে রাখা তিনি উপযুক্ত মনে করলেন না।

“আপনার আদেশ শিরোধার্য।” দিওয়ান জি বললো আর হাত গুটিয়ে উঠে দাঁড়ালো। প্রাসাদের বাম পাশে তার বাড়িটাও ছিল একটু অন্যরকম। বলতে গেলে একটা বাড়ি হলেও ছোট প্রাসাদের চেয়ে কম নয়। এটাও ঠাকুর সাহেবের দয়ার ফল। দিওয়ান জি তার খুব কাছের আর মানুষ ছিলেন। আর তার সব কাজ দেখতেন। ঠাকুর সাহেব তাকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করতেন।

দিওয়ানজী চলে যাবার পর ঠাকুর সাহেব উঠে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন। ঘুম তার চোখ থেকে অনেক দূরে। রাত প্রায় জেগেই কেটে যাচ্ছিল। এটা তার জন্য নতুন কিছু না। জেগে থেকেই তার বেশিরভাগ রাত কেটে যায়। সে সিগার জ্বালিয়ে আরামদায়ক চেয়ারে নিজেকে ছেড়ে দিলেন। তারপর হালকা চুরুটের পাফ নিতে শুরু করলেন। চুরুট হাতে নিয়ে ঠাকুর সাহেব অতীতের গভীরে ডুবে যান। তার অতীতই এখন তার বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম। তিনি প্রায়শই তার অতীত রোমন্থন করেন।

 

নিক্কি গত ২০ মিনিট ধরে রায়পুরের রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে। রাগে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। দেওয়ান জি ড্রাইভারকে পাঠিয়েছে নিক্কিকে তুলতে কিন্তু তার কোনো খবরই নেই। রাগে প্ল্যাটফর্মে হাঁটছিল নিক্কি।

নিক্কি একটি গোলাপি রঙের ফ্রক পরা। তার চোখে সানগ্লাস আর মাথায় সান টুপি। ফ্রকটা এতই ছোট যে অর্ধেক উরু উন্মুক্ত। প্ল্যাটফর্মের লোকেরা তার সুন্দর উরু এবং ফুলে যাওয়া বুকের দিকে লোভের দৃস্টিতে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ একটা বাইকের এক্সিলারেটরের বিকট শব্দ তার কানে আসে। আওয়াজটা এতটাই জোরে ছিল যে নিক্কির রাগ সপ্তম আকাশে পৌঁছে যায়। নিক্কি চোখ ফেরাল। সামনে বাইকে বসা এক সুদর্শন যুবক বাইকের কান মোচড়াতে ব্যস্ত। যতক্ষণ তিনি অক্সলেটার ঘোরায়, বাইকটি স্টার্ট থাকে, অক্সলেটার ছেড়ে দেওয়ার সাথে সাথে বাইকটি উন্মত্তভাবে থেমে যায়। সে আবার লাথি মেরে… অক্সলেটার নিয়ে বাইক স্টার্ট দেয়। সে ঘামে ভিজে গেছে। নিক্কি ৫ মিনিট ধরে তার এই ভন ভন শুনতে থাকে। শেষ পর্যন্ত তার ধৈর্য্যের বাধ ভাঙ্গে। যুবকটির দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো- “হ্যালো মিস্টার, আপনার এই রদ্ধি মালাটাকে লাথি মারামারি বন্ধ করুন অথবা দূরে কোথাও নিয়ে গিয়ে শুরু করুন। এর বিকট শব্দে আমার কানের পর্দা ফেটে যাচ্ছে।”

বাইক স্টার্ট না হওয়ায় যুবকটিও সমানভাবে বিরক্ত, তারমধ্যে তাকে এমন বকাবকি, তার বাইকের এমন অপমান… সে সহ্য করতে পারেনা। রাগে কিছু একটা বলার জন্য ধাই করে ঘুরতেই নিক্কির দিকে চোখ পড়তেই সে হতভম্ব হয়ে গেল। এক অপরূপ সৌন্দর্যকে সামনে দেখে তার রাগ ক্ষণিকের মধ্যে উবে গেল। তারপর বললো- “আপনি আমার বাইককে বলছেন? এই বাইকে বসে কত রেস জিতেছি, আপনি জানেন?”

“রেস…? আর সেটাও এই বাইক দিয়ে? এটা চলে! স্টার্ট হয় কিনা সন্দেহ আছে।” সে ব্যঙ্গ করে হাসল।

যুবকটি খুব রেগে গেল কিন্তু আবার মন খারাপ হয়ে গেল। সে অদ্ভুত চোখে বাইকের দিকে তাকালো তারপর একটা হার্ড কিক মারলো। এবারও বাইক স্টার্ট হয়নি। সে বারবার চেষ্টা করতে থাকে এবং অক্সলেটারের আওয়াজে নিক্কিকে হয়রানি করতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিক্কির ড্রাইভার একটা জিপ নিয়ে এসে হাজির। ড্রাইভার জিপ থেকে নেমে নিক্কির কাছে এল।

“এত সময় লাগলো কেন আসতে?” ড্রাইভারকে দেখেই নিক্কি চোটপাট শুরু করে।

“ভুল হয়েছে ছোট মালকিন … হয়েছে কি … আসলে …” ড্রাইভার বলতে শুরু করে

“চুপ কর।” নিক্কি রেগে চিৎকার করে উঠল।

ড্রাইভার স্তব্ধ হয়ে গেল। তার চোখ মাটিতে।

“অন্য কেউ কি লাগেজ নিতে আসবে?” ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবার জ্বলে উঠল নিক্কি। চালক অ্যাকশনে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং লাগেজ তুলে জিপে রাখতে শুরু করে।

নিক্কির চোখ গেল ওই বাইক নিয়ে যুবকের দিকে। সে এখানে তাকিয়ে আছে। তাকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে নিক্কি আবারও ব্যঙ্গাত্মক একটা হাসি দিয়ে তার জিপের দিকে এগিয়ে গেল। হঠাৎ যা ঘটল যা নিক্কি কল্পনাও করেনি। যুবকটি বাইক স্টার্ট দিল। নিক্কি যুবকের দিকে তাকাল। এবার যুবকের হাসির পালা। সে বাইকে বসল এবং নিক্কিকে দেখে মাথায় একটা ধাক্কা দিয়ে হুইসেল দিয়ে বাইকটা সজোরে ছুটিয়ে দিল। নিক্কি কিছুক্ষন বোকা হয়ে তাকিয়ে থাকে সেদিকে।

ড্রাইভার আগেই লাগেজ উঠিয়ে দিয়েছে জিপে। নিক্কি স্টিয়ারিং সিটে উঠে বসল। চাবি ঘুরিয়ে গিয়ার বদলে ফুল স্পিডে জিপ ছেড়ে দিল।

“ছোট মালকিন…!” চিৎকার করে জীপের পিছনে দৌড়াতে থাকে ড্রাইভার।

নিক্কি পাহাড়ি রাস্তায় জিপ দ্রুত চালিয়ে যাচ্ছিল। কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পর একটা বাইক নিয়ে এক যুবককে দেখতে পায়। সে জিপের গতি বাড়িয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে তার সমানে পৌঁছে গেল। তারপর ওর দিকে তাকিয়ে বলল- “হ্যালো মিস্টার”।

যুবকটি নিক্কির দিকে তাকাল, সে কিছু একটা বলার কথা ভাবছিল আর নিক্কি নিমিষেই জীপটিকে দ্রুত গতিতে সামনে নিয়ে গেল। যুবকটি রাগে নিক্কির দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখ জ্বলে উঠে, সে অক্সিলেটরে হাত রেখে ফুল স্পিডে বাইক ছেড়ে দিল। কিছুদূর যেতইই কিছু মেয়েকে রাস্তা পার হতে দেখে দ্রুত ব্রেক কষে। কিন্তু তার গতি ছিল খুব বেশি, বাইকটি পিছলে সরাসরি একটি পাথরে ধাক্কা মারে। যুবক ছিটকে দূরে পড়ে গেল। তার বাইকের সাথে বাঁধা স্যুটকেস খুলে সব জামাকাপড় এদিক ওদিক রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ে। আর এসব ঘটে গেল মুহুর্তের মধ্যে। একটু হুশে আসলে একটা মেয়ের হাসির শব্দ কানে এল। ফিরে তাকিয়ে দেখে সালোয়ার কুর্তা পরা এক গ্রামের মেয়ে হো হো করে হাসছে। তার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা তার সখিরাও হাসছে। ওই সব মেয়ের হাতেই বই ছিল, যুবকের বুঝতে বেশি সময় লাগেনি যে এই মেয়েরা পাশের গ্রামের এবং এই সময়ে কলেজ থেকে ফিরছে।

“এই দেখ, কাঠের উল্লু” মেয়েটি হেসে হেসে সখিদের বলল।

যুবকের চোখ তার দিকে স্থির। সে দেখতে খুবই সুন্দরী। গরমের কারণে তার মুখ ঘামছে। ঘামে ভেজা তার ফর্সা মুখ পূর্ণিমার রাতে চাঁদের মতো সূর্যের আলোয় জ্বলজ্বল করছিল। তার দুপাট্টা গলায় ঝুলিয়ে পিছন দিকে দুলছিল। সম্মুখে তার পুরুস্ট স্তন যুগল পাহাড়ের চূড়ার মত টানটান হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। পেট চ্যাপ্টা, কোমর পাতলা কিন্তু নিতম্ব চওড়া এবং ভারী গোলাকার। জামাকাপড় লুকাতে পারছিল না তার মাতাল করা সুগঠিত শরীর। যুবকটি কয়েক মুহূর্তের জন্য তার সৌন্দর্যে হারিয়ে গেল। সে ভুলে গেছে যে এই মেয়েটি তাকে কিছুক্ষণ আগে কাঠের উল্লু বলেছে। এমনকি খেয়ালও নেই যে তার বাইকটি রাস্তায় পড়ে গেছে এবং প্রবল বাতাসে তার জামা কাপড় রাস্তায় ছিটকে পড়ছে।

কিন্তু মেয়েরা তার অবস্থা দেখে আআর হেসে উঠল। হাসি শুনে তার চেতনা ফিরে এল। সে ভ্রু তুলে মেয়েটির দিকে তাকালেন যে তাকে কাঠের উল্লু বলেছে। “কি বললে? আবার বল।”

“কাঠের উল্লু।” মেয়েটি আবার বলে আবার হাসল।

“আমাকে কি তোমার কাঠের উল্লু মনে হচ্ছে?” যুবকটি রাগ আর অপমানিত গলায় বলল।

“আর না হলে তো কি …. তোমার মুখের দিকে তাকাও, তোমাকে শক্ত কাঠের পেঁচার মতো লাগছে।” তার সাথে তার সখিরাও হাসতে লাগল।

যুবকটি অপমানে অপমানিত হয়ে কিছু বলার জন্য মুখ খুলল, কিন্তু ঠোঁটে কোন রা বের হল না। সে তার অবস্থার কথা বুঝতে পেরেছে, সে আর কথা বাড়িয়ে মেয়েদের কাছে নিজেকে আরো অপদস্ত হতে চায়নি। সে ঘুরে তার জামা কাপড় স্যুটকেসে ভরতে লাগল। মেয়েরা হাসতে হাসতে এগিয়ে গেল।

 

নিক্কি প্রাসাদে পৌঁছতেই দেখে ঠাকুর সাহেব বাইরে অপেক্ষা করছে। দিওয়ান জিও সঙ্গে ছিলেন। জীপ থেকে নেমে দিওয়ান জি নিক্কির কাছে এসে বললেন, “এসো বেটি। কতদিন ধরে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে মালিক।”

নিক্কি ঠাকুর সাহেবকে হাত জোড় করে প্রণাম করল তারপর ঠাকুর সাহেবের কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল। ঠাকুর সাহেব ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে। বছরের পর বছর ধরে ধুঁকতে থাকা তার হৃদয় আজ ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে তিনি এ সময় তার সব দুঃখ ভুলে গেছেন। সে নিক্কির কপালে চুমু খেয়ে বললো- “নিক্কি, তোমার যাত্রা কেমন ছিল? এখানে আসতে কোনো সমস্যা হয়েছিল?”

“ওরে বাবা, আমি কি বাচ্চা যে আমার কষ্ট হবে?” নিক্কি এমনভাবে বলল যে ওর কথা শুনে ঠাকুর সাহেব ও দিওয়ান স্যার হেসে ফেলেন।

“নিক্কি মা, ড্রাইভার তোমার সাথে আসেনি, সে কোথায় গেল?” নিক্কিকে একা দেখে দেওয়ান জি বললেন।

“আমি তাকে সেখানেই রেখে এসেছি। সে আমাকে পুরো ২০ মিনিট অপেক্ষা করতে বাধ্য করেছে। এখন তার কিছু শাস্তি হওয়া উচিত তাই না?” দেওয়ান জি নিক্কির কথায় হেসে উঠলেন, ঠাকুর সাহেবের মুখেও তার মেয়ের দুষ্টুমিতে হাসি দেখা গেল।

 

ঠাকুর সাহেব নিক্কিকে নিয়ে প্রাসাদের ভিতরে প্রবেশ করলেন। ওকে দেখতে বাড়ির সব চাকর-বাকর ওর হুকুম পালন করতে ওর ডানে-বামে চলে আসলো।

ঠাকুর সাহেব নিক্কিকে নিয়ে হলঘরে বসলেন। দিওয়ান জিও পাশে বসলেন।

“আজ তোমাকে আমাদের সাথে পেয়ে আমরা খুব খুশি, বেটি” ঠাকুর সাহেব আবেগে আপ্লুত হয়ে বললেন।

“বাবা তোমার সাথে দেখা করার আমারও খুব পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। আর কখন তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না।” নিক্কি ওনার কাঁধে মাথা রেখে বলল।

“হ্যাঁ বেটি, তোমাকে আর কোথাও যেতে হবে না। এখন তুমি সবসময় আমাদের সাথে থাকবে।”

ঠাকুর সাহেবের কথা মাত্রই শেষ হয়েছে তখন প্রাসাদের দরজা দিয়া এক অপরিচিত লোক প্রবেশ করে। তার হাতে একটি স্যুটকেস। চুলগুলো বিক্ষিপ্ত এবং দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তি তার চোখে মুখে ফুটে উঠেছে।

নিক্কির চোখ যুবকের দিকে পড়তেই হতভম্ব হয়ে গেল। এ সেই যুবক যার সাথে সে রেলস্টেশনে জড়িয়ে পড়েছিল। তাকে দেখে দিওয়ান জি উঠে দাঁড়ালেন। যুবকটি ভেতরে আসতেই হাত জোড় করে অভিবাদন জানায়।

“আসুন ডঃ বাবু। আপনার অপেক্ষায় ছিলাম।” দিওয়ান জি ওই যুবকের সঙ্গে করমর্দন করে বললেন। তারপর ঠাকুর সাহেবের দিকে ফিরে বললেন- “মালিক, ইনি রবিবাবু। তার কথাই আপনাকে বলেছি।”

ঠাকুর সাহেব ডাক্তার স্যারের পরিচয় পাওয়ার সাথে সাথে নিজের জায়গা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর তার সাথে করমর্দন করে বললো- “এখানে পৌছাতে তোমার কি কোন সমস্যা হয়েছে?”

“তেমন কিছু না ঠাকুর সাহেব …..” নিক্কির দিকে তাকিয়ে বলল সে।

“আপনি নিশ্চয়ই ক্লান্ত। আগে গিয়ে বিশ্রাম নিন। সন্ধ্যায় দেখা হবে।” ঠাকুর সাহেব রবিকে বললেন।

“ধন্যবাদ…!”

“আসুন, আমি আপনাকে আপনার ঘরে নিয়ে যাচ্ছি।” দিওয়ান জি রবিকে বললেন।

রবি ঠাকুর সাহেবকে আবার সালাম জানিয়ে দিওয়ান স্যারকে নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন। তার রুম ছিল উপরের তলায়। সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই বাঁ দিকে একটা গ্যালারি দেখা গেল। ওই পাশে চারটি কক্ষ ছিল। প্রথম রুম দেওয়া হল রবির থাকার জন্য।

রবি দিওয়ান জিকে নিয়ে তার ঘরে প্রবেশ করল। ঘরের সাজসজ্জা আর কাঁচের খোদাই দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল রবি। এমনিতেই প্রাসাদের ভিতরে পা রাখার পর থেকেই সে নিজেকে স্বর্গে পৌঁছেছেন বলে অনুভব করছিল। প্রাসাদের সৌন্দর্য ওকে বিমোহিত করে ফেলেছে।

“যদি আপনার কখনও কিছু প্রয়োজন হয় তবে নির্দ্বিধায় বলবেন।” হঠাৎ দিওয়ান জির কথায় সে চমকে উঠে। মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। কিছু আনুষ্ঠানিক আলাপ-আলোচনা করে দিওয়ান জি সেখান থেকে চলে গেলেন।

 

নিক্কি তখনও হলের মধ্যে বসে তার বাবা ঠাকুর জগৎ সিং-এর সঙ্গে কথা বলছিল। চাকরেরা ডানে-বামে দাঁড়িয়ে নিক্কির কথা শুনছিল। নিক্কির কথায় ঠাকুর সাহেবের ঠোঁটে বারবার হাসি ফুটে উঠে।

“ব্যাস … .ব্যাস….ব্যাস বেটি নিক্কি, বাকি গল্পগুলো পরে বলো। এখন বিশ্রাম নাও। তুমি অনেক দূরের যাত্রা থেকে এসেছো এবং নিশ্চয়ই ক্লান্ত হয়ে গেছো।” ঠাকুর সাহেব নিক্কিকে থামাতে চেস্টা করে।

“ঠিক আছে বাবা, তবে কাউকে পাঠিয়ে কাঞ্চনকে ডেকে পাঠিও। ওর সাথে দেখা করার খুব ইচ্ছে।” নিক্কি এ কথা বলে নিজের রুমের দিকে চলে গেল। সিঁড়ি বেয়ে ডানদিকের গ্যালারিতে তার ঘর। সে রুমে পৌঁছে গেল। নিক্কি সত্যিই ক্লান্ত বোধ করছিল, ভাবল গোসল করা দরকার। নিক্কি বাথরুমে ঢুকল। জামাকাপড় খুলে ঝরনার নিচে চলে গেল। শাওয়ার থেকে গড়িয়ে পড়া ঠাণ্ডা পানি ওর শরীরে পড়লে সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। অনেকক্ষন নিজেকে ঘষতে থাকে আর শাওয়ার উপভোগ করতে থাকে। তারপর বাইরে এসে পোশাক পরে কাঞ্চনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।

কাঞ্চন তার ছোটবেলার বন্ধু। কাঞ্চন ছাড়া নিক্কির কোনো বন্ধু ছিল না। নিক্কি ছোটবেলা থেকেই খুব অহংকারী এবং জেদী ছিল। তবে কুঁড়েঘরে থাকা কাঞ্চন তার প্রিয় ছিল। উভয়ের মধ্যে ছিল জমিন-আকাশের পার্থক্য। কিন্তু দুজনের মধ্যে একটা জিনিস মিল ছিল। দুজনেই মায়ের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত, সম্ভবত এটাই ছিল তাদের গভীর বন্ধুত্বের রহস্য। যে কোনো মুহূর্তে প্রাসাদে প্রবেশের স্বাধীনতা ছিল কাঞ্চনের। কেউ বাধা দিলে নিক্কি চিৎকার করে প্রাসাদ মাথায় তুলে নিত। ঠাকুর সাহেবও কখনো ভুল করে কাঞ্চনের মনে আঘাত দিতেন না। এত বছর কাঞ্চনের কাছ থেকে দূরে থাকার পরও নিক্কি তাকে ভুলতে পারেনি। নিক্কি শহর থেকে কাঞ্চনের জন্য অনেক কাপড় এনেছিল, নিক্কি সেই কাপড়ের প্যাকেট বের করে কাঞ্চনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।

 

রবি গত ৩০ মিনিট ধরে তার ঘরে বসে ছিল সেই চাকরের জন্য যাকে সে তার কাপড় ইস্ত্রি করতে দিয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনায় তার কাপড়ের ইস্ত্রি নষ্ট হয়ে গেছে। যেই পোশাকে প্রাসাদে এসেছে এখন পর্যন্ত সে একই পোশাক পরে আছে। সে পেঁচার মতো চেয়ারে বসে দরজার দিকে তাকিয়ে ছিল।

 

“ঠক ..ঠক …!” হঠাৎ দরজায় কে যেন টোকা দিল। নিক্কি উঠে দরজার কাছে গেল। দরজা খুলতেই সামনে সালোয়ার কামিজ পরা এক সুন্দরী মেয়ে হাসছে। তাকে দেখেই নিক্কির চোখ চকচক করে উঠল। সে ছিল কাঞ্চন। নিক্কি ওর হাত ধরে ঘরের ভিতরে টেনে নিয়ে গেল। তারপর শক্তকরে জড়িয়ে ধরল। দুজনের আলিঙ্গন এত গভীর ছিল যে দুজনেই একে অপরের মধ্যে চাপা পড়ে গেল। এ সময় নিক্কির পড়নে নীল জিন্স এবং সবুজ টি-শার্ট। কাঞ্চন ওকে দেখেই মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। “নিক্কি তুই কত বদলে গেছিস। এই পোশাকে তোকে খুব সুন্দর লাগছে।”

“আমার জান… তুই চিন্তা করিস কেন। আমি তোর জন্যও এই রকমের পোশাক নিয়ে এসেছি। ওই জামাগুলো পরলে তোকেও আমার মতো হট লাগবে।” ওকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলল নিক্কি।

“আমি আর এরকম জামা? না বাবা না….! আমি এমন পোশাক পরতে পারবো না।” কাঞ্চন আতঙ্কিত হয়ে বললো – “এই জামা পরলে সারা গ্রামে আমার কুখ্যাতি হবে। আর যদি সম্ভব হয়, তুইও এই জামাকাপড় পরা বন্ধ কর, অন্তত যতদিন তুই এখানে আছিস।”

“কেউ কিছু বলবে না, তুই এটা পরবি। আর তুই আমার চিন্তা ছেড়ে দে… আমি এখন থেকে এখানে থাকব এবং এই রকম পোশাকই পরব।” নিক্কি হেসে উঠল।

“তুই এখানে চিরকাল থাকতে পারবি না, সবসময় এমন পোশাক পরতেও পারবি না।” কাঞ্চন মুচকি হেসে বললো- “আমার জান, তুই তো মেয়ে, একদিন তোকে বিয়ে করে তোর শ্বশুর বাড়িতে যেতে হবে। তারপর তার পছন্দের পোশাক পরতে হবে।”

কাঞ্চনের কথা শুনে হঠাৎ রবির মুখ ভেসে উঠল নিক্কির চোখের সামনে। বললো- “আজকে পথে একটা মজার এক্সিডেন্ট হয়েছে জানিস?”

“দুর্ঘটনা? কি দুর্ঘটনা?” কাঞ্চনের মুখ থেকে আতঙ্কিত কণ্ঠ বেরিয়ে এল।

“স্টেশনে একটা বোকাকে পেয়েছিলাম। তার একটা লক্করঝক্কর বাইক ছিল। পুরো ২০ মিনিট ধরে সে তার লক্করঝক্কর বাইকের শব্দে আমাকে বিরক্ত করেছে।” নিক্কি হেসে বলে।

“তারপর…?” কাঞ্চন উদ্বিগ্ন হয়ে বলল।

“তারপর আর কি…! আমিও ওকে ওর অবস্থান কোথায় দেখিয়ে ছিলাম। আর এখন সেই বোকাটা আমাদের বাড়ির অতিথি হয়ে বসে আছে। বাবা বলে উনি একজন ডাক্তার। কিন্তু আমি ওকে একজন প্রথম শ্রেণীর বলদ মনে করি।” বাঁকা মুখে বলল নিক্কি।

“সে এখন কোথায়?” কাঞ্চন জিজ্ঞেস করল।

“তার রুমে থাকবে হয়তো। তাকে নিয়ে মজা করতে হবে। সে নিজেকে খুব স্মার্ট মনে করে।” নিক্কি ওর হাত ধরে টানতে টানতে বলল।

“না …না … নিক্কি, ঠাকুর কাকার খারাপ লাগবে।” কাঞ্চন হাত ছেড়ে দিয়ে বলল। কিন্তু নিক্কি ওকে দরজা দিয়ে টেনে বের করে রুমের বাহিরে চলে আসে।

গ্যালারিতে আসতেই দেখল মঙ্গলু বাড়ির চাকর সিঁড়ি দিয়ে উঠছে। তার হাতে ছিল রবির কাপড় যা সে ইস্ত্রি করে এনেছে। সে বাঁদিকের সিঁড়ি বেয়ে চলে গেল। তার পা রবির ঘরের দিকে।

“এই, শোন…!” নিক্কি তাকে ডাকে।

চাকরটি থেমে গিয়ে ঘুরে নিক্কির কাছে এল। “আরে ছোট মালকিন?”

“এগুলো কার কাপড়?”

“ডাঃ বাবুর …. তিনি ইস্ত্রি করতে দিয়েছিলেন। এখন আমি তাকে দেব।” চাকর তোতা পাক্ষীর মত এক নিঃশ্বাসে সব কথা বলে গেল।

“এই কাপড়গুলো নিয়ে ভিতরে আসো।” নিক্কি আঙুল দিয়ে ইশারা করল ওকে।

ভৃত্য নিক্কির দিকে অবোধ্য ভঙ্গিতে তাকিয়ে তারপর অনিচ্ছায় ভিতরে প্রবেশ করল।

“তোমার নাম কি?” নিক্কি চাকরকে জিজ্ঞেস করল।

“মঙ্গলু…!” চাকর দাঁত বের করে উত্তর দেয়।

“মুখ বন্ধ করো…।” নিক্কি ধমক দিয়ে বললো- “এই কাপড়গুলো এখানে রাখো আর ইস্ত্রি আনতে যাও।”

“কিন্তু ইস্ত্রি করা হয়ে গেছে, ছোট মালকিন?” চাকর মাথা চুলকায়।

“আমি জানি। তোমাকে আবার ইস্ত্রি করতে হবে। আমাদের স্টাইলে।” নিক্কির ঠোঁটে একটা রহস্যময় হাসি নেচে উঠে – “তুমি গিয়ে আয়রন নিয়ে এসো। আর কোন প্রশ্ন করো না, বাবার সাথে কথা বলে তোমাকে ছাড়িয়ে দেবো। বুঝলে?”

“জি…ছোট মালিক।” ভৃত্য ভয়ে কেঁপে উঠে – “সব বুঝলাম। আমি এখনই ইস্ত্রি করে দিচ্ছি।” বলে তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

“তুই কি করতে চাস?” অবাক হয়ে বলে কাঞ্চন।

“তুই শুধু দেখতে থাক।” নিক্কির ঠোঁটে হাসি আর চোখে দুষ্টু ভাব, নিক্কি কাঞ্চনকে তার পরিকল্পনার কথা বলতে শুরু করে। তার কথা শুনে কাঞ্চনের চোখে বিস্ময় ছড়িয়ে পড়ে।

তখন মঙ্গলুকে দরজা দিয়ে ভেতরে আসতে দেখা যায়। সে ইস্ত্রিটা নিক্কির সামনে রাখল। নিক্কি সেটা ইলেকট্রিক পয়েন্টের সাথে সংযুক্ত করে। কিছুক্ষণ পর ইস্ত্রি চুল্লির মতো গরম হয়ে গেল। ও একটি কাপড় তুলে, খুলে এবং তার উপরে জ্বলন্ত ইস্ত্রিটি রাখে। ভৃত্য কাপড়ের এমন অবস্থা দেখে কেঁদে ফেলল। “ছোট মালকিন, আমি তোমার পায়ে পড়ি। আমার কাজের প্রতি দয়া করুন। এই জামাকাপড় দেখে ডাঃ বাবু মালিকের কাছে অভিযোগ করবেন। তারপর আমার…?”

“তুমি চুপচাপ বসে থাকো।” নিক্কি চোখ রাঙ্গায়। আর এক এক করে সব কাপড় গরম ইস্ত্রি দিয়ে জ্বালিয়ে দিতে থাকে। তারপর একই ভাবে ভাঁজ করা শুরু করে। সব কাপড় ভাঁজ করে ফেলার পর মঙ্গলুকে বলল- “এখন নাও আর ঘোঁচুর ঘরে রেখে আসো।”

“মোটেই না।” মঙ্গলু চিৎকার করে উঠল। “তুমি চাইলে আমাকে ফাঁসির মঞ্চে ঝুলিয়ে দাও। নইলে আমার মাথা কেটে দাও। আমি এসব কাপড় নিয়ে রবিবাবুর ঘরে যাব না।” সে কথা বলে চোখের পলকে ঘর থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

নিক্কি তাকে ডাকতে থাকে। মঙ্গলু চলে যাওয়ার পর নিক্কি কাঞ্চনের দিকে তাকিয়ে হাসল। তার হাসিতে দুষ্টুমি ভরা।

“আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?” কাঞ্চনের কন্ঠে সন্দেহ।

“আমার প্রিয় বন্ধু, এখন তুই এই জামাকাপড়গুলো ওই ক্লাউনের ঘরে নিয়ে যাবি।”

“কে … কি???” কাঞ্চন আতঙ্কিত হয়ে বলল- “না… না নিক্কি, আমি এই কাজ করব না। কোনো মূল্যেই না। তোর প্রতিশোধ তোকেই নিতে হবে। আমি তোকে এই কাজে সাহায্য করব না।”

 

“তুই করবি না?” নিক্কি তার নাকের ছিদ্র প্রসারিত করল।

“না …!” একই গোয়ার্তামির সাথে আবার বলল কাঞ্চন।

“ঠিক আছে তাহলে আমি এখন ফ্যানের সাথে ঝুলে আমার জীবন দেব। আমি তোর জন্য সারা দুনিয়ার সাথে যুদ্ধ করতে পারি আর তুই আমার জন্য একটা ছোট কাজ করতে পারবি না।” নিক্কি কুমির চোখের জল ফেলে বললো- “তুই বদলে গেছিস কাঞ্চন, এখন তুই আমার বন্ধু না যে আমার সুখের জন্য দিনরাত আমার সাথে থাকতো, সে আমার ইশারায় যে কোন কিছু করতো, তুই আমার হৃদয়ে আঘাত দিয়েছিস কাঞ্চন… .এখন আমি তোকে এবং এই নিষ্ঠুর পৃথিবী থেকে চিরতরে দূরে চলে যাচ্ছি। শুধু তোর স্কার্ফ দে।”

“উড়না… কি করবি উড়না দিয়ে?” মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করল কাঞ্চন।

আমার কাছে তো কোন দড়ি নেই, তাই না?

“কে… কি?” কাঞ্চন ঘাবড়ে গেল। ও ঘামতে থাকে। ও জানত নিক্কি খুব জেদি। নিক্কি ওর প্রত্যাখ্যানের জন্য তার জীবন দেবে না, তবে তার হৃদয় অবশ্যই ভেঙে যাবে। নিক্কির মন নিশ্চয়ই ওর প্রতি কাদা হয়ে যাবে। সে নিক্কিকে হারাতে চায়না। কি করবে বুঝতে পারছিল না। নিজেকে বাঁচানোর কোনো উপায় দেখতে পায় না। শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়ে বললো- “ঠিক আছে নিক্কি, তুই যা বলবি আমি তাই করব। কিন্তু আর কখনো তোর জীবন দেবার কথা বলবি না।”

“ওহ ধন্যবাদ কাঞ্চন” নিক্কি ছুটে গেল কাঞ্চনের কাছে। তারপর ওকে জড়িয়ে ধরে ওর গালে চুমু দিয়ে বললো- “তুই খুব সুন্দর, তোর বন্ধুত্বে আমি গর্বিত। এখন এই কাপড়টা তুলে ঐ ভাঁড়ের ঘরে গিয়ে রাখ।”

কাঞ্চন অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে এগিয়ে গেল, তারপর সেই কাপড়গুলো হাতে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ওর হৃৎপিণ্ড দ্রুত স্পন্দিত হচ্ছে। কপালে ঘাম।

 

রবি নিজের ঘরে বসে বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত। চাকর কাপড় নিয়ে গেছে প্রায় ঘন্টাখানেক হল। কিন্তু এখনও তার জামাকাপড় নিয়ে ফেরার নাম নেই। ভাবল আর বসে না থেকে গোসলটা সেড়ে ফেলা যাক।। সকাল থেকে গোসল না করায় মাথা ব্যাথা শুরু হয়েছে। ক্লান্তিতে শরীর থমথমে। সে উঠে ভিতর থেকে দরজার লক খুলে দিল। তারপর তোয়ালেটা নিয়ে বাথরুমে ঢুকে। জামাকাপড় খুলে সাওয়ারের নিচে দাঁড়ায়। তার গোসল করতে কিছু সময় লাগল তারপর তোয়ালে দিয়ে ভেজা শরীর মুছতে লাগল। গোসল সেরে খুব হালকা লাগছে। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ শুনতে পেল সে। ভাবল চাকর হবে। এত দেরিতে আসার জন্য সে তার উপর বিরক্ত ছিল। ওকে তিরস্কার করা দরকার। তোয়ালে জড়িয়ে বেরিয়ে এলো। বাথরুম থেকে বের হতেই কাঞ্চনকে দেখতে পায়। কাঞ্চনের পিঠ তার দিকে এবং কাপড় রেখে বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছিল।

“শোন মেয়ে…!” রবির কর্কশ কণ্ঠ কানে লাগে কাঞ্চনের। ওর চলমান পদক্ষেপ থেমে গেল। হার্টবিট বেড়ে গেছে। ও দাঁড়াল কিন্তু ঘুরলো না। ও রবির কাছে মুখ দেখাতে চায়না।

“এত সময় নিলে কেন?” রবি ওকে কাজের মেয়ে ভেবে বকাঝকা শুরু করে।

“জী…ওটা …আমি …মানে…ওটা!” কি উত্তর দেবেন বুঝতে পারছিলন না।

“আমার দিকে ফিরে আস্তে করে কথা বল।” রবি চিৎকার করে উঠল।

কাঞ্চনের সিত্তি পিট্টি গোল হয়ে গেল। পালানোর উপায় ছিল না। নিক্কির দুষ্টুমিতে সে বলির পাঁঠা হয়ে গেছে। ওর পা কাঁপছে। সে ঘুরে গেল। রবির দিকে চোখ পড়তেই হতভম্ব হয়ে গেল।

“তুমি…!” কাঞ্চনের মুখে রবির চোখ পড়তেই তার মুখ থেকে বিরক্তি বেরিয়ে এল।

“হ্যা …..আমি…!” কাঞ্চনও অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। ওর সাথে যে এমন কাকতালীয় ঘটনা ঘটতে পারে তা ও ভাবেনি।

“তুমি কি সেই মেয়ে যে আমাকে রাস্তায় লাম্বারজ্যাক বলেছিল?” কাঞ্চনের দিকে তাকিয়ে বলল রবি। কাঞ্চনকে প্রাসাদে দেখে ও ভয়ঙ্কর হতবাক হয়ে গেছে। ভুলে গেছে যে এই সময়ে সে শুধু গামছা পরে একটা মেয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

কাঞ্চনের অবস্থাও খুব খারাপ। নিজের দুর্ভাগ্য দেখে কেঁদে ফেলার উপক্রম। কিছু না বলে ওখান থেকে পালিয়ে যাওয়াই ভালো মনে করলো। সে ঘুরে দ্রুত পায়ে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। রবি স্তব্ধ হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইল।

এই মেয়ে এখানে কি করছে? কলেজ থেকে পড়া শেষ করে আসা কিছু মেয়ের সাথে একে দেখেছিলাম। তাহলে কি এই মেয়েটি প্রাসাদে দাসীর কাজ করে? কিন্তু কলেজ পড়ুয়া একটা মেয়ে কেন কারো বাড়িতে কাজের মেয়ের কাজ করবে? সে জামাটা তুলে নিল। কিন্তু খুলতেই মাথার খুলি ফেটে গেল। চোখে রক্ত ফুটে উঠল। একটা লোহার আকারের গর্ত সেই জামায়। সে দ্বিতীয় জামাটা তুলে নিল। এটার অবস্থা আরও খারাপ। তারপর তৃতীয় জামাটা তুলে, তারপর চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ,তার সব জামাকাপড়ই মাঝখানে পুড়ে গেছে। জামার এমন অবস্থা দেখে ওর মন খারাপ হয়ে গেল। আশ্চর্য হয়ে গেল। রাগে ওর নাসারন্ধ্র ফুলে উঠে। উত্তেজনায় ওর মুখ কাঁপতে লাগল। ওর চোখ জ্বলে উঠে। সে রাগে মুঠি মুঠো করল। সে মেয়েটির (কাঞ্চন) উপর এতটাই রেগে গেল যে সে যদি এই সময়ে তার সামনে থাকত, সে ওর গলা টিপে দম বন্ধ করে দিত। এখন সে কি পড়বে! ওর কাছে পরার জন্য একটি তোয়ালে পর্যন্ত ছিল না। এমনকি যে জামাকাপড় পরে এসেছে সেগুলো বাথরুমে ভেজা। সাবান দিয়ে ভাল করে ধুয়ে এসেছে। রবি মাথা চেপে বসে রইল।

 

তখন সন্ধ্যা ৫ টা। ঠাকুর সাহেব, নিক্কি আর দিওয়ান স্যার হলের মধ্যে বসে কথা বলছিলেন। নিক্কিকে আগামীকাল আসবে বলে কথা দিয়ে কাঞ্চন তাড়াতাড়ি তার বাড়িতে ফিরে গেছে। তারা সবাই অপেক্ষা করছিল রবির নামার জন্য। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর ঠাকুর সাহেব দিওয়ান জিকে বললেন – “দিওয়ান জী তার তো এতক্ষণে নেমে আসা উচিত ছিল। কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে?”

“আমি নিজে গিয়ে দেখব, মালিক?” দিওয়ান জি কথা বলে উঠে দাঁড়ালেন। সিঁড়ি বেয়ে রবির ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর দিওয়ান জি উপর থেকে একজন চাকরকে ডাকলেন। চাকর দৌড়ে উপরে গেল। তারপর দ্বিতীয় মিনিটেই সে দৌড়ে নিচে এসে প্রাসাদের বাইরে যেতে লাগল। ঠাকুর সাহেব তাকে প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে যেতে দেখে বাধা দিলেন- “আরে মন্টু কোথায় পালাচ্ছো?”

“মালিক, আমি দিওয়ানের বাড়িতে যাচ্ছি। ওর বাড়ি থেকে কিছু কাপড় আনতে।” বলে এবং ঠাকুর সাহেবের অনুমতির অপেক্ষা করতে লাগে।

“ঠিক আছে তুমি যাও।” ঠাকুর সাহেব চাকরকে চলে যেতে বললেন। আর ভাবনায় হারিয়ে গেল। সে কিছু বুঝতে পাড়লো না কি হয়েছে। দেওয়ান জিও উপরে গিয়ে আটকে আছে।

কিছুক্ষণ পর মন্টু কিছু জামাকাপড় নিয়ে প্রাসাদে ফিরে এসে রবির ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। তার উপরে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই দিওয়ানজিও নেমে এলেন। নিচে নামার সাথে সাথে ঠাকুর সাহেব বললেন – “সব কিছি ঠিক আছে তো দিওয়ান জি? কেন মন্টুকে আপনার বাড়িতে কাপড় আনতে পাঠালেন?”

“ডাক্তার বাবুর সমস্যা হয়েছে, মালিক” দিওয়ান জি কপালে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন – “তার পরনের কাপড় নেই।”

“কি…?  ঠাকুর সাহেব আশ্চর্য হয়ে বললেন- “পরার মতো কাপড় নেই, তাইলে কি খালি হাতে বাড়ি থেকে এসেছেন?

“হ্যাঁ…না।” এই আওয়াজটা সিঁড়ির পাশ থেকে ভেসে এল। ঠাকুর সাহেবের সাথে সবার চোখ গেল তার দিকে। রবিকে দেখা গেল সিঁড়ি দিয়ে নামতে। তার গায়ে দেওয়ান জির কাপড়। রবিকে এই পোশাকে কার্টুনের মতো লাগছিল। তাকে একবার দেখে নিক্কি হো হো করে হেসে উঠল। ঠিক তখনই ঠাকুর সাহেব তাড়াহুড়ো করে তার কথায় চলে গেলেন। রবির কানে যে তার কথা পৌছতে পারে সে সম্পর্কে তার মোটেও ধারণা ছিল না।

 

“মাফ করবেন ডাক্তার …. আমরা আসলে অনেকক্ষণ ধরে আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আপনি না আসায় আমাদের মন খারাপ হয়ে যাচ্ছিল।” ঠাকুর সাহেব দ্বিধা মুছে দিয়ে বললেন – “যাই হোক, আপনার জামাকাপড়ের কি হয়েছে? দিওয়ানজী বলছিলেন আপনার কাপড় নেই।”

“আসলে পথে যাওয়ার সময় আমার সাথে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিল।” রবি ঠাকুর সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন – “পথে একটা বন্য বিড়াল আমার সাথে ধাক্কা খেয়েছে। এর ফলে আমি ভারসাম্য হারিয়ে ফেলি এবং আমার গাড়িটি একটি পাথরের সাথে ধাক্কা লেগে গেল। আমার স্যুটকেসটি খুলে রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ে এবং আমার সমস্ত জামাকাপড় নষ্ট হয়ে যায়। এখানে এসে আমি একজন ভদ্রলোককে কাপড় ইস্ত্রি করতে দিয়েছিলাম, তারপর তিনি কাপড় নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। প্রায় এক ঘন্টা পর একজন কাজের মেয়ে আমার কাপড় নিয়ে এলো। আমি যখন পরার জন্য কাপড় তুললাম, দেখলাম আমার সব কাপড় পুড়ে গেছে।” রবি তার কথা শেষ করল।

“কোন দাসী আপনার জামাকাপড় পুড়িয়ে দিয়েছে?” ঠাকুর সাহেব অবাক হয়ে বললেন – “কিন্তু প্রাসাদে একজনই দাসী আছে। আর সে অনেক বছর ধরে আমাদের সাথে কাজ করছে। সে তা করতে পারে না। ঠিক আছে, যাই ঘটুক না কেন, আমরা খুঁজে বের করব। আপনার কষ্টের জন্য আমরাও খুব মর্মাহত হয়েছি, আমরা খুঁজে বের করব। আমি দুঃখিত।” ঠাকুর সাহেব বিনীত কণ্ঠে বলিলেন।

“আপনি আমার চেয়ে বড় ঠাকুর সাহেব” রবি ঠাকুর সাহেবকে বলল এবং তারপর নিক্কির দিকে চোখ রাখল – “আপনি আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে আমাকে ছোট করবেন না।”

ওর কথায় নিক্কির মুখ শক্ত হয়ে গেল। সে লাল চোখে রবির দিকে তাকাতে লাগল। কিন্তু রবি বিনা দ্বিধায় ঠাকুর সাহেবের দিকে ফিরল – “আমি আপনার স্ত্রী রাধা দেবীকে দেখতে চাই। আমাকে তার ঘর দেখান।”

“চলুন।” ঠাকুর সাহেব বললেন। আর রবিকে নিয়ে রওনা দিল রাধা দেবীর ঘরের দিকে। নিক্কি ও দেওয়ান জিও তাদের পেছনে পেছনে।

ঠাকুর সাহেব রাধা দেবীর ঘরের বাইরে এসে থামলেন। দরজায় তালা লাগানো ছিল। তার রুম সবসময় বন্ধ থাকে। তার ঘরে খাবার পৌঁছে দেওয়ার জন্য দিনে একবার খোলা হত। আর এই কাজের দায়িত্ব ছিল বাড়ির একমাত্র কাজের মেয়ে ধনিয়ার। সে ছাড়া এই ঘরে কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়না। সেই রাধা দেবীর জন্য খাবার এবং কাপড় সরবরাহ করতেন। প্রাসাদতে সে একমাত্র সদস্য, যাকে দেখে রাধা দেবীর খিঁচুনি হয়না। সে পাগলামি করে না। সম্পূর্ণ স্বাভাবিক থাকে। ধনিয়া তাকে শুধু খাবারই খাওয়াত না, তাকে তোষামত করে গোসল করাত, তার পোশাকও বদলাতো। তবে এর জন্য ওকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়।

চাকর দরজার তালা খুলে দেয়। রবি ঠাকুর সাহেবকে বললেন – “আপনারা বাইরে থাকুন। আমি বললে ভিতরে আসবেন।”

ঠাকুর সাহেব সম্মতিতে মাথা নাড়লেন। নিক্কির হার্টবিট বেড়ে গেল। মাকে দেখেছে অনেক বছর কেটে গেছে। তার মুখটাও আর মনে নেই। মাকে দেখার জন্য ও খুবই উদগ্রিব ছিল।

রবি ভিতরে পৌছালো। তার হার্টবিট বেড়ে গেছে। কিন্তু মুখ শান্ত। মনটা একেবারে ফাঁকা হয়ে গেছে। রাধা দেবীর খোঁজে চোখ বুলায় ঘরের এপাশে ওপাশে। রাধা দেবীকে তার বিছানার একপাশে শুয়ে থাকতে দেখতে পায়। তার পিঠ ছিল রবির দিকে। সে জেগে নাকি ঘুমিয়ে তা বলা মুশকিল।

রবি কম্পিত হৃদয়ে তার দিকে পা বাড়াল। পায়ের শব্দে রাধা ঘুরে যায়। তার কোলে সেই কাপড়ের পুতুলটা। রবিকে দেখে রাধা দেবী হুট করে উঠে দাঁড়ালেন। রাধা দেবী বড় বড় চোখ করে রবির দিকে তাকাতে লাগলেন। পরের মুহুর্তে তার চোখে ভয় নেমে আসে। রাধা দেবী তার হাতে থাকা পুতুলটিকে তার হাত দিয়ে লুকিয়ে ফেলে। রবি শান্ত ছিল, সে খুব মনোযোগ দিয়ে তার প্রতিটি গতিবিধি দেখছে। বুঝতে পারে যে রাধা দেবী ওকে দেখে ভয় পেয়েছে। ও তার সামনে হাত জোড় করে প্রণাম করল। ওর স্টাইল ছিল রাজার সামনে মাথা নত করে নমস্কার করার মতো- “নমস্কার মা জি।”

রাধার চোখ সরু হয়ে গেল। সে বিস্ময় আর ভয়ের মিশ্র ভাব নিয়ে রবির দিকে তাকাল। তারপর তাদের হাতও নমস্কার বলার ভঙ্গিতে মিলিত হল – “নমস্কার।” সে ভীতু গলায় বলল। তার কণ্ঠ কাঁপে- “কে তুমি? আমাকে চেনো?”

“হ্যাঁ।” রবি শান্ত কন্ঠে বললো- “আমার নাম ডাঃ রবি ভাটনাগর। আমাকে আপনার মেয়ে নিক্কি এখানে পাঠিয়েছে। তার বিয়ের কথা বলার জন্য।”

“নিক্কি …নিক্কি কে?” রাধা দেবী হতবাক হয়ে গেল। তারপর তার পুতুলের দিকে তাকিয়ে বলল – “আমার মেয়ের নাম নিক্কি না…. রানী। ও এখনো অনেক ছোট।”

রবি মৃদু হেসে দু পা এগিয়ে গেল। “আপনার হাতে নিক্কির পুতুল। নিক্কি বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ও অনেক বড় হয়ে গেছে।”

রাধা দেবী ঘাড় তুলে দরজার বাইরে তাকাল। সেখানে দেখার মতো কেউ ছিল না। চোখ গেল রবির দিকে। রবি দ্রুত তার মুখের পরিবর্তনশীল অভিব্যক্তি পড়ছিল। ভয় আর কষ্ট তার চোখে ভয়ের জায়গা করে নিয়েছে। – “আপনি কি নিক্কির সাথে দেখা করতে চান?”

রাধা দেবী ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললেন। রবি হেসে নিক্কিকে ডাকলো। – “নিক্কি… ভেতরে এসো।”

দরজার দিকে রাধা দেবীর চোখ থেমে গেল। তারপর নিক্কি দরজায় হাজির, সে ধীরে ধীরে হেঁটে রবির কাছে এসে দাঁড়াল। ভারী চোখে মায়ের দিকে তাকাল সে। ওর মনে একটা আকাংখা জেগে উঠে, এখনই এগিয়ে গিয়ে মাকে আঁকড়ে ধরতে চায়। কিন্তু রবির নির্দেশ ছাড়া সে কিছু করতে চায়না, যাতে পুরো পরিবেশটি নষ্ট হয়ে না যায়।

রাধাও নিক্কির দিকে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছিল, তার কপালে ভাঁজ। সে নিক্কিকে চেনার চেষ্টা করছিল। “আমি কিছু মনে করতে পারছি না। তোমাকে আগে কখনো দেখিনি। তুমি কি সত্যিই আমার মেয়ে নিক্কি?”

“মা!” নিক্কির কান্না ভেসে উঠল। মমতার তৃষ্ণার্ত নিক্কি নিজেকে আটকাতে পারল না, সে এগিয়ে গিয়ে রাধাকে জড়িয়ে ধরল।

“আরে কি হয়েছে ওর? কাঁদছে কেন?” রাধা ঘাবড়ে গিয়ে বলল।

“অনেকদিন আপনার কাছ থেকে দূরে ছিল, আজকে আপনাকে পেয়ে খুব আবেগপ্রবণ হয়ে গেছে।” রবি রাধা দেবীর সাথে কথা বলে।

রাধা নিক্কিকে সান্ত্বনা দিতে লাগল। সে তার দুর্বল হাত তার পিঠে ঘুরাতে থাকে। অন্য হাত দিয়ে নিক্কির গাল বেয়ে অশ্রু মুছতে থাকে। “কান্না করিস না মেয়ে, তবে এতদিন আমার থেকে দূরে থাকলি কেন? আমায় যদি এত মিস করতে, তাহলে আগে দেখা করতে এলে না কেন?”

“আমি শহরে পড়তাম, মা। তাই তোমার সাথে দেখা করতে পারিনি।” নিক্কি নিজেকে সংযত করে বলল।

“তোমরা দুজনে একসাথে পড়ো?” রাধা নিক্কির মুখ তুলে বলল।

“পড়তো।” রবি বলল- “এখন আমাদের পড়াশুনা শেষ। এখন আপনার দোয়া নিয়ে বিয়ে করতে চাই। আপনি কি আমার হাতে নিক্কির হাত দেবেন?”

“হ্যাঁ…হ্যাঁ, কেন না, এতকিছুর পরেও তোমরা দুজন দুজনকে ভালোবাস। আমার মেয়ের জন্য তোমার মতো বরই চেয়েছিলাম। কিন্তু তোমার বাড়ি থেকে কোনো বড় মানুষ ছেলের বিয়ের কথা বলতে আসেনি। তোমার কি কেউ নেই? বাড়ি?” রাধা দেবী রবিকে জিজ্ঞেস করলেন। সে এখন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক কথা বলছিল। নিক্কি তখনও তাকে আঁকড়ে ধরে আছে।

রবি এগিয়ে গেল। আর রাধাকে বললো- “আমার মা, আমার মা আছে কিন্তু তার স্বাস্থ্য ভালো না, সেজন্য সে আসতে পারেনি। কিছুদিনের মধ্যে মাও আসবে।”

“ঠিক আছে, আমি কয়েকদিন অপেক্ষা করব। আমিও চাই নিক্কি তাড়াতাড়ি বিয়ে করে সুখে থাক।”

“তাহলে এখন আমাদের অনুমতি দিন।” রবি বলল- “আমরা আবার দেখা করতে আসব। আপনি বিশ্রাম করুন। আমরা অন্য ঘরে আছি। আপনা যে কোন প্রয়োজনে আমাদের ডাকবেন।”

“হ্যাঁ…হ্যাঁ, বিশ্রামে যাও। তোমরা নিশ্চয়ই দূরের শহর থেকে এসেছো খুব ক্লান্ত।” রাধা কথা বলতে বলতে নিক্কির মাথায় হাত বুলাতে লাগল।

রবি আবার তাকে নমস্কার বলে নিক্কিকে নিয়ে বেরিয়ে এল।

 

রবি ও নিক্কি রাধা দেবীর ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

বাইরে ঠাকুর সাহেবের পাশাপাশি সবাই লুকিয়ে লুকিয়ে ঘরের ভেতরের দৃশ্য দেখছিলেন। ঠাকুর সাহেব এতটাই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন যে তাঁর কান্না থামাতে পারেননি।

রবি বের হতেই ঠাকুর সাহেব বললেন – “ডাক্তার রবি, আমাদের রাধা ঠিক হয়ে যাবে বলে কি মনে করেন? আমার আশা বেড়ে গেছে। ডাক্তার স্যার বলুন, রাধা কতদিনে সুস্থ হতে পারবে।”

“ধৈর্য্য ধরুন ঠাকুর সাহেব। ভগবান চাইলে ১ মাসে বা সর্বোচ্চ ৩ মাসের মধ্যে রাধাজী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবেন।”

“কিভাবে ধৈর্য ধরবো ডাক্তার? ২০ বছর ধরে আমি যে মানষিক অত্যাচারের মুখোমুখি হয়েছি তা শুধু আমিই জানি। আমার স্ত্রী ২০ বছর ধরে কয়েদির মতো রুমে তালাবদ্ধ। এত সম্পদ থাকা সত্ত্বেও আমাদের রাধাকে কষ্টের মধ্যে থাকতে হয়েছে। না খাবার, না পরার জন্য কাপড়, তার চেয়ে ভালো জীবন নিয়ে আমাদের বাড়ির চাকররা বেঁচে আছে। ২০ বছর ধরে সে পাগলের মতো জীবন কাটাচ্ছে। আমি তার কষ্ট আর দেখতে পারঠি না, ডাক্তার। ঠাকুর সাহেব তার কথা বলতে বলতে শিশুদের মতো কান্নায় ভেঙে পড়েন।

“দেখুন, ঠাকুর সাহেব ….. নিজেকে সামলান।” রবি তার কাঁধ চেপে ধরে বললো – “আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি যে সে পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আমি ক্ষ্যান্ত হব না। আমি এখান থেকে যাব না।” রবি আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল।

“আমি আপনাকে বিশ্বাস করি ডাক্তার। আমি নিশ্চিত যে আপনি অবশ্যই আমার রাধাকে সুস্থ করবেন।”

রবি হাসল। তারপর তিনি দিওয়ান জির দিকে ফিরে – “দিওয়ান জি, আমি কিছু ওষুধ এবং ইনজেকশন লিখে দিচ্ছি, সেগুলো শহর থেকে নিয়ে আসুন। এবং আমার বাড়ি থেকে আমার জামা কাপড় আনানোর ব্যবস্থা করুন।”

“আমি এখনই শহরে কাউকে পাঠাব ডাক্তারবাবু, আপনার জামাকাপড় এবং ওষুধ ২ দিনের মধ্যে চলে আসবে।”

“আমি আপনাদের সবাইকে আর একটি কথা বলতে চাই”- “আজকের পর আপনারা আমাকে শুধু রবি বলেই ডাকবেন। ডক্টর রবি বা অন্য কিছু বলে নয়।”

ঠাকুর সাহেব হাসলেন। “ঠিক আছে রবি। আমরা তোমাকে সেভাবেই ডাকব।

কিছুক্ষণ পর চাকর সবার জন্য চা-নাস্তা নিয়ে এলো। কিছুক্ষণ রবি সবার সাথে বসে গল্প করলো। তারপর ঠাকুর সাহেবের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে নিজের ঘরে চলে আসে।

মা রাধা দেবীর সাথে দেখা করার পর, রবির জন্য নিক্কির যে তিক্ততা ছিল তা এখন কেটে গেছে। সে এখন তাকে শ্রদ্ধার সাথে দেখছিল।

২ দিন কেটে গেছে। শহর থেকে রবির কাপড়ও এসেছে। এই দুই দিনে রবির বেশির ভাগ সময় কাটত তার ঘরে। সে তার ঘর থেকে বের হতেন শুধুমাত্র রাধা দেবীকে দেখার জন্য। সে দিওয়ানজির পোশাক পরে অন্যদের সামনে আসতে দ্বিধাবোধ করত। এখন তার জামাকাপড় এসে গেছে, সে রায়পুরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২ দিন ধরে প্রাসাদের ভিতরে বদ্ধ থাকায় তার মন বিরক্ত হয়ে গেছে।

জামা কাপড় পরে বেরিয়ে এল। তখন ৫ টা। সে চাকরকে তার বাইক পরিষ্কার করতে বলল। রায়পুরে আসার কয়েকদিন আগে রবি পরিবহনের মাধ্যমে রায়পুরে বাইক পাঠিয়েছিল। এবং রায়পুর স্টেশনে নামার পর সে মালঘর থেকে তার বাইকটা নিয়ে নেয়।

আজ সে বাইকে করে রায়পুর যাওয়ার কথা ভাবল। ভৃত্য তার বাইক পরিস্কার করে দেয়। রবি বাইকে বসে প্রাসাদের চার দেওয়াল থেকে বেরিয়ে এল। প্রাসাদের সীমানা ছেড়ে যেতেই রবি দুটি পথ দেখতে পেল। তাদের একটা গেছে স্টেশনের দিকে। আর অন্য পথ জনবসতির দিকে। জনবসতির দিকে বাইক ঘুরিয়ে দিল। রাস্তাটা খুব খাড়া। প্রাসাদ জনবসতি থেকে অনেক উঁচুতে অবস্থিতল। প্রাসাদের ছাদ থেকে পুরো রায়পুর দেখা যেত।

কিছুদূর চলার পর সেই রাস্তাটাও দুই পথে পরিণত হলো। রবি বাইক থামিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে দুই রাস্তায় চোখ চালায়। বাঁদিকের রাস্তা চলে গেছে বসতির দিকে। বসতি বেশি দূরে ছিল না। কিন্তু সেখানে অনেক জনসংখ্যা। যেখানে বসতি শেষ তার সামনে মাঠের অংশ ও বন শুরু। অন্য পথ পাহাড়ে চলে গেছে। তার পাশে ছিল উঁচু পাহাড় আর গভীর উপত্যকা। রবি বাইকটা ডানদিকে ঘুরিয়ে দিল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই রবি ঝর্না থেকে জল পড়ার শব্দ শুনতে পায়। কিছুদূর এগোনোর পর সে দেখতে পেল একটা বয়ে চলা নদী। এতে অর্ধেক কাপড়ে জড়ানো কিছু মেয়েকে নদীতে সাঁতার কাটতে দেখা গেছে। সে বাইক থামিয়ে দূর থেকে সেই রঙিন প্রজাপতিগুলো দেখতে লাগল। হঠাৎ তার চোখ চিক চিক করে উঠে, সেই মেয়েদের মধ্যে সেই মেয়েটিকেও দেখতে পেল মনে হয় যে প্রাসাদে তার কাপড় পুড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু এত দূর থেকে সেই মেয়েটি কিনা দিধা আছে। তাই তাকে আরো একটু কাছে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করা উপযুক্ত মনে করে। সে বাইক থেকে নেমে পায়ে হেঁটে নদীর দিকে এগিয়ে গেল।

নদীর ধারে পৌঁছে ঝোপের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখে। এখান থেকে সে ওই মেয়েদের ভাল ভাবে দেখতে পায়। প্রাসাদের মেয়েটিকে সে স্পষ্ট চিনতে পেরেছে। একটি হলুদ পেটিকোট পরে আছে, তার অর্ধেক শরীর স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তার জলে ভিজে ফর্সা শরীর সূর্যের আলোয় ঝলমল করছিল। সেই মেয়ের সৌন্দর্যে রবির চোখ আটকে গেল। সে দাঁড়িয়ে থাকা সেই অর্ধনগ্ন মেয়েদের সৌন্দর্যে সাড়া দিতে থাকে।

হঠাৎ কারো আওয়াজে সে চমকে উঠল। রবি কন্ঠের দিকে ফিরে। সামনে একটা বাচ্চা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। এভাবে চুরি করে দেখতে গিয়ে ধরা পড়ে ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল রবি। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বাচ্চাকে বললো- “তোমার নাম কি?”

“চিন্টু” শিশুটি উচ্চস্বরে বলল – “আর তোমার নাম কি?”

রবি তার উচ্চস্বরে চমকে উঠে। সে দ্রুত পার্স বের করে দশ টাকার নোট বের করে চিন্টুর দিকে বাড়িয়ে দেয়। নোটটা হাতে আসতেই হেসে ফেলে চিন্টু।

“তুমি কি আমার কাছ থেকে আরও টাকা নিতে চাও?” রবি হাঁটু গেড়ে বসে বলল।

“হ্যাঁ…!” শিশুটি সম্মতিতে মাথা নাড়ে।

“তাহলে আমি তোমাকে যাই জিজ্ঞেস করি, তুমি কি আমাকে সত্য বলবে?” রবি ওর পার্স বের করে শিশুটিকে বলে।

চিন্টু রবির মানিব্যাগটা দেখে ওর জিভটা ঠোঁটের কাছে নাড়ল। – “হ্যাঁ”

“ঠিক আছে তাহলে ঐ হলুদ পেটিকোট পড়া মেয়েটির দিকে তাকাও।” রবি কাঞ্চনের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল- “ওকে চেন?”

“হ্যাঁ।” শিশুটি মাথা নাড়ল।

“ওর নাম কি?” রবি জিজ্ঞেস করল।

“আগে টাকা দাও। তারপর বলবো।” ছেলেটি স্মার্ট। রবি ওর দিকে ১০ টাকার নোট বাড়িয়ে দিল।

“সে আমার কাঞ্চন দিদি।” ১০ টাকার নোট পকেটে রেখে শিশুটি বলল।

“তোমার বোন?” রবি ওর কথার পুনরাবৃত্তি করল।

“হ্যাঁ। কিন্তু তুমি তার নাম জিজ্ঞেস করলে কেন?” শিশুটি উল্টো প্রশ্ন করল।

“এই এমনি, আমি যখন কাউকে দেখি তার নাম জিজ্ঞাসা করি। যেমন তুমি জিজ্ঞাসা করেছিলে।”

চিন্টু অদ্ভুত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে।

“ঠিক আছে চিন্টু, এখন আর একটা কাজ করবে?”

“টাকা পাবো?” ঠোঁটে জিভ চেটে দিল চিন্টু।

রবি ওকে ১০ টাকার নোট দিল। – “তুমি কি তোমার বোনের কাপড় আমার কাছে আনতে পারবে?”

“দিদির জামা, না ….. দিদি আমাকে মেরে ফেলবে।” চিন্টু ভয়ে বলল।

“তাহলে আমার সব টাকা ফেরত দাও।” রবি চোখ দেখায়।

চিন্টু মুঠিতে থাকা নোটটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল আর ভাবতে থাকল। তারপর বললো- “দিদির কাপড় দিয়ে কি করবে?”

“কিছু না … শুধু হাতে নিয়ে দেখতে চাই তোমার বোনের কাপড় কেমন।”

চিন্টু কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তার মনে একদিকে টাকার লোভ, অন্যদিকে দিদির বকাবকি খাওয়ার চিন্তা। অবশেষে টাকাটা পকেটে রেখে জামার দিকে এগিয়ে গেল। পর মিনিটেই কাঞ্চনের জামা নিয়ে ফিরে আসে। রবি ওর হাত থেকে জামাটা নিয়ে বললো- চিন্টু মহারাজ, এখন যদি চাও তোমার বোন তোমাকে মারবে না, তাহলে এখান থেকে সরে যাও।

চমকে উঠল চিন্টু। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে রবির দিকে তাকাল। “এখন তুমি দিদির জামা ফেরত দাও।”

“এই জামাগুলো তোমার বোনের হাতে দেব।”

কিন্তু বোন আমাকে মেরে ফেলবে। সে ভয়ে বলল। ভয়ে তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।

“তোমার বোনকে কে বলবে যে তুমি আমাকে তার জামা দিয়েছ।” রবি ওর ভয় দূর করে- “তুমি যখন এখানে না থাকো, সে তোমাকে মারবে কিভাবে?”

“কিন্তু তুমি দিদিকে বলো না যে আমি তোমাকে তার কাপড় দিয়েছি।”

“আমি বলবো না। কথা দিলাম।” রবি ওর গলা ছুঁয়ে বলল।

পরের মুহূর্তে চিন্টু হাওয়া হয়ে গেল। রবি কাঞ্চনের জামাকাপড় পাশের ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে রেখে কাঞ্চনের জলের বাইরে আসার অপেক্ষা করতে লাগল।

 

রবি ঝোপের মধ্যে লুকিয়েছিল। তার মনে প্রতিশোধের স্পৃহা। এই মেয়েটির কারণে তাকে প্রাসাদে অপদস্থ হতে হয়েছে। রবি কাঞ্চনকে শিক্ষা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ও কি করে ভুলবে যে এই মেয়ে কোন কারণ ছাড়াই তার জামাকাপড় পুড়িয়ে দিয়েছে। এই কারণে, তাকে দুই দিন ধরে জোকার হয়ে প্রাসাদে থাকতে হয়েছে। এসব ভাবতে ভাবতে সে ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে থেকে কাঞ্চনকে খুঁজে বেড়াতে থাকে।

কিছুক্ষণ পর মেয়েরা একে একে বের হয়ে নিজেদের পোশাক পরে নিজ নিজ বাড়িতে যেতে লাগল। রবি ঝোপের বাইরে থেকে ১ ঘন্টা ধরে এই সব দেখছিল। এখন সূর্যও দিগন্তে অস্ত গেছে। সন্ধ্যার লালিমা ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। এখন নদীতে মাত্র ২টি মেয়ে অবশিষ্ট। তাদের একজন কাঞ্চন, অন্যজন তার বান্ধবী। কিছুক্ষণ পর তার বান্ধবীও নদী থেকে বেরিয়ে এসে তার কাপড় পরতে শুরু করে। হঠাৎ বুঝতে পারে এখানে কাঞ্চনের কাপড় নেই। সে কাঞ্চনের কাপড়ের খোঁজে এদিক ওদিক তাকালো, কিন্তু কাপড় কোথাও দেখা পেল না। সে কাঞ্চনকে ডাকে। “কাঞ্চন, তোমার কাপড় কোথায় রেখেছ? এখানে দেখা যাচ্ছে না।”

“ওগুলো ওখানেই ছিল। হয়তো বাতাসে এখানে-ওখানে ছড়িয়ে গেছে। আমি এসে দেখব” বলে কাঞ্চন জল থেকে বেরিয়ে এল। সে তার জামাকাপড় যেখানে রেখেছিল সেখানে চলে এলো। সেখানে শুধু তার ব্রা আর প্যান্টি পড়ে আছে। বাকি জামাকাপড় হাওয়া। সে তার জামাকাপড় খুঁজতে ছুটতে লাগল। কখনও ঝোপের মধ্যে আবার কখনও পাথরে খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু জামাকাপড় কোথাও মেলে না। এবার কাঞ্চনের চিন্তা বেড়ে গেল। সে কষ্টে এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াতে থাকে, তারপর তার বান্ধবীর কাছে যায়। “লতা জামাটা সত্যিই নেই!”

“তাহলে কি আমি মিথ্যা বলছিলাম?” লতা হাসে।

“এখন বাড়ি যাব কিভাবে? ”

“কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো। আলো শেষ হলে বের হয়ে বাড়ি যাও। অন্ধকারে কেউ চিনবে না।”

“তুমি কি আমার বাসা থেকে কাপড় আনতে পারবে?” কাঞ্চন জিজ্ঞেস করল।

“আমি…! না বাবা না।” লতা মানা করলো – “তুমি জানো আমার মা আমাকে আসতে দিবে না। তাহলে আমাকে আসতে বলছ কেন?”

“লতা, তাহলে তুমিও একটু থাকো। দুজনে একসাথে যাবো। আমি এখানে একা থাকতে পারবো না।” কাঞ্চন প্রায় কেদে দেয়।

“কাঞ্চন, আমি যদি থাকতে পারতাম, আমি থাকতাম না? যদি একটু দেরি হয়, তবে আমার সৎ মা আমাকে মেরে ফেলবে। ”

কাঞ্চন চুপ করে গেল। সে ভালো করেই জানত, লতার সৎ মা ওকে মারধর করে। একটি কাজ ১০ বার করায়। তিনি প্রায়শই এই আশায় থাকেন যে লতা কিছু ভুল করুক আর সে এই বেচারিকে মারধর করে। ওর বৃদ্ধ বাবাও স্ত্রীর রাগ থেকে দূরে থাকে।

“আরে ইয়ার এত চিন্তিত কেন? তুমি এভাবে আমার সাথে বাড়িতে চল।” লতা ওকে পরামর্শ দেয়।

“কেউ যদি তোমাকে এমন অবস্থায় দেখে, তুমি কি বলবে?” কাঞ্চন উদ্বিগ্ন স্বরে বলল।

“কেউ কিছু বলবে না। উল্টো মানুষ শুধু তোমার কাঞ্চন শরীরের প্রশংসা করবে।” লতা ওর কাছে এসে কাঁধে হাত রেখে বলে- সত্যি বলছি, তোমাকে এমন অবস্থায় দেখে গ্রামের সমস্ত মজনু মনেপ্রাণে প্রার্থনা করবে তোমাকে পাওয়ার জন্য।

“লতা, তুমি মজা করছ আর আমি এখানে আমার জান যাচ্ছে।” কাঞ্চন গম্ভীর গলায় বলল।

“তোমার কি অন্য কোন উপায় আছে?” লতা ওর চোখে উঁকি মেরে বললো – “হয় তুমি এভাবে আমার সাথে বাসায় চলো… না হয় কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে অন্ধকারের জন্য অপেক্ষা করো। কিন্তু আমাকে অনুমতি দাও। আমি চলে গেলাম।” এই বলে লতা তার পথে চলে গেল। কাঞ্চন তাকে চলে যেতে দেখতে থাকে।

রবি ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে এসব দেখছিল। লতা চলে যেতেই সে বেরিয়ে আসে। আর ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে কাঞ্চনের দিকে এগুতে থাকে। কাঞ্চন ওর দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। রবি ওর কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে ওর দিকে দেখতে লাগলো। এই প্রথম কোনও মেয়েকে এই অবস্থায় দেখতে পেল সে। কাঞ্চন ভেজা পেটিকোট পরে দাঁড়িয়ে ছিল। ওর ভেজা পেটিকোট ওর পাছার সাথে আটকে আছে। পেটিকোট ভিজে যাওয়ায় সম্পূর্ণ স্বচ্ছ হয়ে গেছে। অল্প আলোতেও তার বিশাল গোলাকার পাছা রবি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। পেটিকোট দুটো পাছার ফাঁকে আটকে গেছে, এক অপরুম মোহময় দৃশ্য। রবি অবাক হয়ে তার অপূর্ব রূপের দিকে তাকিয়ে থাকল। হঠাৎ কাঞ্চন অনুভব করলো ওর পেছনে কেউ আছে। সে দ্রুত ঘুরে দাঁড়াল। সাথে সাথে মুখ ঘুরিয়ে চিৎকার করে চার পা পিছিয়ে গেল। অবাক হয়ে রবির দিকে তাকায়। রবি ওর চিৎকারকে পাত্তা না দিয়ে ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত ওর দিকে তাকিয়ে রইল। ওর অর্ধনগ্ন স্তনের বোঁটাগুলো দেখে রবির চোখ দুটো অদ্ভুত আভায় ভরে গেল। তার চোখ স্থির ছিল পাহাড়ের মতো শক্ত চাকের দিকে। ভেজা পেটিকোটে, ওর টানটান স্তন এবং ওর গাঁট বাক স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। রবি ওর ঠোঁটে জিভ নাড়ায়।

কাঞ্চনের অবস্থা ছিল বেগতিক। এমন অবস্থায় সামনে একজন অপরিচিত লোককে দেখে ওর হৃৎপিণ্ড জোরে জোরে স্পন্দিত হচ্ছিল। বুকটা দ্রুত ওপরে নিচে উঠছে নামছে। যখন সে তার শরীরে রবির কাতর চোখ বুঝতে পারল, সে তার হাত কাঁচির আকার দিয়ে বুক ঢেকে রাখার চেষ্টা করে। ও স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল লজ্জার বান্ডিল হয়ে। তারপর সাহস করে বললো- “আপনি এই সময়ে এখানে… এমনভাবে একটা মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে আপনার কি লজ্জা লাগে না?”

জবাবে হাসল রবি। তারপর ব্যঙ্গাত্মক ভাষায় বললেন- “একই কথা। কৃষ্ণ করলে লীলা। আমরা করলে রাসলীলা।”

“আমি বুঝতে পারছি না।” মৃদু কণ্ঠে বলল কাঞ্চন।

রবি হাত বাড়িয়ে জামাকাপড় দেখাল। কাঞ্চন রবির হাতে তার জামা দেখে প্রথমে চমকে উঠল তারপর চোখ তুলে বলল – “ওহ… তাইলে আপনিই আমার জামা চুরি করেছেন। আমি জানতাম না যে শহুরে লোকেরাও মেয়েদের জামা চুরি করতে অভ্যস্ত। এটা বড় হতাশার বিষয়। দিন আমার জামাকাপড় আমাকে দিন।”

রবি ব্যঙ্গ করে হাসল। “আমিও জানতাম না যে গ্রামে যারা থাকে তারা পোশাক জ্বালিয়ে অতিথিকে তাদের বাড়িতে স্বাগত জানায়, সেটা খুব ভাল কাজ তাই না।” হঠাৎ রবির কণ্ঠে কঠরোতা ফুটে উঠল- “এখন কেমন?  তোমার উপর আমার অপমানের প্রতিশোধ নিতে দাও। তোমার শরীর থেকে এই শেষ কাপড়টাও খুলে ফেলো না কেন?

কাঞ্চন কেঁপে উঠল। তার চোখ থেকে ভয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। সে ভীতু গলায় বললো- “আমি আপনার জামাকাপড় পোড়াইনি, স্যার, সে করেছে… সে করেছে…।” বলতে বলতে কাঞ্চন হঠাৎ থামে। ও নিজেই লজ্জাজনক অবস্থায় আছে, এখন নিক্কিকেও লজ্জা দেওয়া ঠিক হবে না।

“সেটা কে? এখন বলছ অন্য কেউ ওই কাজটা করেছে। যে মেয়েটা আমার পোড়া কাপড় নিয়ে আমার ঘরে গিয়েছিল সে অন্য কেউ না, তুমি।”

“স্যার …সত্যি বলছি, আমি আপনার জামাকাপড় পোড়াইনি।”

“তুমি যা করেছে তা তোমার মিথ্যা দিয়ে ঢাকতে পারবে না। আমি তোমার এই সাদা শরীরের ভিতরে কালো মন দেখেছি।”

কাঞ্চন রেগে গেল, রবির কটূক্তি ওর হৃদয়ে বিঁধে যাচ্ছে। ও সাহায্যের জন্য চারপাশে তাকায় কিন্তু এমন কাউকে দেখতে পায়না যাতে ও সাহায্য চাইতে পারে। ও সেই মুহূর্তে নিক্কিকে সারাজীবনের জন্য অভিশাপ দেয়। আমি যদি সেদিন ওর কথায় না আসতাম। ও আবার রবির দিকে ঘাড় তুলে বলল – “স্যার, আমার জামাকাপড় দিন। আমার বাড়ির সবাই চিন্তা করবে।” তার কণ্ঠে আকুতি ছিল এবং ওর চোখ অশ্রুতে ভরে উঠল। সে এখন কেদে দিবে।

 

 

রবি মনোযোগ দিয়ে ওর মুখের দিকে তাকাল। লজ্জা আর ভয়ে ওর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। ওর সুন্দর চোখে ঘন ফোঁটা অশ্রু। ওর ঠোঁট কাঁপছিল। অসহায়ভাবে ওর শুকনো ঠোঁটে জিভ নাড়ছিল। রবি ওর অবস্থা দেখে ওর প্রতি করুণা অনুভব করে। হাতে ধরা কাপড়টা ওর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বললো- “তোমার জামাটা নাও, পরে বাসায় যাও। আমি সেই লোকদের মত নই যারা কারো অসহায়ত্বের সুযোগ নেয়। তবে বাসায় যাওয়ার পর সময় পেলে তোমার মনের ভিতরে দেখ এবং ভেবো আমি তোমার সাথে যা করেছি তা কেন করেছি তখন তুমি সম্ভবত বুঝতে পারবে যে কারও মনে আঘাত দিলে অন্যের মনে কী হয়। রবি চলে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়াল, তারপর থেমে গিয়ে কাঞ্চনকে বললো- “আর একটা কথা… যদি তুমি নিজের প্রতি ভালোবাসা দিয়ে কারো মন ভরাতে না পার, তবে চেষ্টা করো যেন কেউ তোমাকে ঘৃণা না করে।” এই বলে রবি ঘুরে তার বাইকের দিকে এগিয়ে গেল।

কাঞ্চন রকিকে চলে যেতে দেখতে থাকল। তখনও ওর চোখে জল। রবির শেষ কথাগুলো ওর কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল।

“আমি দুঃখিত, স্যার।” বিড়বিড় করে বললো- “আমি জানি আমার কারণে আপনার হৃদয় ভেঙে গেছে, আমি ভুল করে আপনার আত্মসম্মানে আঘাত করেছি। কিন্তু আমাকে ঘৃণা করবেন না স্যার।”

কাঞ্চন ভারী পায়ে ঝোপের দিকে এগিয়ে গিয়ে জামা কাপড় পরতে লাগল। পোশাক পরে সে বাড়ির পথে রওনা দিল। সে সারাটা পথ রবির কথা ভাবতে থাকে। কিছুক্ষণ পর বাড়িতে পৌঁছে যায়। কাঞ্চন বাড়ির আঙিনায় পা দিতেই খালা জিজ্ঞেস করল “কাঞ্চন এত দেরি করলি কেন? কতবার বুঝিয়েছি সন্ধেবেলা দেরি করে বাইরে থাকিস না। নিজের খেয়াল আছে নাকি?”

কাঞ্চন বুয়ার দিকে তাকায়, বুয়া উঠোনের চুলায় রুটি বানাচ্ছেন। তার বাবা সুগনার চুলা থেকে একটু দূরে খাটের ওপর বসে ছিলেন। কাঞ্চন তাকে বাবা বলে ডাকতো। “আজ দেরি হয়ে গেছে বুয়া, এখন থেকে আর হবে না।” কাঞ্চন বুয়ার সাথে কথা বলে নিজের রুমের দিকে চলে গেল। ওদের মাটির ঘর আর মাটির ঘরে ছিল মাত্র দুটি ঘর। এক ঘরে কাঞ্চন ঘুমাতো, অন্য ঘরে তার বুয়া শান্তা, বারান্দায় সুগনার খাট। চিন্টুর জন্য আলাদা খাট ছিল না। যার সাথে ইচ্ছা তার সাথে ঘুমায়। তবে বেশির ভাগ সময় কাঞ্চনের সঙ্গেই ঘুমায়। কাঞ্চন ওর ঘরে ঢুকে গেল। ভেতরে পড়াশোনা করছিল চিন্টু। কাঞ্চনকে দেখে সে ঘাবড়ে গেল। আর বই বন্ধ করে ঘর হতে বের হতে লাগল।

“তুই কোথায় যাচ্ছিস?” কাঞ্চন ওকে বাধা দেয়।

“কোথাও না, বাইরে মা … মায়ের কাছে।” সে ছটফট করল।

“মায়ের কাছে নাকি বাবার কাছে?” কাঞ্চন তাকিয়ে বললো, “আর এত ছটফট করছিস কেন?”

চিন্টু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ওর কপালে ঘাম। ভয়ে ওর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, কথা বলার জন্য মুখ খুলল কিন্তু আওয়াজ বের হল না।

চোখ কুচকে কাঞ্চন মনোযোগ দিয়ে ওর দিকে দেখতে লাগলো। “ব্যাপার কি?” কাঞ্চন মনে মনে বলল- ও এতো ভয় পাচ্ছে কেন? চিশ্চয়ই বিনা কারণে নয়।

চিন্টু কাঞ্চনকে চিন্তায় মগ্ন দেখে গভীর পদক্ষেপে সেখান থেকে চলে গেল। কাঞ্চন ভাবতে থাকে। ওর চোখ হঠাৎ জ্বলে ওঠে। নদীতে গোসল করতে গিয়ে চিন্টুর গলা শুনতে পেয়েছিল। কিন্তু দেখতে পায়নি। “এমন না তো, ওই আমার কাপড় চুরি করে স্যারকে দিয়েছে।” ও বিড়বিড় করে বললো- “এমনটাই নিশ্চয় হয়েছে। নইলে স্যার কি করে জানবে আমার জামা কোনটা?”

ওর কাছে এবার বিষয়টি পরিস্কার। কাঞ্চন দাঁতে দাঁত কিড়মিড় করে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। বাবার কোলে বসে কথা বলছিল চিন্টু। কাঞ্চনকে রাগে নিজের দিকে আসতে দেখে ওর হুঁশ উড়ে গেল। কিন্তু কিছু করার আগেই কাঞ্চন ওকে ধরে ফেলে। কাঞ্চন ওর হাত ধরে টেনে ঘরে নিয়ে গেল। রুমে পৌঁছে কাঞ্চন চিন্টুকে খাটের ওপর বসিয়ে ভিতর থেকে দরজা লাগিয়ে দিতে থাকে। চিন্টু এটা দেখে ভয়ে কেঁপে উঠে। আজ যে তার প্রহার নিশ্চিত তা বুঝতে তার বেশি সময় লাগেনি। টাকার লোভে শহুরে বাবুর কথা মেনে নেওয়াকে অভিশাপ দেয়।

কাঞ্চন এসে দরজার লাচ ধরে ওর কাছে দাঁড়াল। “কেন তুই… আমার থেকে পালাচ্ছিস কেন?”

“দিদি, তুমি কি সত্যিই আমাকে মেরে ফেলবে?” ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল চিন্টু।

কাঞ্চনের চিন্টুর হলুদ মুখ দেখে সমস্ত রাগ উধাও। মেয়েটা হাসল, তারপর ওর সাথে খাটে বসে ওর গালে চুমু খেয়ে বলল- “না, আমি কি তোকে মেরে ফেলতে পারি, কিন্তু তুই শুধু বল তুই আমার জামাটা স্যারকে দিয়েছিস, সত্যি বলবি, নাহলে তোকে অবশ্যই মেরে ফেলব।”

চিন্টু হাসল। সে কাঞ্চনের দিকে তাকিয়ে লজ্জিত হয়ে বলল- হ্যাঁ!

“কেন দিলি?” কাঞ্চন আবার গালে চুমু খেতে খেতে বলল।

“আমি বলবো না, তুমি মেরে ফেলবে।” চিন্টু হাসল।

“আমি না বললে মেরে ফেলব” কাঞ্চন চোখ দেখিয়ে বলল”আমার জামাকাপড় দিলি কেন?”

“তিনি আমাকে টাকা দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন যে আমি যদি সে যা বলে তাই করি তবে তিনি আমাকে আরও টাকা দেবেন।” চিন্টু কাঞ্চনকে নদীর পুরো ঘটনা খুলে বলল।

“টাকা কোথায়?” সব শুনে কাঞ্চন জিজ্ঞেস করল।

চিন্টু পকেট থেকে টাকা বের করে কাঞ্চনকে দেখিয়ে বলল – “দিদি আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাকে মেরে ফেলবে। আজকের পর আর কখনো এমন করব না… সত্যি.!”

কাঞ্চন মুচকি হেসে বুকে জড়িয়ে ধরে মনে মনে বললো- “তুই জানিস না, তোর জন্য আজ আমি কি পেলাম।” পরের মুহুর্তে ওর মনে প্রশ্ন জাগলো। “কিন্তু আমি কি পেলাম যে আমি এত খুশি হচ্ছি? স্যার তো আমার কোনো ভালো করেননি, আমাকে অপমানই করেছেন। তাহলে আমার মন ময়ূর হয়ে গেল কেন?”

“না স্যার আমাকে অপমান করেননি, তিনি আমার ভালোর জন্য যাই বলুন না কেন, তিনি একজন ভালো মানুষ, আজ তিনি চাইলে আমার সাথে যা কিছু করতে পারতেন না। কিন্তু তিনি কিছুই করেননি। তিনি সত্যিই একজন ভালো মানুষ।”

“ধরে নিই তিনি একজন ভালো মানুষ। কিন্তু আমি কেন তাকে নিয়ে ভাবছি। তাকে নিয়ে ভাবার কি অধিকার আমার আছে। আমি কি তার প্রেমে পড়তে শুরু করেছি?”

“আমি করলেও বা কি খারাপ, ভালোবাসা মন্দ নয়। ভালোবাসা একদিন সবারই হয়, আমারও হয়েছে।”

কাঞ্চনের হৃদয়ে স্পন্দন। তার বুকে একটা মিষ্টি আভা। সে তার বুক ঘষতে লাগল। “আমার কি হচ্ছে, আমি ওকে নিয়ে এত ভাবছি কেন। আমার কিছু হয়েছে, আমি কি সত্যিই প্রেমে পড়ে গেছি?”

কাঞ্চনের মনে প্রেমের অঙ্কুর ফুটেছে। এবং তা খুব দ্রুত বেড়ে উঠছে। নদীতে রবির সাথে দেখা হওয়া ওর উপর খুবই প্রভাব ফেলেছে। তা ওর মন থেকে যাচ্ছেই না। প্রতি মুহূর্তে রবির চিন্তায় ডুবে যাচ্ছিল। ইচ্ছে করেও সেই চিন্তা থেকে মুক্তি পাচ্ছে না।

 

১০

বোনকে হারিয়ে যেতে দেখে চিন্তায় পড়ে গেল চিন্টু। কাঞ্চন ভাবছিল, কখনও ওর ঠোঁট হাসছে আবার কখনও শক্ত হয়ে যাচ্ছে। ছোট চিন্টু কিছুই বুঝতে পারল না। “কি হয়েছে দিদি, চুপ করে আছো কেন?”

চিন্টুর কথায় কাঞ্চন জেগে উঠে, সে দেখল চিন্টু তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। “বলো দিদি, হাসছিলে কেন?” চিন্টু আবার জিজ্ঞেস করল।

“চিন্টু তোকে কি বলবো? আমি নিজেও জানি না, আমার কি হয়েছে? কি হচ্ছে? কেন আমার সবকিছু ভালো লাগতে শুরু করেছে। তুইও সেই একই, এই বাড়ি, একই উঠান, তাহলে আমার কেন সব কিছু নতুন লাগছে? যদি কেউ আমাকে এই প্রশ্নের উত্তর বলতে পারে… কাঞ্চন ওর কণ্ঠস্বর হারিয়ে ফেলে, ওর কন্ঠস্বর মনে হচ্ছে দূরে কোথাও থেকে আসছে।

চিন্টু পলক ফেলল। সে তখনও কিছু বুঝতে পারেনি- “আমি গিয়ে বাবাকে বলবো?” কাঞ্চনের কোল থেকে উঠে বলল।

কাঞ্চন কেঁপে উঠে। সে তাড়াতাড়ি চিন্টুর হাত টেনে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিল। ওকে বাহুতে ভরে ওর গালে চুমু খেয়ে চলে। “দিদি, আমাকে ছেড়ে দাও।” চিন্টু ছাড়া পেতে মরিয়া, কিন্তু কাঞ্চনের খপ্পর শক্ত ছিল- “তুমি যদি আমার গাল ভিজিয়ে দাও, আমি আর তোমার কাছে আসব না।”

“তাহলে আমি কার গাল ভিজাব… বল?” একটানা চুমু খেতে খেতে কাঞ্চন বলল।

“যাও সেই শহুরে বাবুর গাল ভিজিয়ে দাও যে তোমার কাপড় নিয়েছে।” চিন্টু আবার জোড়াজুড়ি করে ছাড়া পাওয়ার জন্য।

“কিন্তু এটা তুই দিয়েছিস।” কাঞ্চন ওকে সুড়সুড়ি দিয়ে বলল।

চিন্টুকে কিছুক্ষণ লাল হলুদ করার পর কাঞ্চন ওকে ছেড়ে দেয়। হাত থেকে ছাড়া পেতেই চিন্টু দৌড়ে বাইরে গেল। কাঞ্চন বিছানায় পড়ে রবির কথা ভাবতে থাকে। রবির শেষ কথাটা আবার কানে ধ্বনিত হলো- “যদি তুমি কারো হৃদয় নিজের প্রতি ভালোবাসায় ভরাতে না পার, তবে চেষ্টা করো কেউ যেন তোমাকে ঘৃণা না করে।”

“স্যার, আমি আপনার জন্য আমার হৃদয় পূর্ণ রাখব। একদিন, স্যার, আপনি এই কাঞ্চনকে আপনার বাহুতে জড়িয়ে ধরবেন। আপনি আমাকে ভালোবাসবেন। আমি আপনার হৃদয়কে নিজের জন্য এত ভালবাসা দিয়ে পূর্ণ করব যে আপনি সাত জন্মের জন্য সেই ভালবাসা মুছে ফেলতে পারবেন না।” কাঞ্চনের ঠোঁটে হাসি। বালিশে মাথা লুকিয়ে স্বপ্নের জগতে হারিয়ে যেতে থাকে।

 

রাত বারোটা বাজে। নিক্কি ওর বিছানায় শুয়ে আছে। কিন্তু ওর চোখ থেকে ঘুম উধাও। ওর চিন্তায়ও রবি। আপনি হয়তো ভাবছেন সেও কাঞ্চনের মতো রবিকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। কিন্তু তা নয়, ওর চিন্তার ভিত্তি অন্য কিছু। নিক্কি প্রেমকে ঘৃণা করে, সে প্রেমকে বোকা মানুষের ধারণা বলে মনে করে। ওর বিশ্বাস প্রেমে মানুষের বুদ্ধিমত্তা কমে যায়। ভালোবাসা শুধু টেনশন দেয় আর কিছু না। প্রেম করার পর মানুষ তার স্বাধীনতা হারায়। মানুষ অন্যের দাস হয়েই থাকে। নিক্কির হৃদয়ে মাত্র দুই জনের জন্য ভালবাসা। একজন ওর বাবা ঠাকুর জগৎ সিং, অন্যজন কাঞ্চন ওর বান্ধবী। এদের ছাড়া ও কাউকে অন্তরে ঢুকতে দেয়নি। হ্যাঁ, মায়ের জন্য ওর হৃদয় এখনও খালি। রবিকে নিয়ে ভাবনায় আসার কারণ হল, ওর শহরে কাটানো জীবনের কথা মনে পড়ছে। সেখানে ওর সবকিছুর স্বাধীনতা ছিল, কেউ বাধা দেওয়ার ছিল না। কারও সাথে আড্ডা দিতে চাওয়া, গভীর রাত পর্যন্ত বাইরে থাকা, নিজের বন্ধুদের সাথে কিছু করা, কোনও বাধা ছিল না। কিন্তু এখানে ঠিক উল্টো। এখানে নিক্কি সেই সমস্ত স্বাধীনতা পাচ্ছিল না। কলেজে অনেক মজা করতো। অগণিত ছেলের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক ছিল। ও সেই সব মেয়েদের মধ্যে একজন যারা পোশাক কম, বিছানা বেশি পাল্টায়। ওর কাছে পুরুষদের সাথে বন্ধুত্ব ছিল শুধুমাত্র শারীরিক তৃপ্তি এবং এর বেশি কিছু নয়। ও ওর শহুরে জীবনে সেক্সে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে, কারো সাথে সেক্স করতে দ্বিধা করত না। কিন্তু কখনো কাউকে ওর উপর কর্তৃত্ব করতে দেয়নি। কখনো অন্য কোন নেশাদ্রব্য স্পর্শ করেনি। কখনই মদ এবং সিগারেটে অভ্যস্ত হয়নি।

শহর থেকে আসার ৪ দিন হয়ে গেল। গত ৬ দিন ধরে ও শারীরিক সুখ থেকে বঞ্চিত। এখানে আসার পর তৃতীয় দিন পর্যন্ত ওর মন সেদিকে যায়নি। কিন্তু এখন সেক্স মিস করতে শুরু করেছে। আজ বিছানায় শুয়ে আনন্দের দোলায় কাটানো মুহূর্তগুলোর কথা মনে পড়ছে ওর। সেই মুহূর্তগুলোর কথা মনে পড়লে শরীর শিউরে ওঠে। কামের ঢেউ ভেসে উঠছিল শরীরে। আর এই সময় একটাই মুখ দেখতে পেল যা ওর লালসা প্রশমিত করতে পারে। আর সেটা ছিল রবি। কিন্তু সে একটা দ্বিধায় পড়েছে, যদিও অনেকের সাথে সেক্স করেছে, কিন্তু রবি ওর কাছে অন্য রকমের লোক বলে মনে হয়েছে। ওর ভয় যে রবি ওর প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে পারে। কিন্তু লাখ চাওয়ার পরও নিজের ভেতরের লালসাকে দমন করতে পারেনি। শরীরের ক্ষুধা মনের উপর আধিপত্য বিস্তার করছিল। উঠে আয়নার সামনে দাঁড়াল। এই সময়ে ওর শরীরে একটি খুব স্বচ্ছ নাইটি। নিজেকে আয়নায় দেখতে লাগল।

“আমার এই সৌন্দর্য কি গলে যাবে রবি?” সে তার উদ্ধত স্তনের দিকে তাকাল। সেগুলো মাথা উঁচু করে যেকোনো চ্যালেঞ্জের জন্য প্রস্তুত। নিক্কি আলতো করে তার দুই হাত দুটো স্তনের উপর রেখে আদর করে। তাদের অভিনন্দন জানানোর মতোই। ওর হাতের স্পর্শে স্তনগুলো আরও শক্ত হয়ে গেল। নিক্কি হাসে। একই সঙ্গে ওর ডান হাত নিচের দিকে নেমে সোজা কোমরের কাছে পৌঁছে যায়। হাত কোমর বেয়ে প্যান্টি পর্যন্ত পৌঁছে গেল। প্যান্টির ইলাস্টিকের উপর আঙুল আটকে রাখল, তারপর আস্তে আস্তে প্যান্টিটি নীচে নিচে নামাতে থাকে। প্যান্টিটা উরু পর্যন্ত পৌছলে হাত সরিয়ে নিল। এরপর আয়নায় নিজের নগ্ন সৌন্দর্য দেখতে লাগল। কিছুক্ষণের জন্য নিজের চোখে ওর ধ্বংসাত্মক সৌন্দর্যকে পুনরুজ্জীবিত করার পরে, নিক্কি প্যান্টি তুলে। তারপর বিছানার দিকে ফিরল। কিছুক্ষন বিছানায় বসে ভাবতে থাকে রবির কাছে যাওয়া উচিত হবে কি না। অবশেষে রবির কাছে যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নেয়। নিক্কি চাদরটা তুলে শরীরে জড়িয়ে নিল। তারপর ঘড়ির দিকে তাকায়, সাড়ে বারোটা বাজে। ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। গ্যালারিতে এসে দেখে গ্যালারি জনশূন্য। ওর ঘরের দরজা ঠেলে রবির রুমের দিকে চলে যায়। ওর পূর্ণ আশা এই সময়ে রবি জেগে থাকবে। রবির ঘরের বাইরে নিজের চলন্ত পদক্ষেপগুলো থামিয়ে দিল। তারপর আস্তে আস্তে দরজায় টোকা দিল। কিছুক্ষণ পর ভেতর থেকে রবির কন্ঠ ভেসে এলো- কে?

“আমি নিক্কি …দরজা খুলুন।” নিক্কি নরম গলায় বলল।

কিছুক্ষন পর রবি দরজা খুলে নিক্কির দিকে অবাক হয়ে তাকাল – “তুমি… মানে আপনি… এই সময়ে?”

“আমাকে আসতে বলবেন না।” নিক্কি হেসে বলল।

“আসুন” দরজা থেকে সরে গিয়ে বলল রবি।

নিক্কি রুমে ঢুকে সোফায় বসল। রবি সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে নিক্কির দিকে তাকাতে লাগল। মনের সব জানালা খুলে সে ভাবতে লাগল এত রাতে নিক্কি তার রুমে এমন রুপে এলো কেন? কিন্তু লক্ষাধিক মনের ঘোড়া দৌড়ানোর পরও সে কিছু বুঝতে না পেরে নিক্কির দিকে তাকাল। নিক্কি ওর দিকে তাকিয়ে ছিল, রবি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে দেখে নিক্কি হেসে বলল- দরজা বন্ধ করুন।

“আপনি গরমের রাতে চাদর পরেছেন কেন?” নিক্কির কথা উপেক্ষা করে রবি ওকে জিজ্ঞেস করল।

“আসলে আমি একটা ট্রান্সপারেন্ট নাইটি পরে আছি ভিতরে। আর আপনি বোধহয় পছন্দ করবেন না আমি ওই জামায় আপনার কাছে আসি। তাই এই চাদরটা দিয়ে ঢেকে রেখেছি।”এই বলে নিক্কি হেসে রবির দিকে তাকাতে লাগল।

“এই সময়ে এমন অবস্থায় আসার কারন কি?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল রবি। তার মুখ শান্ত। যদিও সে নিক্কির মুখ থেকে শুনে অবাক হয়েছিলেন যে সে স্বচ্ছ পোশাক পরে আছে। তার ভেতরের তরুণ হৃদয় প্রবলভাবে স্পন্দিত হচ্ছিল। কিন্তু নিক্কির সামনে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে দেননি।

“বিশেষ কিছু না, আমার ঘুম আসছিল না, তাই ভাবলাম আপনার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলি।” নিক্কি মৃদু হেসে বলল – “আমি জানতাম আপনিও জেগে থাকবেন।”

“আপনি কি করে জানলেন আমি জেগে আছি?” রবি জিজ্ঞেস করল।

“আমার জন্ম এই বাড়িতে, আমার শৈশবও কেটেছে এখানে, সবাই আমাকে চেনে, আমি সবাইকে জানি, তবুও আমার মন এখানে টিকছে না। নিজেকে বড় একা লাগছে। দিনটা কোন মতে পার হয় কিন্তু রাতটা কঠিন হয়ে যায়, পুরোটা রাতই জেগে কেটে যায়। সে কিছুক্ষণ থেমে, তারপর মুচকি হেসে বলল – “আমারই যখন এমন অবস্থা তখন আপনি এখানে অপরিচিত। আপনার কিভাবে ভালো ঘুম হবে।”

 

১১

“আমি জেগে থাকার কারণটা অন্য কিছু, নিক্কি। রবি গম্ভীর গলায় বললো- আপনার মায়ের কথা ভাবছিলাম।

“ওহ…!” মার কথা শুনে নিক্কির মুখ ঝুলে গেল – “তাহলে হয়তো আমি আপনাকে বিরক্ত করছি।”

“না, এটা সেরকম নয়।” মৃদুস্বরে বলল রবি। আর নিক্কির দিকে তাকাতে লাগলো। সে বুঝতে পারছিল না নিক্কিকে কি বলবে। এই সময় তার রুমে থাকার কারণে সে খুব নার্ভাস হয়ে পড়েছিল। সে একজন শালীন ব্যক্তি, সে তার সম্মানের প্রতি খুবই সচেতন। সে চায়নি যে এই সময়ে নিক্কিকে তার ঘরে কেউ দেখুক এবং তার সম্মান উড়ে যাক। কিন্তু সরাসরি নিক্কিকে চলে যেতে বলতে পারছে না। এটা করা হবে আর আচরণের পরিপন্থী।

নিক্কি মাথা নিচু করে চিন্তায় হারিয়ে গেল। রবিকে কিভাবে আসল কথা বলবে তাও বুঝতে পারছিল না। যদিও সে খুব খোলামেলা প্রকৃতির ছিল, সে কাউকে কিছু বলতে দ্বিধা করত না। কিন্তু এখানে পরিস্থিতি ভিন্ন। এক, সে রবির ভদ্রতাকে ভয় পাচ্ছিল, দ্বিতীয়ত এই সময়ে সে নিজের বাড়িতে। তার একটি ভুল তাকে তার নিজের বাড়িতে অপমানিত করতে পারে।

“আপনার বাসায় কে কে আছে?” নিক্কি কিছু একটা নিয়ে কথা এগোনোর জন্য রবির পরিবারের কথা বলে বসল।

“আমার মা এবং আমি।” রবি মৃদু হাসল।

“আর আপনা বউ?” নিক্কি ওর মুখে চোখ রেখে বলল।

“বউ এখনো আসেনি। অর্থাৎ আমি এখনো বিয়ে করিনি।”

“হুমমম …তাই জনাব এখন পর্যন্ত শুধু গার্লফ্রেন্ড দিয়েই কাজ চালাচ্ছেন।” নিক্কি ফ্লার্টেটিভ ভঙ্গিতে কথাটা বললেও তার কথায় ছিল কামুকতার মিশ্রণ।

রবি নিক্কির স্পষ্ট কথায় হতবাক। নিক্কি যে এত খোলামেলা কথা বলতে পারে তার কোনো ধারণাই ছিল না। সে হাত উঠিয়ে বললো- “আমার কোন গার্লফ্রেন্ড নেই।”

“কি… কি?” নিক্কির মুখ খুলে গেল। এটা জেনে তার মনে হাজারো লাড্ডু ফটফটিয়ে উঠে। কিন্তু হতভম্ব হওয়ার ভান করে বললো- “বিশ্বাস হচ্ছে না। আপনি অনেক হ্যান্ডসাম, নিশ্চয়ই কোনো না কোনো গার্ল ফ্রেন্ড আছে। হ্যাঁ… তুমি না বলতে চাইলে অন্য ব্যাপার।”

“তোমাকে মিথ্যে বলে কি পেলাম?”রবি জবাব দিল।

“হয়তো তুমি এই অজুহাতে আমাকে এড়িয়ে যেতে চাও। “নিক্কি আসল বিষয়ে কথা বলেছেন।

“আমি… আমি কিছুই বুঝলাম না।”রবি নড়বড়ে হয়ে গেল। – “আমি তোমাকে এড়িয়ে যেতে চাই কেন? তারপর… কিসের জন্য?”

“তাহলে তুমি আমার কাছ থেকে পালাতে চাও না?”নিক্কি তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো – “তাহলে এত দূরে দাঁড়িয়ে আছো কেন? এখানে এসে আমার পাশে বসো।”

রবির মনটা খারাপ হয়ে গেল। তাকে কিছুতেই উত্তর দিতে বাধ্য করবেন না। “নিক্কি জী, কি বলছো, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। যা বলতে চাও, পরিষ্কার করে বলো।”

“এত নির্বোধ হয়ো না, রবিজি।”নিক্কি উঠে দাঁড়িয়ে বললো- “এই সময়ে এখানে কেন এসেছি বুঝতে পারছ না? তবে স্পষ্ট শুনতে চাইলে শোন।”এই বলতে বলতে নিক্কি তার শরীরের চারপাশে জড়ানো চাদরটা খুলে ফেলল – “আমি তোমার সাথে সেক্স করতে চাই।”

বাকরুদ্ধ সূর্য! অশ্রুসজল চোখে নিক্কির দিকে তাকিয়ে রইল। সে স্বপ্নেও ভাবেনি যে এই মেয়ে তার সাথে এত নির্লজ্জভাবে সেক্স করার কথা বলতে পারে। তার চোখ মুখ নীচু হয়ে গেল। যখন তার চোখ নিক্কির স্তনের উপর পড়ল, তখন পিঁপড়া তার শরীরে হামাগুড়ি দিয়ে গেল। নিক্কির স্বচ্ছ পোশাকে কিছুই লুকিয়ে ছিল না। উপরের পুরো অংশটি স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। সে ভিতরে ব্রা পরেনি। তার টানটান স্তন এবং বাদামী বোটা খাড়া হয়ে উপরে দৃশ্যমান। নাইটিটি এত ছোট ছিল যে এটি কেবল কোমরের একটু নিচ পর্যন্ত ঢেকে রাখতে সক্ষম ছিল, আর সেই আবরণ ছিল একই। নাইটির ভিতর থেকে তার প্যান্টি দেখা যাচ্ছিল। রবির চোখ যখন তার ফোলা গুদের উপর পড়ল, তখন তার মুখ থেকে “আহহ”বের হতে থাকলো। তার ভারী ভারী উরুগুলো রবির ভেতর লুকিয়ে থাকা তার যৌবনের চেতনাকে প্রবাহিত করছিল। নিজের ভেতরে কিছু একটা গলে যাচ্ছে অনুভব করে। তার কানের ধমনী দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হতে থাকে। সে অনুভব করল তার পায়ের শক্তি কমে যাচ্ছে। পুরো অজ্ঞান হয়ে পড়ার আগেই সে মুখ ফিরিয়ে নিল। আর ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে নিজের বিছানায় এসে যড়ষড় হয়ে বসে।

“কি হয়েছে রবিজি? নিক্কি ওর কাছে এসে বললো।

রবি নিক্কির গলায় ঘাড় তুলল, তার চোখ নিক্কির সাথে মিলিত হল। নেশায় চোখ ভরে গেল তার দিকে তাকিয়ে। নিক্কি এক হাত দিয়ে তার উরুতে আদর করতে শুরু করে এবং তারপরে অন্য হাতটি তার স্তনের উপর নাড়াতে শুরু করে।

রবির কপাল থেকে ঘাম গড়িয়ে পড়ল। তার বাঁড়া পায়জামার ভিতর থেকে হাসফাস করতে লাগল। সে চোখ ঘুরিয়ে নিল।

“কি হয়েছে রবি? তুমি আমার থেকে চোখ লুকাচ্ছো কেন? আমাকে পছন্দ করো না? তুমি মনোযোগ দিয়ে দেখ রবি, আমার শরীরের অংশ সৌন্দর্যে ভরপুর। আমার স্তনের দিকে তাকাও, ওগুলো কত শক্ত। ওদের ছুঁতে হাত লাগাও। রবি এর কঠোরতা অনুভব কর।” নিক্কি বলল এবং রবির হাত ধরে ওর স্তনে রাখতে চাইল। কিন্তু রবি হাত টেনে নেয়।

“এখান থেকে চলে যাও নিক্কি। তুমি এই মুহুর্তে সচেতন নও। সকালে কথা হবে।” রবি তার থেকে ঘুরে মুখ ফিরিয়ে কথা বলল।

নিক্কি তার উদাসীনতায় খুব রাগ হয় কিন্তু সে তার রাগ গিলে এগিয়ে গিয়ে রবির পিঠে আঁকড়ে ধরলেন। “রবি আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিও না, একটা মেয়ে যখন তার প্রকাশ্য লজ্জা ঘুচিয়ে একজন পুরুষের কাছে আসে, তখন সে খুব বাধ্য হয়ে আসে। এমন অবস্থায় সেই লোকটার জন্য তার অনুভূতির মুল্য দেওয়ার দরকার হয়ে পড়ে। তুমি কি করছ? আমার প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে আমাকে অপমান করতে চাও?”

“এটি প্রেম নয়, এটি লালসা।” রবি এক ঝাঁকুনি দিয়ে আলাদা হয়ে বললো “তুমি যাকে ভালোবাসা বলছো সেটা ভালোবাসা নয়, ভালোবাসা আর লালসার মধ্যে অনেক পার্থক্য।”

নিক্কির পারদ চড়ে গেল, সে গলার স্বর উচু করে বলল- “কি পার্থক্য?”

“ভালোবাসা এবং লালসার মধ্যে পার্থক্য হল প্রেম ত্যাগ চায় এবং লালসা পূর্ণতা”। রবি জবাব দিল। “দুটি দেহের মিলন না হয়েও প্রেম সম্পূর্ণ হয়, কিন্তু লালসা পূর্ণ হয় দুটি দেহের মিলনে। কিন্তু তুমি হয়তো পার্থক্য বুঝবে না। কিন্তু আমি পার্থক্যটা বুঝি। তাই আমি এমন কোনো কাজ করি না যাতে পরে আমাকে লজ্জিত হতে হয়।”

রবির কথায় নিক্কি মনে মনে একটা কাঠির মত হয়ে গেল। রবির কথায় তার রোম-রোম ধূলিসাৎ হয়ে গেল। আজ পর্যন্ত কেউ তাকে এভাবে অপমান করেনি। অপমান তো দূরের কথা, আজ পর্যন্ত কেউ নিক্কিকে অস্বীকার করার সাহস করেনি।

নিক্কি কিছু বলল না, রবিও চুপ করে থাকে। সে সেখানে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ জ্বলন্ত চোখে রবির দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর হঠাৎ ঘুরে দরজার বাইরে চলে যায়। মাটিতে পড়ে থাকা চাদরটাও তুলল না। ওকে এমন অবস্থায় বের হতে দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল রবি। কিন্তু কিছু বলার আগেই নিক্কি তার ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সে একই অবস্থায় নির্ভয়ে করিডোর পেরিয়ে নিজের ঘরে পৌঁছে গেল। রুমে ঢোকার সাথে সাথে বিছানায় পড়ে কাঁদতে লাগলো। সে কাঁদতে বাধ্য। জীবনে পরাজয় দেখেননি। কিন্তু আজ সে পরাজিত হল। আজ প্রথমবারের মতো সে তার সীমানা থেকে নিচে থাকা কারো সামনে তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু হতাশা ও অপমান ছাড়া কিছুই পায়নি। সে অপমানিত হয়েছিল। রবি তার ভেতরের নারীকে অপমান করেছিল। লালসার আগুনে পুড়তে থাকা নারীকে কেউ যখন অসম্মান করে, তখন সেই নারী আহত সিংহীর চেয়েও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। এটা অনেকটা সাপের মত যার লেজের উপর একজন মানুষের পা পড়ে তখন যতক্ষণ না সে তার লেজে পা দেয়া ব্যক্তিকে কামড়ায় ততক্ষণ সে স্বস্তি পায় না। এই জাতীয় মহিলা প্রতিশোধের চেতনায় নিজের চেয়ে বেশি ক্ষতি করে।

নিক্কি বিছানায় মুখ লুকিয়ে কিছুক্ষণ কাঁদতে থাকে। তারপর তার দুঃখ হালকা করে সে উঠে আয়নার সামনে দাঁড়াল। আয়নায় নিজের দিকে তাকাল সে। সবকিছু একই আছে। সেই একই সুন্দর শরীর, পাহাড়ের মতো উঁচু উঁচু চূড়া, একই চ্যাপ্টা মসৃণ পেট, সেই একই কোমর যা হাজারো হৃদয়ে বিদ্যুৎ চমকিছে, প্যান্টিতে একই ফুঁপানো গুদ, একই ফর্সা আর বাঁকা উরু। কিন্তু এই সময়ে সে তার সৌন্দর্য দেখে প্রতিটি অংশই তার কাছে অসহ্য লাগছে। রাগ আবার তার চোখে উঠতে শুরু করেছে। রবির কথা আবার তার কানে বিষ ঢালতে লাগল। সে মনে মনে বিড়বিড় করে বললো – “মিস্টার রবি, আমি যদি তোমাকে আমার পায়ে প্রণাম না করাই, তবে আমি ঠাকুরের মেয়ে নই। আমি তোমাকে এত জোর করব যে তুমি নিজেই আমার আশ্রয়ে আসবে। এটা নিক্কির জেদ। মাথা নত করতে হবে।” তার সপথ ছিল ইস্পাতের মত দৃঢ়। সে ঘুরে বিছানায় ছড়িয়ে পড়ল। আর চাদর ঢেকে ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগলো।

 

১২

নিক্কি চলে যাওয়ার পর রবি দরজা বন্ধ করে বিছানায় ঢুকল। তারপর চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করল। চোখ বন্ধ করতেই চোখের সামনে নিক্কির আগুনের মত শরীর নেচে ওঠে। তার শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে নির্গত যৌবনের স্ফুলিঙ্গের উত্তাপ তাকে আবার জ্বালিয়ে দিতে থাকে। তার ধমনীতে প্রবাহিত রক্ত আবার গরম হতে থাকে। অবশ্যই রবি নিক্কির প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিল, কিন্তু সে তার সৌন্দর্যের সম্মোহন থেকে বাঁচতে পারেনি। সে ছিল দৃঢ় সংকল্পের মানুষ। তবে এটাও সত্যি যে আজ সে যা দেখেছে তা তার কাছে সম্পূর্ণ নতুন। রবি সারা জীবনে কোন মেয়েকে এমন যৌনতায় জ্বলতে দেখেনি। এখনকার মেয়েরা কি সত্যিই এমন? যারা বাবা-মা নির্বিশেষে যে কারও সামনে কাপড় খুলে ফেলতে দ্বিধাবোধ করে না। রবি সাইকোথেরাপিস্ট হলেও মেয়েদের প্রতি তার জ্ঞান ছিল শূন্য।

কারণ ছিল তার লাজুক স্বভাব।.আর মায়ের প্রতি প্রবল ভক্তি! তার মায়ের ইচ্ছা ছিল সে যেন ডাক্তার হয়, সাধারণ পরিবারের হয়েও তার মা তার পড়ালেখায় কোনো ঘাটতি করতে দেননি। তার বাবা… যখন তার বয়স ৫ বছর, তাকে কাজের জন্য কোথাও চলে যেতে হয়েছিল, যিনি আর কখনও বাড়ি ফেরেননি। তার বাবা বেঁচে আছে কি না ওপরওয়ালাই জানে। তার মা নিজে লাখো দুঃখের মধ্যেও তাকে কোনো কিছুর অভাববোধ করতে দেননি। সেও ছোটবেলা থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে সে তার মায়ের স্বপ্ন পূরণ করবে। এই কারণেই যখনই কোন মেয়ে তার পাশ দিয়ে যেত, সে কলেজের সেক্সি এবং হৃদয়গ্রাহী মেয়েদের দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিত। বয়ঃসন্ধিকালে সে এতটাই লাজুক ছিল যে কোনও মেয়ে তাকে ডাকলে ঘামত। তার হাত-পা ফুলে উঠল যেন কোনো যোদ্ধা তাকে যুদ্ধের জন্য চ্যালেঞ্জ করেছে। তার এই স্বভাবের কারণে তার বন্ধুরা তাকে অনেক জ্বালাতন করত, তাদের প্রেমের রসালো গল্প শুনিয়ে উত্যক্ত করত। রবি যখন তার বন্ধুদের মুখ থেকে তাদের প্রেমের গল্প শুনত, তখন তারও একটি সুন্দরী মেয়েকে নিজের করার ইচ্ছা জেগে উঠত, তখন তার ভিতরের মানুষটি তাকে বলত যে তুমিও একটি প্রেমিকা বানাও। সেই অবস্থায় তখন তার মায়ের কথা তার পা বেঁধে দিত। মায়ের দুঃখকে যত্ন করে ধারন করে বুকের মধ্যে জেগে ওঠা কামনাগুলোকে সে নিবারণ করত। সে ছিল বইয়ের পোকা, বই তার একাকীত্ব দূর করে, বইই তার প্রেমিকা। সে প্রেমের অনেক গল্প পড়েছে, বন্ধুদের কাছ থেকে যৌনতা ও লালসার গল্পও শুনেছিল। কিন্তু সে নিক্কির মতো কোন মেয়ের কথা পড়েনি, কোনো বন্ধুও তাকে এমন মেয়ের কথা জানায়নি। সে অন্যরকম…..সবচেয়ে আলাদা!

রবি জীবনে কখনও বিরক্ত হয়নি, তার মন খুব শক্ত ছিল, কিন্তু আজ নিক্কি তাকে বিরক্ত করেছিল। তার মনে এখন একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল। “তার এখন কি করা উচিৎ? নিক্কির মত মেয়ে শান্তিতে বসার মেয়ে নয়, সে আবার চেষ্টা করবে, নয়তো অপমান করে তার অপমানের প্রতিশোধ নেবে। এমন অবস্থায় তার কাছে রক্ষা করার জন্য মাত্র দুটি বিকল্প ছিল, হয় ঠাকুরকে তার সব সত্য বলা উচিত, তারপর তাকে এখান থেকে চুপচাপ চলে যেতে হবে। প্রথম বিকল্পটি তার কাছে বিরক্তিকর মনে হয়েছিল। নিক্কির কান্ডের কথা বলে সে ঠাকুর সাহেবকে হত্যা করতে চায়নি, এমনিতেই তিনি রাধা দেবীর দুঃখে অর্ধেক মৃত। এখন নিক্কির অপকর্ম জেনে সেই ভালো মানুষটি পুরোপুরিই মারা যাবে। এখন অন্য উপায় ছিল প্রাসাদ ছেড়ে চলে যাওয়া। কিন্তু এখান থেকে চলে যাওয়া মানেই তার চিকিৎসা পেশাকে অপমান করা, ঠাকুর সাহেবকে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে তার স্ত্রী রাধাকে সুস্থ না করে এখান থেকে যাবে না। ঠাকুর সাহেব গত ২০ বছর ধরে বেঁচে ছিলেন এই আশায় যে কোন ডাক্তার তার স্ত্রীকে সুস্থ করবে। কত ডাক্তার এসেছে আর টাকা খেয়ে গেছে তার ইয়াত্তা নেই। ঠাকুর সাহেব রবির উপর খুব আশা করে আছেন।এখন যাই ঘটুক না কেন, সে এখানেই থাকবে, শুধুমাত্র একটি মেয়ে তার জীবনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, আর কোন চরিত্রহীন মেয়ে তো কিছুতেই না! সে প্রাসাদ ছাড়বে না, নিক্কি তার সৌন্দর্যের লাখো বজ্রপাত ঘটালেও না, তার সামনে নগ্ন হয়ে শুয়ে থাকলেও সে নড়বে না। সে তার অভিপ্রায় দৃঢ় করে এবং চাদরটি প্রসারিত করে ঘুমানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে।

****

রবি তার নিয়মিত সময়ে ঘুম থেকে উঠে, গোসল সেরে জুস ও ওষুধ নিয়ে রাধা দেবীর ঘরে গেল। এই ছিল তার প্রতিদিনের কাজ, দিনে দুবার রাধা দেবীকে ওষুধ ও জুস দিতে হতো, একবার সকাল ১০ টায় এবং আরেকবার রাত ৯ টায়। এ সময় তার সঙ্গে থাকে নিক্কিও। আজও রবি আর নিক্কি রাধা দেবীর ঘরে গেল কিন্তু দুজনে এবার একে অপরের থেকে দূরে। হ্যাঁ রবি নিক্কিকে রাধা দেবীর সামনে আসা থেকে আটকাতে পারেনি আজ। নিক্কি তার সাথে আটকে থাকল যতক্ষণ সে সেখানে থাকল। রাধা দেবীর ঘরে নিক্কি কখনো রবির কাঁধে মাথা রাখে, কখনো রবির বাহুতে তার স্তন ঘষে, আবার কখনো এমন ক্ষুধার্ত দৃষ্টিতে তার চোখের দিকে তাকাত যে রবির লোম দাঁড়িয়ে যেত। কোনরকমে কাজ সেরে রবি নিজের রুমে চলে এলো। তার মন ফুঁসে উঠে। সারাদিন নিজের ঘরে শুয়ে নিক্কির কথা ভাবতে থাকে। কিন্তু নিক্কিকে নিয়ে যতই ভাবতে থাকে তার মন খারাপ হতে থাকে।

বেলা ৩ টার দিকে প্রাসাদ থেকে বের হয়। তখন খুব রোদ, কিন্তু রবি প্রাসাদের বাইরে যেয়ে নিক্কির চিন্তা থেকে দূরে সরে যেতে চেয়েছিল। সে তার বাইক নিয়ে পাহাড়ের দিকে রওনা দিল। উপত্যকায় পৌঁছে সে তার বাইক থামিয়ে পায়ে হেঁটে ঝর্নার দিকে এগিয়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা বিশাল ঝর্নার কাছে এসে দাঁড়ালো সে। দাঁড়িয়ে লেকের ঝর্না দেখতে থাকে। সে ভাবল এত কোলাহল সত্ত্বেও কত শান্তি। আর প্রাসাদে কোলাহল না থাকলেও শান্তি নেই। সে একটু এগিয়ে গেল, হ্রদে জল পড়া দেখার ইচ্ছা। কারণ সে যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখান থেকে লেকের পৃষ্ঠ দেখা যাচ্ছিল না। সে আগে পদক্ষেপ ফেলে। সে তার ডানদিকে মাত্র দুই কদম হেঁটেছে এবং সে বুঝতে পারে কেউ সেখানে আছে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে একটা মেয়ে পাথরের উপর বসে আছে। মেয়েটির শরীরের অর্ধেক অংশ পাথরের আড়ালে লুকানো ছিল। শুধু মেয়েটির বাম কাঁধটি বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে। দমকা হাওয়ার কারণে তার লম্বা চুলগুলো বারবার উড়ছে, যা একটি মেয়ের অস্তিত্বের প্রমাণ দিচ্ছে। মেয়েটাকে দেখতে রবি একটু এগিয়ে গেল। এখন সে মেয়েটির মাত্র দশ কদম পিছনে দাঁড়িয়ে। সেখান থেকে তাকে হাল্কাভাবে দেখতে পায়। শুধু দেখতেই পায়নি, এখন রবি তাকে চিনতেও পেরেছে। কাঞ্চন। সে তখনও একই পোশাকে ছিল যেটা রবি তার ভাইয়ের সাহায্যে চুরি করেছিল তাকে শিক্ষা দিতে। সে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল, সে ভয় পেল যে সে তার দিকে ফিরে তাকাবে, কিন্তু না, সে মনে হয় গভীর কোন চিন্তায় মগ্ন। তার চোখ স্থির হয়ে আছে পড়তে থাকা ঝর্নার দিকে। হঠাৎ রবির মাথায় একটা চিন্হা তড়িৎ খেলে যায়। এই মেয়ে আত্মহত্যা করতে এসেছে না তো? শহরগুলোতে যেমন বাস বা ট্রেনের নিচে পড়ে আত্মহত্যা করার রেওয়াজ আছে, তেমনি গ্রামে পাহাড় থেকে ঝাঁপ দিয়ে, কুয়ায় ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করার প্রবনতা আছে। পরের মুহুর্তে তার মনে প্রশ্ন জাগলো “কিন্তু কেন সে মরতে চায়? এই বয়সে কি এমন হয়েছে যে সে মরতে প্রস্তুত। গতকাল যা বলেছিলাম তাতে সে কোন দুঃখ পেয়েছে? যার জন্য সে তার জীবন দিতেও প্রস্তুত? এমন কিছু কি ঘটতে পারে? এই মানুষগুলো খুব নাজুক মনের হয়। মেয়েটি গভীর লেকে বিলীন হওয়ার আগেই ডেকে উঠল- “এই মেয়ে, মরতে চাও কেন?”

রবির কন্ঠ তার কানে পড়ার সাথে সাথে সে হতভম্ব হয়ে ঘুরে গেল। তার মুখে গভীর দুঃখের আস্তরণ ছিল, তার চোখ এমন লাল ছিল যেন সে সারারাত ঘুমায়নি। রবি অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

“আপনি …..! “অবাক হয়ে রবির দিকে তাকিয়ে বললো কাঞ্চন, তারপর মৃদু হাসলো। ওর হাসিটা ছিল মরার মতন। যার মধ্যে ব্যথা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। মেয়েটা আরও বলল- “আমি কেন মরব? আর আপনি কেন আমাকে মারতে চান? আপনি কি আমাকে এতটাই ঘৃণা করেন যে আমি বেঁচে থাকলেও আপনার ভালো লাগে না?”

কাঞ্চনার কথায় ব্যঙ্গে পরিপূর্ণ। রবি লাল হয়ে গেল। সাথে সাথে কোনো উত্তর দিতে পারল না। খানিক পড়ে সে ছটফট করতে করতে বললো- “আমি তা বলতে চাইনি, তুমি ঝর্নার এত কাছে দাঁড়িয়ে ছিলে যে আমার এমন মায়া হয়েছিল যে তুমি হয়ত তোমার জীবন দিতে চাও। আমি দুঃখিত।“ মৃদুস্বরে বলল রবি।

“আমি এত দুর্বল মেয়ে নই যে কারো অবজ্ঞায় দুঃখ পেয়ে জীবন দিয়ে দেব। আমি আমার জীবনকে ভালোবাসি।”কাঞ্চন বিষণ্ণ চিত্তে কথা বলে সেখান থেকে উঠে চলে যেতে থাকে।

কাঞ্চনের কথায় রবি একটা ব্যাথা অনুভব করলো, ওর মনে হলো সে যেন ভেতরে ভেতরে কাঁদছে। রবি নির্দোষ হলেও কেন জানি কাঞ্চনের দুঃখ-দুর্দশার জন্য নিজেকেই দায়ী মনে হলো। কাঞ্চনের কথাগুলো সে মনে মনে অনুভব করল। সে কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকে যেতে দেখল তারপর পিছন থেকে ডাক দিল – “শোন…”

কাঞ্চন রবির ডাকে থেমে গেল, তারপর ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল। রবি ধীরে ধীরে হেঁটে তার কাছে গেল। “কি হয়েছে? এত মন খারাপ কেন?”

রবি এত অন্তরঙ্গভাবে জিজ্ঞাসা করেছিল যে কাঞ্চন আবেগে ভরে যায়। যখন কেউ দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়কে ভালবাসায় স্নেহ করে, তখন সেই মনটি তার নিজের সম্পর্কের স্নেহের সাথে আরও বেশি আবেগী হয়ে ওঠে। রবির অন্তরঙ্গভাবে কাঞ্চনকে জিজ্ঞাসা করা তাকে আরও আবেগপ্রবণ করে তুলেছিল। সে তার আবেগ সংবরণ করতে পারল না এবং তার চোখ জলে ভরে গেল। কিছু উত্তর না দিয়ে সে শুধু ভেজা চোখে রবির দিকে তাকিয়ে রইল। সে বলবে কি? সে নিজেও জানত না তার কি হয়েছে। হঠাৎ কেন তার পৃথিবী বদলে গেল, কেন সে এখন আগের মতো কথা বলে না, কেন সে এখন একা থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে। তার মন কেন সবসময় চায় যে সে একা বসে শুধু তার স্যারের কথাই ভাবুক।

“আরে … এটা কি?” চোখের কোণে জলের ফোঁটা দেখে রবি বলল- “কাঁদছো তুমি? কোন সমস্যা হলে বলো। কেউ কিছু বলেছে?”

“আপনি যান স্যার, আমি হাসছি না কাঁদছি তাতে আপনার কি করার আছে। আমার হাসি কাঁদাতে আপনার মান-সম্মান ক্ষুন্ন হবে না।” কাঞ্চন বলল।

“গতকাল যা ঘটেছিল তার জন্য যদি তুমি দুঃখ পেয়ে থাক তবে দয়া করে আমাকে ক্ষমা করবে। কিন্তু তুমি নিজেই ভাব সেদিন প্রাসাদে আমার কাপড়ের কী হয়েছিল – ঠিক আছে?”

Leave a Reply