উপন্যাস পার্ট

কাঁচের প্রাসাদ – (১৩-২৪)

সূচীপত্র || কাঁচের প্রাসাদ – (২৫-৩৪)

১৩

কাঞ্চন কিছু বলল না, শুধু ভেজা চোখের পাতায় রবির দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকল। “স্যার আমাকে ভুল বুঝেছেন, তিনি মনে করেন আমি তার জামা পুড়িয়ে দিয়েছিলাম। আমাকে অপরাধী মনে করেন।” কাঞ্চনের মনে একটা ভাবনা জেগে উঠল। এটা উপলব্ধি করে সে আঁতকে উঠল, কিভাবে তার স্যারকে বলবে যে সে সেদিন প্রাসাদে ঠিকই কিন্তু তার জামাকাপড় পুড়িয়ে দেয়নি। নিক্কি তার জামাকাপড় পুড়িয়েছিল, সে কেবল নিক্কির চাপে পড়ে তার ঘরে কাপড় রাখতে গিয়েছিল। কিছু বলার জন্য তার ঠোঁট নড়ল, কিন্তু শুধু চোখ ছলছল করছে, মুখ দিয়ে কথা বের হলো না।

“তুমি কি সত্যিই দুঃখিত কারণ আমি তোমাকে গতকাল নদীর তীরে কিছু কটু কথা বলেছিলাম?” তাকে চুপচাপ দেখে রবি আবার জিজ্ঞেস করল।

“না স্যার ….সেদিন নদীর জলে আপনার মুখ থেকে যে কটু কথা বেরিয়েছিল, আমার কাছে মধুর চেয়েও মিষ্টি লেগেছিল। আমি দুঃখিত কারণ… আমি আপনাকে…..!” সে এর পরে আর কথা বলতে পারে না। হঠাৎ তার মুখের রঙ দ্রুত বদলে গেছে। যে মুখ কিছুক্ষণ আগে দুঃখে ফ্যাকাশে ছিল, সেই মুখ এখন লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। সে আবার মাটির দিকে তাকাতে লাগলো।

“আমি আপনাকে কি?” রবি কিছুটা হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করল।

জিজ্ঞেস করায় কাঞ্চন চোখ তুলে ওর মুখে স্থির করল। বড় বড় চোখ করে রবির দিকে তাকিয়ে রইল। একবার ভাবে তাকে বলে – “স্যার, আমি আপনাকে ভালোবাসি, আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই। আপনি কি আমাকে আপনার পাত্রী বানাবেন? আমি দিনরাত আপনার সেবা করব, আমি কখনও অভিযোগ করার সুযোগ দেব না। আপনি যেমন রাখবেন, আমি তেমনই হব। আমি কখনই কিছু চাইব না। তুমি যা দেবে আমি তাই রাখব, তুমি যা পরবে তাই আমি পরব। শুধু আমার হয়ে আমাকে তোমার করে ফেল।” কিন্তু সে বলতে পারল না – “যান… বলবো না, আপনি বড়….” কাঞ্চন জোরে জোরে কথা বলে এবং বাড়ি ফেরার পথে তাড়াতাড়ি দৌড়ে গেল।

রবি ওকে যেতে দেখছিল। সে তখনও কিছু বুঝতে পারেনি। সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সে যা বলছে তা ভাবতে থাকে। তারপর মাথা আঁচড়ে বাইকের দিকে এগিয়ে গেল। এখন নিক্কির বদলে মনে স্থির হয়ে গেল কাঞ্চন।

কিছুক্ষণ পর সে তার বাইকটি যেখানে দাঁড় করিয়েছিল সেখানে এলো, সে বাইক থেকে একটু দূরে থাকতেই তার চোখ বাইকের দিকে যেতেই তার চলন্ত পা থেমে যায়। মুখে বিভ্রান্তির রেখা। একজন গ্রামবাসী তার বাইকে বসে আছে। তার গায়ে কালো কুর্তা এবং কোমরে লুঙ্গি জড়ানো। উচ্চতা হবে প্রায় ৬ ফুট। বুক ছিল চওড়া এবং শরীর ছিল ক্রীড়াবিদের মত। মুখে ছিল বড় এবং ঘন গোঁফ। তার বয়স প্রায় ৩২-৩৩ বছর হবে। সে সাইকেলে বসে গ্রামের পথের দিকে তার চোখ স্থির, যেন কারো পথ দেখছে বা কাউকে যেতে দেখছে। মুখে পান। পথের দিকে তাকিয়ে বারবার পিচকারি মাটিতে ফেলছিল। এই ছিল বিরজু। গ্রামের সবচেয়ে নিকৃষ্ট বখাটে, টাকা নিয়ে কারো পা ভাঙ্গা, দুর্বলকে ভয় দেখানো ছিল তার পেশা। যাইহোক, সে মহিলাদের প্রেমিক ছিল। ১৮ বছর বয়স থেকে সে গ্রামের কুমারী মেয়েদের রস চুষতে আসত। গ্রামের অনেক মেয়ে ও নারীকে সে পায়ের নিচে শুইয়ে দিয়েছে। কাউকে স্বপ্ন দেখিয়ে কাউকে এত জোর করতো যে নিজেই বাহুতে ঢলে পড়তো। গ্রামের মানুষ তার থেকে দূরে থাকত, তার বন্ধুত্ব ও শত্রুতা দুটোই অন্য মানুষের জন্য ক্ষতিকর ছিল। যে কারণে কেউ তার বিরুদ্ধে কথা বলত না। আর তখন তার মাথায় ছিল গ্রামের মুখিয়া জির হাত। বিরজু তার কাজ করে। যদিও মুখিয়াজি খুব ভালো মানুষ, গ্রামে সবার সাথেই তার ভালো সম্পর্ক ছিল, কিন্তু বিরজুর বিরুদ্ধে কেন জানি কিছু শুনতে তার ভালো লাগত না। গ্রামের কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে বিরজুর বিরুদ্ধে কিছু শুনলেই তার ওপর বর্ষণ করতেন। তাই গ্রামের মানুষ নিজেদের মুখ বন্ধ রাখত।

বিরজু গত ১৫ বছরে অগণিত মেয়ে ও নারীর সর্বনাশ করেছে। কিন্তু কয়েক বছর ধরে তার চোখ শুধু একটি মেয়ের দিকেই স্থির ছিল, সে কাঞ্চন…! যখনই সে তার শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে পাশ কাটিয়ে যেতে দেখত, তখনই তার ভেতরের প্রাণীটি জেগে উঠত। তখন তার মনে একটাই চিন্তা আসত- যে করেই হোক, একবার কাঞ্চনে চড়তে হবে। একবার তাকে খেতে হবে। কিন্তু কাঞ্চনের স্বপ্ন দেখা যতটা সহজ তা অর্জন করা ততটাই কঠিন। কাঞ্চন খুব ভালো মেয়ে ছিল, সে জানতো ভুলিয়ে সে কখনো কাঞ্চনের যৌবনের রস চুষতে পারবে না, আর জোর করার মানে তার মৃত্যুতে ভোজ করা। তার বাবা সুগনা তার সময়ে বিরজুর চেয়েও বড় গুন্ডা ছিলেন। বিরজু এতদিন শুধু মানুষের হাত-পা ভেঙেছে, কিন্তু কত লাশ যে ফেলেছে সুগনা তা সে নিজেই জানে না। কিন্তু সুগনাই শুধু বিরজুর কাঞ্চনের কাছে পৌঁছানোর একমাত্র কাঁটা ছিল না। কোনোভাবে সুগনাকে পথ থেকে সরিয়ে দিলেও কাঞ্চনের কাছে পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব ছিল। কারণ ছিল নিক্কি, নিক্কির বন্ধুত্ব ছিল কাঞ্চনের ঢাল। পুরো গ্রামের নারী পুরুষদের মধ্যে কাঞ্চনই একমাত্র যার প্রাসাদে প্রবেশ করার অধিকার ছিল। তিনি চাকরদের আদেশ দিতে পারতেন, যতদিন ইচ্ছা রাজবাড়ীতে থাকতে পারতেন, ঠাকুর সাহেব তাকে নিজের মেয়ের মতই স্নেহ করতেন। বিরজু জানত কাঞ্চনের গায়ে হাত ধরার সহজ মানে ঠাকুরের ঘাড়ে হাত দেওয়া। আর ঠাকুরের ঘাড়ে হাত দেওয়া মানেই তাঁর মৃত্যু! এই কারণেই দূর থেকে কাঞ্চনকে দেখেই তৃষ্ণা মেটাত। আর তখন পর্যন্ত ঠাকুর তার সম্পর্কে কিছুই জানত না। এখন পর্যন্ত ঠাকুর সাহেবের কাছে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ পৌঁছায়নি। বিরজু নির্যাতিত মানুষ মনে করে যে, ঠাকুর সাহেব নিজেই বিশ বছর ধরে দুঃখ-দুর্দশায় দিন কাটাচ্ছেন, তাদের দুঃখ শুনিয়ে তার দুঃখ বাড়ানো ঠিক হবে না, তাই তারা চুপচাপ ছিল।

বিরজু সেই কুমিরে পরিণত হয়েছিল যে ধীরে ধীরে পুরো গ্রাম চাটছিল। কিন্তু কাঞ্চনের মধ্যে যা ছিল তা কারো মধ্যে ছিল না। প্রতিদিন সে তা অর্জনের জন্য কিছু পরিকল্পনা করত, কিন্তু ঠাকুরের কথা মাথায় আসার সাথে সাথেই তার সমস্ত পরিকল্পনা পরিত্যক্ত হয়ে যায়। আজ যখন সে কাঞ্চনকে এভাবে একা একা ঘুরে বেড়াতে দেখল, খুব অবাক হল। কাঞ্চন কখনো এভাবে একা হাঁটত না। কিন্তু রবির বাইকের দিকে চোখ পড়লে তার কৌতূহল বেড়ে যায়, কাঞ্চন কারো সাথে দেখা করতে এসেছে। তাই সে সেখানে বাইকে বসে সেই লোকটির জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। কাঞ্চন যে পথ দিয়ে গেছে সেদিকেই সে তখনও তাকিয়ে আছে।

ঘাড় সোজা করতেই চোখ পড়ল রবির দিকে। রবিকে দেখে সে তার কালো দাঁত দেখিয়ে হাসল।

রবি অকপটে তার বাইকের কাছে গেল। সে বিরজুকে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত সারসরি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো – “আমি আপনাকে চিনতে পারছি না। আপনার পরিচয়?”

বিরজু তখনও তার বাইকে বসে ছিল, সে এটাকে তেমন গুরুত্বপূর্ণ মনে করেনি। সে রবির দিকে তাকিয়ে মাটিতে পানের পিক মারল, তার মনে হল যেন সে রবির গায়ে থুথু ফেলছে। তারপর বলল- “বাবু জি বিরজু নামটা আমার।” সে গোঁফ নাড়ল- “রায়পুরের ছেলেমেয়েরা আমাকে চেনে। তিন গ্রামে আমার মতো কুস্তিগীর নেই।”

“আপনার সাথে দেখা করে খুব খুশি হলাম।” রবি উত্তর দিল – “এখন দয়া করে আপনি কি আমার বাইক থেকে উঠবেন?”

“অবশ্যই … উঠুন।” সে হেসে বলল- আমি আপনার বাইক পাহারা দিচ্ছিলাম।

“পাহাড়া?” রবি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাল।

“এই গ্রামে, কিছু চোর ঘোরাফেরা করে, সুযোগ পেলেই অন্যের জিনিসে হাত পরিষ্কার করে। আমি আপনাকে এইজন্য বলছি কারণ আপনি প্রাসাদের অতিথি।”

“আপনি কি করে জানলে আমি প্রাসাদের অতিথি?” বাইকে বসে রবি বলল।

“কি বলেন বাবুজী, এই গ্রামে কে আছে যে আপনাকে চেনে না?” তার কথায় হাসি ফুটল। “কেউ একজন প্রাসাদে এসেছে আর তা লোকে জানবে না এমন কখনো ঘটেনি। এই গ্রামের প্রতিটি মানুষ জানে আপনি একজন ডাক্তার এবং ঠাকুরাইনের চিকিৎসা করতে এসেছেন।”

“ওহহহহ…!” বেরিয়ে এল রবির মুখ থেকে।

“কিন্তু একটা জিনিস বুঝলাম না বাবুজী।” বিরজু কাঁটা দৃষ্টিতে রবির দিকে তাকিয়ে বলল – “আপনি তো ঠাকুরাইনের চিকিৎসা করতে এসেছেন, কিন্তু আমাদের গ্রামের মেয়েকে নিয়ে এখানে একা কি করছিলেন?”

রবি কেঁপে উঠল। কী বলবে বুঝতে পারছে না, হঠাৎ এই প্রশ্ন করায় হাত-পা ফুলে উঠল। “দেখুন, কাঞ্চনের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই, আমি এখানে ঘুরতে এসেছিলাম, তার সাথে আমার দেখা হয়ে গেছে।”

“আপনি কি করে জানলেন ওর নাম কাঞ্চন?” বিরজুর কণ্ঠে তীক্ষ্ণতা।

রবি চমকে উঠল। একটা স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ল তার শরীরে। তার ভয় পাচ্ছে এই কারণে না যে সে বিরজুকে ভয় পায়। তার ভয় ছিল যে তার কারণে গ্রামে কাঞ্চন অপমানিত হতে পারে। “সে নিজেই বলেছে।” রবি নড়বড়ে বলল।

“আরে সাব, বেশি টেনশন নিবেন না, আমি মজা করছিলাম।” বিরজু আবার তার নোংরা দাঁত দেখাল।

জবাবে রবিও হাসল। তারপর নিজের বাইক স্টার্ট করার পর ঘুড়ে চলে গেল প্রাসাদের ভেতর দিয়ে।

বিরজু তাকে যেতে দেখতেই রইল। সে রবিকে সন্দেহ করছিল। উদ্বিগ্ন ছিল যে একজন বিদেশী মেয়েটিকে পেয়ে যাবে যা সে পেতে চায়। এই উপলব্ধি তার মনের শান্তি কেড়ে নিয়েছে যে কিছুক্ষণ আগে কাঞ্চন শহরের সাথে এই লোকটির সাথে নির্জন জায়গায় একা ছিল। এই ভাবনায় তার মন ভীত হয়ে পড়ে। ওই ডাক্তার কান্চনকে নিয়ে কী করেছে এখানে? কাঞ্চন এই লোকের ফাঁদে পড়ে তার শরীরটাকে ভোগ করার জন্য দিয়ে দিয়েছে না তো! এই গ্রামের নিষ্পাপ মেয়েরা বিশ্বাস করে খুব দ্রুত তাদের হৃদয় দিয়ে দেয় শহরের মানুষদের কাছে। যদি এমন হয়, তবে দুজনকেই মেরে ফেলব, কাঞ্চনের যৌবনের রস আর কেউ পান করতে পারবে না। আমাকে অবিলম্বে কিছু করতে হবে।

সে ভাবতে থাকে। সে এখনই রবির ব্যাপারে কিছু করতে পারছে না। রবি হয়তো ঠিকই বলেছে। প্রমাণ ছাড়া সে রবির কিছু করতে পারবে না। সে কিছুক্ষণ ভাবতে থাকল তারপর দ্রুত মুখিয়া জির বাড়ির দিকে চলে গেল। সে জানে তাকে কি করতে হবে। এখন যাই ঘটুক সে কাঞ্চন অর্জনের চেষ্টা করতে থাকবে।

কিছুক্ষণের মধ্যে বিরজু মুখিয়া জির বাড়িতে। এ সময় বাড়িতে শুধু মুখিয়া ধনপত রায়ের স্ত্রী সুন্দরী ছিল। তার বয়স হবে প্রায় ৩৫ বছর। সুন্দরী অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও সুন্দরী। এমনকি ৩৫ বছর বয়সেও তাকে ৩০ এর বেশি লাগে না। শুধু শরীরটা একটু ভারী। বিরজুকে দেখে চোখ চকচক করে উঠল। “আসুন মহারাজ….আজ চারদিন পর এসেছেন, কোথায় কুঁকড়ে যাচ্ছেন আজকাল?”

বিরজু সুন্দরীর কাছে গেল, তাকে কোলে তুলে সোজা বেডরুমে ঢুকল। তাড়াতাড়ি বিছানায় ফেলে সে তার বড় বড় স্তন মালিশ করা শুরু করে। “কি করছিস? আজকে কি প্রাণ নেওয়ার ইচ্ছা এসেছিস?” সুন্দরী একটা কাঁপুনি দিয়ে বলল।

কিন্তু বিরজুর মনে রাগ। তার মনে হল কাঞ্চন তার সামনে শুয়ে আছে, সুন্দরী নয়। এবং সে তাকে শাস্তি দিচ্ছে কারণে সে শহুরে লোককে বন্ধু করেছে।

 

১৪

সে দ্রুত সুন্দরীর কাপড় খুলতে থাকে। শরীর থেকে কাপড় টেনে খুলে বিরজু তার স্তনের উপর ঝাপিয়ে পড়ল। সে নির্দয় ভাবে স্তন চুষতে লাগল। সুন্দরী প্রথম দিকে ব্যথা অনুভব করলেও এখন ধীরে ধীরে ভালো বোধ করতে শুরু করে। বিরজুর আগ্রাসন তাকে আজ অন্যরকম মজা দিচ্ছিল। সে ওর প্রতিটি পদক্ষেপে সিৎকার করতে থাকে। তার শরীর খুব দ্রুত গলে যাচ্ছিল। ওর যোনি থেকে জল বেরোতে শুরু করেছে। বিরজু তার উরু পর্যন্ত এসে তার যোনি চুষতে থাকে এবং তার উরু চাটতে থাকে। সুন্দরীর মুখ থেকে কামুক দীর্ঘশ্বাস বেরোতে লাগলো। “উফফ…আহহহ কি করছিস বিরজু? কি হয়েছে তোর?”

বিরজু কিছু বলল না, এবার ওর যোনিতে জিভ রাখল, আর ওর রস চাটতে লাগল। আগুনে পুড়তে থাকে সুন্দরীর শরীর। সুন্দরীও আজ খুব কামুক হিসি করছিল। কিছুক্ষন ওর যোনি চাটার পর বিরজু উঠে দাড়িয়ে ওর জামা কাপড় খুলতে লাগলো।

সুন্দরী বিছানায় উঠে বসল, বিরজুর দিকে কামুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল, ওর পেটানো শরীর দেখে সে সব সময় এমনই করে চেয়ে থাকে। বিরজু জামাকাপড় খুলে আসার সাথে সাথে সে তার বাঁড়া ধরে তাকে আদর করতে লাগল। নরম উষ্ণ হাতের ছোঁয়ায় তার পুরুষালি অঙ্গটা কাঁপতে লাগল। বিরজু দেরি না করে সুন্দরীকে বিছানায় নামিয়ে দিল, তারপর পা চওড়া করে ওর যোনির দরজায় ওর অঙ্গ-প্রহরীকে বসিয়ে একটা ধারালো ধাক্কা দিয়ে গভীরে ঢুকিয়ে দিল।

“আহহহ … ” সুন্দরীর মুখ থেকে একটা নীরব চিৎকার বেরিয়ে এল।

বিরজু ওর পা দুটো চেপে ধরে ওর কোমরে জোরে ধাক্কা দিতে লাগল। তার প্রতিটি ধাক্কা এত শক্তিশালী ছিল যে সুন্দরী তার প্রতিটি ধাক্কার উপরে পিছলে যেতে থাকে।

প্রায় ১৫ মিনিট তাকে চড়ার পর বিরজু হাফাতে হাফাতে তার উপর পড়ে যায়।

বিউটি তাকে নিজের বাহুতে আকড়ে ধরে চুমু খেতে লাগল। আসলে, তার এবং বিরজুর সম্পর্ক ছিল ১৫ বছরের। কিন্তু আজকে সে যে মজা দিয়েছে, এর আগে কখনো সে মজা পায়নি। বিরজুর চুলে ছোড়াছুড়ি করতে করতে সে সেই মুহুর্তে হারিয়ে গিয়েছিল, যখন সে বধূ হয়ে এ বাড়িতে এসেছিল। তখন তার বয়স ছিল ২০ বছর। বিয়ের আগেও অনেক পুরুষের কাছ থেকে যৌবনের আনন্দ নিয়েছিল সে।

এটি ছিল ধনপত জির দ্বিতীয় বিয়ে, তখন তার বয়স হবে ৩৫ বছর। তার প্রথম স্ত্রীর একটি মেয়ে ছিল। যার নাম অনিতা রেখেছিলেন ধনপত জি। তখন তার বয়স ৫ বছর।

ধনপত জির বাড়িতে আসার সাথে সাথেই প্রথম রাতেই সুন্দরী বুঝতে পেরেছিল যে তার স্বামীর সেই শক্তি নেই যাতে সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, কয়েকদিন সে শান্ত থাকে এবং তারপর তার চোখ এখানে সেখানে ছুটতে থাকে। আর একদিন সে বিরজুকে চোখে পড়ে। তখন বিরজুর বয়স ছিল ১৮ বছর। তার শরীরচর্চা করা পেটানো শরীর প্রথম থেকেই নারীদের আকর্ষণ করত। সুন্দরী যখন তাকে দেখে, সে তার গায়ে স্ট্রিং লাগাতে শুরু করে, এবং একদিন তাকে তার বাড়িতে একা পেয়ে সে তার উপর আরোহণ করে। বিরজুর যেন তার কাঙ্খিত ইচ্ছা পুরন করার সুযোগ পেয়েছে। সে তাকে প্রচণ্ড চুম্বন করল, সেই একটি চুম্বন সুন্দরীকে বিরজুর দাসী বানিয়ে দিল। সেদিনের পর থেকে এই চক্র চলতে থাকে।

একদিন মুখিয়া দুইজনকেই হাতেনাতে ধরে ফেলে। বিরজু ভয় পেলেও সুন্দরী উল্টে বৃষ্টি বর্ষণ করল মুখিয়া জির ওপর। তাকে হুমকি দেয় যে সে যদি বিরজুকে এখানে আসতে বাধা দেয় তবে সে সারা গ্রামে হৈচৈ করবে যে সে নামর্দ। তার কথা শুনে মুখিয়া জির হুঁশ উড়ে গেল। তিনি ভাবতেও পারেননি যে, যে নারীকে সে তার ঘরে নিয়ে এসেছে তাকে ইজ্জত-সম্মান করে, সেই নারীই একদিন তার সাথে এমনটা করতে পারে। অসহায়ত্বের অশ্রু পান করে চলে যান তিনি। সেই নারীর স্বভাবের সাথে পরিচিত হয়ে উঠেছিল, সে জানতে পেরেছিল যে এই নারী তার লালসা প্রশমিত করার জন্য সবকিছু করতে পারে। কিছু মানুষ তাদের সম্মানকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে, মুখিয়াও ছিলেন সেই মানুষগুলোর একজন। সেদিন থেকে সে তাকে তার অবস্থাতেই ছেড়ে দেয়। তারপর থেকে আজ অবধি বিরজু তার স্ত্রীর সাথে লেগে ছিল। আর ছিনতাই করেছে অনেক নারীর ইজ্জত সুন্দরীর মাধ্যমে।

বিউটি কিছুক্ষণ বিরজুর চুলে আদর করে তারপর বললো – “আজ তোর কি হয়েছে? তুই তো পশু হয়ে গেছিস।”

বিরজু বিছানায় উঠে বসে দুহাতে মুখে চুমু দিয়ে বললো- “তোমার কি খারাপ লাগছে? যদি এমন হয় তাহলে আমি করবো না।”

বিউটি অবাক হয়ে গেল। বিরজুকে এত মিষ্টি করে কথা বলতে সে কখনো শোনেনি। সে বিরজুকে চুমু খেয়ে বললো – “না রাজা, আমার খারাপ লাগেনি। বরং আজকে এমন মজা পেয়েছি যা আজকের আগে কখনো পাইনি।”

“তুমি চাও আমি তোমাকে এভাবে প্রতিদিন উপভোগ করি?” বিরজু তার স্তন স্নেহ করতে করতে বলে।

“এটা কি আবার জিজ্ঞাসা করতে হয়? আমি এই মজার জন্য সব কিছু করতে পারি।”

“সত্যি বলছ?” বিরজু তাকে জড়িয়ে ধরল।

“আমি আমার জীবন দেব, কিন্তু আমি তোকে ছাড়বো না। এখন বল আমাকে তোর কি হয়েছে?”

“তাহলে শোন … কাঞ্চনকে আমার পেতে হবে কিন্তু সে ভালোবাসার মেয়ে নয়। আমাদের চালাকি আর ছলনা দিয়ে কাজ করতে হবে। কিন্তু এর সাথে আমাদের আর একটা কাজ করতে হবে। কাঞ্চনের বুয়া শান্তাকে তোমাকে নিতে হবে তোমার নিজের ফাঁদে। যদি তাকে হাত করতে পারো তাহলে বুঝো আমি কাঞ্চনকে পেয়ে গেছি। শান্তাকে তোমার ফাঁদে ফেলতে হবে। এটা খুবই সামান্য কাজ তোমার জন্য।”

“কাঞ্চনের খেয়াল ছাড়, বিরজু, সে তোর হাতে আসবে না।”

“আমি যা বলেছি তুমি তাই করো” বিরজু রেগে বললো – “যেকোন মূল্যে আমি ওকে অর্জন করব। আমি ছাড়া যদি অন্য কেউ এর রস পান করে…. আমি তা মানব না। ও যদি আমার না হয়, তাহলে কেউ পাবে না।”

“ঠিক আছে রাজা, আমি আমার কাজ করব।” সুন্দরী হেসে বলল। আর বিরজুকে টেনে তার উপর ফেলে দেয়।

তারা দুজন আবার একে অপরের মধ্যে মিশে যেতে লাগল।

 

কাঞ্চন বর্তমানে তার ঘরে খাটে বসে আছে। ঝর্নার কাছে রবির সাথে দেখা হওয়ার মুহূর্তগুলোতে সে ডুবে আছে। রবির অন্তরঙ্গভাবে বলা কথাগুলো তার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে, সেসব কথা মনে পড়লে কখনো তার ঠোঁটে হাসি ফুটে আবার কখনো মন খারাপ হয়।

সে ভাবছিল- আজ কত ভালো সুযোগ ছিল…স্যারের কাছে আমার মনের কথা বলার। কিন্তু আমি এত বোকা তাকে বলিনি কেন? বললে কি হতো? উফফ সেও জিজ্ঞেস করেছিল… কিন্তু আমি ভাবতে থাকলাম… আর তাকে কিনা বললাম, “যান… আমি বলব না, আপনি বড়…।”কেন এমন বোকামি বললাম? এখন আমাকে নিয়ে কি ভাবছেন স্যার? স্যার কি এখনও আছে সেখানে? আমি কি ফিরে গিয়ে দেখব….হয়তো স্যারের সাথে দেখা হয়ে যাবে আবার। কিন্তু তার সাথে আবার দেখা হলে কি ভাববে? স্যার যাই ভাবুক, কিন্তু আমি যদি তার সাথে সেখানে দেখা করি, তবেই তিনি আমার অবস্থা জানতে পারবেন। আমি না গেলে ওনি জানবে কি করে আমার হৃদয়ে কি আছে?

“কিরে, তোর কি হয়েছে কাঞ্চন?” হঠাৎ কাঞ্চনের কানে আওয়াজ পড়লে সে উল্টে যায়। উপরে তাকাতে দেখে বুয়া সামনে দাড়িয়ে আছে। আর অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো তার দিকে।

“কখন থেকে আমি তোর দিকে তাকিয়ে আছি, তুই নিজেই নিজেই হাসছিস, মাঝে মাঝে তুই নিজের উপর বিরক্ত হচ্ছিস, আমি তোর সামনে দাঁড়িয়ে আছি অথচ খেয়ালই করছিস না, সবকিছু ঠিক আছে তো?” বুয়া জিজ্ঞেস করল।

“না…. হ্যাঁ …. আমি… আমার কিছু হয়নি, আমি ঠিক আছি।” কাঞ্চন হড়বড় করে বলে।

বুয়া অবাক হয়ে কাঞ্চনের অবস্থা দেখে বলল, “কি বলছিস? আস্তে করে বল। এভাবে মন খারাপ করে বসে আছিস কেন? তোর কিছু ভুল হয়েছে?”

“কিছু হয়নি, বুয়া আমি ভালো আছি।”কাঞ্চন কথা বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে লাগল।

“এখন কোথায় যাচ্ছি? এখনই তো বাইরে থেকে এসেছিস… বাইরে আবার কি করতে যাচ্ছিস?” ওকে বের হতে দেখে শান্তা বুয়া বলল – “আর তুই আজ স্কুলে যাসনি কেন?”

“স্কুলে যেতে ভালো লাগছে না, কাল যাবো, আমি এখন প্রাসাদে যাচ্ছি।” এই বলে সে তাড়াতাড়ি চলে গেল।

কাঞ্চন দ্রুত হেঁটে সেই ঝর্নার কাছে পৌঁছে যায়, যেখানে সে রবিকে ছেড়ে গিয়েছিল। তার আশা যে রবি এখনও সেখানে থাকবে।

সেই জায়গায় পৌঁছে চারদিকে খুজতে লাগল। কিন্তু রবিকে কোথাও না পেয়ে মনটা ভেঙ্গে গেল। আবার সব জায়গায় আতিপাতি করে খুঁজতে থাকে, কিন্তু সেখানে যা ছিল না তা কীভাবে খুঁজে পাবে। হতাশ হয়ে একটি পাথরের উপর বসে পরে। বাড়ি থেকে সে এত উত্তেজনা নিয়ে এসেছিল, কিন্তু রবিকে না পেয়ে তার মন ভারী হয়ে গেল। হঠাৎ সে উঠে প্রাসাদের দিকে চলতে থাকে।

 

১৫

নিক্কি হলের মধ্যে একা বসে আছে, হাতে একটি বই, কিন্তু সে পড়ছিল না – কেবল আনমনে পৃষ্ঠাগুলি উল্টাচ্ছিল। তার মন অস্থির এবং সে মনটাকে বইএ মনোনিবেশ করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু সেই বই তার মনকে বিনোদন দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। শেষপর্যন্ত নিক্কি বইটা সেন্টার টেবিলে ছুড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছিল তখন কাঞ্চন হলের ভিতরে ঢুকল। তাকে দেখা মাত্রই তার সব উত্তেজনা দূর হয়ে গেল। অস্থির মনে স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস অনুভব করল, তার সবচেয়ে মিষ্টি খেলনাটি এসেছে, চিৎকার করে উঠল এবং দৌড়ে গিয়ে দুই বন্ধাবী একে অপরকে জড়িয়ে ধরে। তারপর নিক্কি ওর দিকে তাকিয়ে বলল, “এত দিন পর এলি? ভুলে গেছিস আমি যে এখানে এসেছি।”

“আমার মন ভালো ছিল না। আমি আজ স্কুলেও যাইনি।”

“কেন কি হয়েছে তোর?” নিক্কি বিরক্ত হয়ে বললো – “চল ঘরে বসি।” এই বলে নিক্কি ওর হাত ধরে রুমে চলে এলো। তারপর তাকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বললো – “এখন বল তোর কি হয়েছে? তোর এই ফুলের মত মুখটা শুকিয়ে গেছে কেন?”

“কি বলবো? আমি নিজেও জানি না আমার কী হয়েছে। মাত্র কয়েকদিন হলো, খুব অদ্ভুত একটা পরিস্থিতি হয়েছে।” কাঞ্চন তার কণ্ঠস্বর হারিয়ে ফেলে।

নিক্কি মনোযোগ দিয়ে ওর মুখটা দেখতে থাকল। তারপর সে এগিয়ে গিয়ে বিছানায় তার পাশে বসল। তারপর তার গলায় হাত রেখে তার গালে চুমু খেল।

কাঞ্চনের জন্য এটা নতুন কিছু না। যখনই নিক্কি তার সম্পর্কে কিছু পছন্দ করত সে এভাবে তার গালে চুমু দিত। শুধু গালে নয় ঠোঁটেও।

নিক্কি কাঞ্চনের মুখটা তার দিকে ঘুরিয়ে বললো – “কাঞ্চন, তুই কি জানিস ভালোবাসা কি?”

কাঞ্চন তার কথায় লাল হয়ে গেল। রবির মুখটা তার মনে ভেসে উঠে। তারপর নিক্কির দিকে তাকিয়ে বললো- “আমি বেশি কিছু জানি না, আমি শুধু জানি কারো প্রেমে পড়লে খুব খারাপ অবস্থা হয়ে যায়, কখনো কখনো সবকিছু ভালো মনে হয় আবার কখনো কিছুই ভালো লাগে না। দিন রাত সমান হয়ে যায়। রাতে ঘুম হয় না দিনে বিশ্রাম হয় না খাওয়া-দাওয়ার চিন্তা থাকে না, লেখাপড়ায় মন বসে না মানুষটি। প্রতি মুহূর্তে প্রেমিকের মুখ তার চোখে ভেসে ওঠে। তার চিন্তায়। এবং আরও অনেক কিছু ঘটে। যা আমি জানি না কি হয়।”

নিক্কি মুচকি হেসে কাঞ্চনের কথাগুলো শুনছিল। কাঞ্চন থেমে গেলে দ্রুত আবার তার গালে চুমু খেল। তারপর বললো- “তুই বলছিলি ভালোবাসার কথা একটু জানিস। এটা কি একটু? এখন আর জানার কি বাকি আছে? এত জ্ঞান কোথায় পেলি?” নিক্কি ওর চোখে উঁকি দিয়ে বললো- “তুই কি কখনো কারো প্রেমে পড়েছিস? দেখ… আমি ভালোবাসার একটাই সত্য জানি… দুঃখ ছাড়া কিছুই পাওয়া যায় না। আর আমি আমার প্রিয় বন্ধুকে দুঃখী দেখতে চাই না। তাই বলবো এই প্রেমের সম্পর্কে জড়াবি না।

নিক্কির কথায় কাঞ্চন একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে উদাস মুখে বলল- “এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে নিক্কি, তুই বলতে দেরি করেছিস। এখন তোর এই বন্ধুটি প্রেমে পড়েছে, এবং দুঃখও পেয়েছে। কিন্তু সে দুঃখিত খুব মিষ্টি। তোর এই বন্ধুও এই দুঃখের প্রেমে পড়েছে। কাঞ্চনের ঠোঁটে হাসি।

“আরে হাসছিস কেন? কি হয়েছে তোর?” নিক্কি তাকে নিজে নিজে হাসতে দেখে বলল – “তুই সত্যি না বললে আমি তোকে মেরে ফেলব।”

“আমার কিছু হয়নি, নিক্কি।” আসল কথাটা লুকিয়ে রাখে কাঞ্চন। নিক্কিকে তার মনের অবস্থা জানাতে চায়নি। সে নিজেও জানে না রবির মনে কি আছে, সে মেনে নেবে কি না, এমন পরিস্থিতিতে সে চায়নি নিক্কি তার সাথে দুঃখি হওক। সে আরও বলে – “তোর কথা শুনে আমি হাসলাম।

“চল ঠিক আছে, এখন দাঁড়া।” নিক্কি, কাঞ্চনের দিকে তাকিয়ে দুষ্টুমি করে বললো- “আর তোর জামা খুলে ফেল।”

“কেন…?” হতবাক হয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল কাঞ্চন।

নিক্কি হাসে। কাঞ্চনের এই অবস্থা দেখে সে খুব জোরে হেসে উঠল, কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে তারপর বলল- “আমার জান, জামা না খুললে আমার আনা জামাটা পরবি কিভাবে?”

“না.. আমি ঐ কাপড় পরব না।” কাঞ্চন আন্তরিকভাবে কথা বলে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল। সে ভেবেছিল যে নিক্কি যদি জোর করে, সে অবিলম্বে দরজা থেকে পালিয়ে যাবে।

কিন্তু নিক্কি আজকে যে পোশাক এনেছে তাকে পরিয়েই ছাড়বে আজ। সে চোখের পলকে কাঞ্চনের কাছে পৌঁছে তার কাপড় খুলতে লাগল।

কাঞ্চন তার কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু নিক্কি কথা না শুনে প্রথমে তার পাজামাটা টানাটানি শুরু করে। টানতে টানতে প্রায় খুলে ফেলে। কাঞ্চনের হাত ওর পায়জামার দিকে চলে গেল তাকে থামানোর জন্য। তারপর নিক্কি ওর কুর্তির দিকে হাত বাড়াতে গেল। কাঞ্চন লাখ চেষ্টা করেও নিক্কির সাখে পেড়ে উঠল না। টানা টানি দস্তাদস্তিতে কিছুক্ষণের মধ্যেই সে শুধু ব্রা আর প্যান্টি পরে দাঁড়িয়ে। কাঞ্চনের অবস্থা খারাপ, জীবনে প্রথমবার কারো সামনে এত নগ্ন হল। নিক্কি যদিও মেয়ে ছিল, কিন্তু তবুও, তার সামনে এমন অবস্থায় থাকা, লজ্জায় মরে যাচ্ছে। সে এক হাতে তার বুক এবং অন্য হাতে তার প্যান্টি ঢেকে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করছিল।

নিক্কি তার ভড়াট মাংসল এবং মসৃণ দেহের দিকে উজ্জ্বল চোখ দিয়ে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত তাকাল, তারপর তার ঠোঁটটি বাকিয়ে একটি বিশেষ উপায়ে শিস দেয়। রাস্তা দিয়ে মেয়েদের হেঁটে যাওয়া দেখে বখাটে ছেলেরা যেভাবে শিস দেয় সেভাবে।

শিসের শব্দে কাঞ্চন অনেক কষ্টে ঘাড় তুলে তার দিকে তাকাল। ঠিক সেই মুহূর্তে নিক্কি তার একটা চোখ বন্ধ করে কামুক কন্ঠে বললো- “হাই আমার জান, কি ঘাতক যৌবন তোর, তোর এই রূপ যদি একজন পুরুষ দেখে, তবে পুরো খাড়া…!” সে বিষয়টি অসমাপ্ত রাখে। তারপর বললো- “এবার তোর বুক থেকে হাত সরিয়ে তোর বুক দেখা।”

“ছি…!” কাঞ্চন মৃদু রাগের সুরে বললো- “তুই খুব নষ্ট হয়ে গেছিস নিক্কি, এত নোংরা কথা বলতে শুরু করেছিস।“

নিক্কি এবার গম্ভীর হয়ে গেল। “দুঃখিত কাঞ্চন, আমি এখন থেকে আর করব না। কিন্তু এখন আমি যে জামাটা এনেছি তা পড়। আর সাবধান যদি তুই আর কখনো প্রাসাদে না আসিস… আমি তোকে মেরে ফেলব।”

নিক্কির কথায় কাঞ্চনের রাগও কেটে গেল। আর সে তার আনা কাপড়গুলো পালাক্রমে পরতে থাকল, কাপড়গুলো এতই ফ্যাশনেবল যে বন্ধ ঘরেও পরতে লজ্জা বোধ করছিল কাঞ্চন। কিন্তু নিক্কি তাকে ভালোবেসে নিয়ে এসেছে তাই সে অস্বীকার করতে পারেনি। কাঞ্চন যে জামাই পরুক না কেন… পরার পর সে রবির কথা ভাবতো, আর সে ভাবতো- রবি যদি তাকে এই পোশাকে দেখতে পেত, তাহলে তা! অবশ্যই তাকে মুগ্ধ করবে।

জামা-কাপড় পরার প্রক্রিয়া চলতে থাকে কিছুক্ষন। এ পোশাকে কাঞ্চনকে দেখে নিক্কি বিস্মিত। কিন্তু কাঞ্চনের প্রতি তার মনোযোগ ছিল না। সে রবির চিন্তায় মগ্ন। বার বার কোন না কোন অজুহাতে ঘর থেকে বের হয়ে আসে এবং কোন কারণ ছাড়াই চাকরদের উচ্চস্বরে কিছু বা কিছু আনতে বলছে….! যদিও সে ক্ষুধার্ত বা তৃষ্ণার্ত ছিল না… কিন্তু তবুও চাকরদের কাছে জল, কখনও চা এবং কখনও কিছু খাবার আনতে বলে। এটা করার উদ্দেশ্য ছিল একটাই, তার কণ্ঠ রবির কানে পৌঁছানো। এক ঘন্টার মধ্যে, সে বেশ কয়েকবার বাহিরে আসে। কিন্তু তার আওয়াজ রবির কানে পৌঁছল না এবং সে বেরও হল না। কাঞ্চনের ভেতরে এখন হতাশা দানা বাঁধতে শুরু করেছে। সে দুঃখ পেতে থাকল। কী উদ্দেশ্যে সে এখানে এসেছিল এবং কী করতে শুরু করেছিল। রবির কাছ থেকে এমন উদাসীনতা সে আশা করেনি। তার চোখ বারবার তার দরজার দিকে যেতে থাকে শুধু এক ঝলক দেখার জন্য। কিন্তু হতাশা ছাড়া কিছুই পাচ্ছিল না। তার হৃদয় ভারী হয়ে উঠল। চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল, কিন্তু নিক্কির মনোযোগ ধরে রাখল ওকে।

হঠাৎ তার মন বলে উঠল-স্যার হয়তো এখনও প্রাসাদে ফেরেননি, হয়তো স্যার এখনো সেখানেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন…এবং এমনও হতে পারে যে তিনি হয়তো আমার পথ চেয়ে আছেন। “আহহ” সম্ভবত তাই। আমার এখানে আসা উচিত হয়নি। তাহলে আমি নিক্কিকে বলে ফিরে যাই। হয়তো আমি আপনাকে খুঁজে পেতে পারি স্যার।

তার মন ভেঙ্গে গিয়েছিল কিন্তু তবুও সে হার মানে না। সে তখনও বিশ্বাস করছিল যে অবশ্যই রবির সাথে দেখা হবে। এবং তাকে তার হৃদয়ের অবস্থা জানাবে। এই ভেবে সে নিক্কির ঘরে ফিরে এল এবং তাকে বাড়িতে যেতে হবে বলে প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এল এবং মনে মনে তার স্যারের সাথে দেখা করার আশায় সে রুক্ষ পাথুরে পথে লাফিয়ে দ্রুত উপত্যকার দিকে ছুটে গেল।

সঙ্গে সঙ্গে বিরজু মুখিয়া জির বাড়ির দরজার বাইরে পা দিল… সে দেখতে পেল মুখিয়া ধনপত রায় আসছেন। সঙ্গে ছিল তার মেয়ে অনিতা।

অনিতা এই বছর ২০ এ পা দিয়েছে। তীক্ষ্ণ চোখ। লম্বা এবং নিটোল ফর্সা শরীর। চুলগুলো ছিল কালো আর কোমর পর্যন্ত ঝুলন্ত। সে চুল বেঁধে রাখায় অভ্যস্ত ছিল না। সবসময় খোলা রাখত। তার স্তন সম্পূর্ণ প্রস্ফুটিত এবং খাড়া খাড়া। তাকে দেখলে যে কোনো মানুষ দীর্ঘশ্বাস ফেলতে বাধ্য। পেট চ্যাপ্টা এবং কোমর ছিল সরু। কিন্তু সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল তার নিতম্ব, প্রসারিত। সে সবসময় শুধু কুর্তা পায়জামা পরত। পাছার ফাঁক এতটাই গভীর ছিল যে প্রায়ই তার কুর্তি ওই ফাটলে আটকে যেত। কোমরটি এমনভাবে ছিল যে দেখতে থাকা মানুষের মুখ থেকে অনিচ্ছাকৃতভাবেই গরম দীর্ঘশ্বাস পড়ে। সামগ্রিকভাবে বলা যায় তার মধ্যে যৌবন এসেছিল পরিপুর্ণভাবে আর উপরওয়ালা তাকে দিয়েছিল উপচে পড়া যৌবন। বিরজুর ক্ষুধার্ত চোখ প্রায়ই গোপনে তার যৌবন পান করত। কিন্তু বিরজুর কাছে অনিতা ছিল ডিম পাড়া মুরগির মতো। সে জানত এই মুরগি খেয়ে ফেললে ভবিষ্যতে তাকে আর ডিম খেতে হবে না। প্রচুর ডিম খাওয়ার ইচ্ছার কারনে সে এই মুরগিকে রেহাই দিয়েছে।

বিরজুকে দেখেই মুখিয়া জির মন মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ আগে মেয়ের সঙ্গে থাকার সময় তার মুখে যে খুশি ছড়িয়েছিল তা মুহুর্তের মধ্যে মিলিয়ে গেল। বিরক্ত হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। কিন্তু বিরজুর জন্য মুখিয়া জির বিদ্বেষও ছিল আশীর্বাদ। মুখিয়া কাছে আসতেই হাত গুটিয়ে সালাম জানালেন। “নমস্কার মুখিয়া।” তার মুখে বিদ্রুপের হাসি।

“তুই এখানে কি করতে এসেছিস?” বীরজু কেন এসেছে তা সব জেনেও মুখিয়া তার মেয়ের উপস্থিতির কারনে রেগে গেলেন।

তার ফ্লেয়ার ছিল একটি ভান। কিন্তু তার রাগ ছিল সত্য। বিরজুর ছায়াকেও সে সত্যিই ঘৃণা করত।

“সবাই সব জানে মুখিয়া, এখনও লেজ দিচ্ছেন।” বিরজু দাঁত বের করে হাসে। “অনেক বছর ধরে একটাই কাজ করতে আসি, আর কিসের জন্য আসব।” কথা শেষ করতে করতে সে অনিতার দিকে ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত তাকাল।

অনিতা বিরজুর এমন চেহারায় পাত্তা দেয়না। কিন্তু তার নোংরা চোখ মুখিয়া জির চোখ এড়ালো না। নিজের মেয়ের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুখিয়া জির চোখ বিরজুর জন্য রক্তে ভরে গেল। পাড়লে এক্ষুনি বিরজির চোখ বের করে নিত। কিন্তু সে শুধু ভাবতে পারল আর ভাবতেই থাকল।

মুখিয়া জির রাগ অনুমান করে বিরজু একটা মুচকি হাসি দিয়ে সেখান থেকে চলে গেল।

 

রবি প্রাসাদে নিজের ঘরে বিছানায় শুয়ে আছে। মনে মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল কাঞ্চনের মুখ। আজ উপত্যকায় কাঞ্চনের সাথে আকশ্মিক মিলন একটি সুন্দর দুর্ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। মনের অজান্তেই কাঞ্চনের কথা ভাবতে থাকে। লাখো চেষ্টা করেও সে কাঞ্চনের ভেজা চোখ আর বিবর্ণ মুখ ভুলতে পারেনা। সে ভাবছিল- এই মেয়েটা আজ কেন মন খারাপ করলো, আর আমার কেন মনে হলো তার দুঃখের জন্য আমি দায়ী কিন্তু আমি তার কিছুই করিনি, তার এতই খারাপ লাগলো নদীর ব্যাপারটার জন্য। সে যদি এতই নরম হয় তাহলে আমার জামাকাপড় পোড়াবে কেন? হয়ত এটাও সম্ভব যে, কারো চাপে পড়ে সে আমার জামাকাপড় পুড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু কার…?” তার মন আলোড়িত হল, তখন তার মনে আরেকটি মুখ ফুটে উঠল- নিক্কি, হয়তো নিক্কি তাকে এটা করতে বাধ্য করেছে অথবা নিক্কি তার জামাকাপড় পুড়িয়ে কাঞ্চনের হাতে দিয়ে পৌঁছে দিতে পাঠিয়েছিল। হ্যা! নিশ্চয়ই এটাই হয়েছে। আর এরজন্য আমি সেই সাদাসিধে কাঞ্চনের হৃদয়ে আঘাত করেছি। হয়তো সে কারণেই সে দুঃখ পেয়েছিল। উফ আমি কি করেছি। আমি তাকে নিয়ে এত ভুল ভাবতাম। আর এখন সে না জান আমাকে নিয়ে কী ভাববে। সে কতটা ভাববে? আমাকে ঘৃণা করছে? কিন্তু আজ যখন ঝর্নার কাছে দেখা হলো তখন তার চোখে আমার প্রতি কোন ঘৃণা ছিল না, কিন্তু তার চোখে একটা আশা ছিল…যেন সে আমার কাছে কিছু চায়। কিন্তু কি? সে আমার কাছে কি চায়? সেকি আমাকে ভালবাসতে শুরু করেছে, কিন্তু সে আমাকে কেন ভালবাসবে? সে এত বোকা নয় যে তার হৃদয়ে আঘাত করেছে সে তাকেই ভালবাসবে।

রবি অনেকক্ষণ কাঞ্চনের কথা ভাবতে থাকে তারপর ভাবতে ভাবতে ঘুমের অতলে হারিয়ে যায়। এর মধ্যে কাঞ্চনও এসে চলে গেল। কিন্তু সে জানতে পারেনি যে সে তার ভালবাসায় ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং তাকে খুঁজছে।

 

কাঞ্চন দৌড়ে দৌড়ে সেই ঝর্নার কাছে পৌঁছে গেল। সে তার তৃষ্ণার্ত চোখ সর্বত্র চালায়। কিন্তু রবিকে কোথাও দেখা গেল না। একবার তার মন চাইল সে জোরে জোরে “স্যার”বলে ডাকে, রবি যদি এখানে কোথাও থাকে, তবে তার কণ্ঠ শুনে সে নিশ্চয়ই বেরিয়ে আসবে। কিন্তু পরের মূহুর্তে ভাবলো যে, অন্য কেউ তাকে এভাবে ডাকতে দেখলে তার বড় বদনাম হবে, তার ঠোঁট সিল হয়ে গেল। সে রবির নাম ধরে ডাকতে পারেনি। সে তাকে খুঁজতে থাকে এখানে-সেখানে। যেখানেই তার সত্তার সম্ভাবনা আছে মনে হয়, সেখানেই খোঁজাখুঁজি শুরু করে। যখনই পাতার সামান্য গর্জন বা টিকটিকির নড়াচড়ার শব্দ হত, তখনই সে আনন্দে ঘুরে যেত যেন তার স্যার তার পিছনে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করেও যখন রবিকে পাওয়া গেল না, তখন সে সেখানেই পাথরের ওপর বসে রইল। এ সময় তার মন কাঁদতে চাইছিল, তার মন চাইছিল সে যেন হাউ মাউ করে কাঁদে। কি বাজে অবস্থা হয়ে গেছে ওর, যে মেয়েটা সব সময় হাসতো আর হাসতো, আজ সেই হাসি উধাও হয়ে গেছে ওর ঠোঁট থেকে। সে নিজেকে অভিশাপ দিচ্ছিল যে কেন সে এমন একজনের প্রেমে পড়ল যে তাকে মোটেও পাত্তা দেয় না। মনে মনে বললো- “তুমি বোকা, কাঞ্চন, তুমি যে নির্মম মানুষের অপেক্ষায় আছো। তাকে ভুলে যাও, নাহলে সারা জীবন এভাবেই কষ্ট পেতে থাকবে, সব শেষে তুমি গ্রামের একজন সহজ সরল মেয়ে এবং সে শহরের খুব শিক্ষিত ডাক্তার। তোমার মত মেয়ের জন্য তার হৃদয়ে কোন জায়গা হয় কি করে। একটা শিক্ষিত শহুরে মেয়ে নিশ্চয়ই তার জন্য অপেক্ষায় আছে, তাহলে সে তোমাকে ভালোবাসবে কেন? তার যোগ্য না কাঞ্চন, দেখো তোমার মর্যাদার কাউকে নিয়ে স্বপ্ন দেখো, আকাশ-পাতালের মিলন কখনো হয়নি আর হবেও না, তাতে মন বসালে দুঃখ ছাড়া কিছুই পাবে না, এখনো সময় আছে। তোমার পথে ফিরে যেতে।

“তাহলে বাস্তবে আমি কখনোই স্যারের সাথে দেখা করতে পারবো না, আমার সত্যিকারের ভালোবাসার কি আসলেই কোন গুরুত্ব থাকবে না, স্যার কি সত্যিই আমাকে তার স্ত্রী হিসেবে মেনে নেবেন না। সম্পদই কি আসলেই সবকিছু, মন যা চায় তার কোন মূল্য নেই। ”

এসব ভেবে কান্নায় ভেঙে পড়ে কাঞ্চন। সে তার হাতের তালুতে মুখ ঢেকে কাঁদছিল। বেচারির এই উপলব্ধি তার হৃদয় ভেঙ্গেচুড়ে দিচ্ছিল যে তার দারিদ্র্যের কারণে রবি তাকে গ্রহণ করবে না। মুখ লুকিয়ে কাঁদতে থাকে। কিছুক্ষন পর যখন তার কান্না থামল তখন সে মনে মনে বলল – “ঠিক আছে স্যার, আমি চলে যাচ্ছি, আজকের পর আর কোনদিন তোমার পথে আসবো না, তোমার জন্য আমি কোনদিন আমার হৃদয় জ্বালাবো না। আমার চোখ আর কোনদিন তোমাকে মনে করবে না। আর্দ্র হবে না। আমি আর কখনো তোমাকে ভালোবাসবো না।”

কাঞ্চন উঠে চোখের জল মুছে বাড়ি ফিরে যেতে গেল। তখন সে অবাক হয়ে গেল যেন সে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আশ্চর্য দেখেছে। বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেল। বিশ্বাস করতে পারছিল না যে তার চোখ তাকে কী দেখাচ্ছে। রবি তার সামনে দাঁড়িয়ে।

 

“আপনি…” কাঞ্চনের মুখ থেকে বিস্ময় আর আনন্দের মিশ্র সুর বেরিয়ে এল। রবিকে সামনে দেখে তার মনে হল ভগবান তার কান্না শুনে তার প্রেম দেবতাকে তার কাছে পাঠিয়েছেন। কিছুক্ষণ আগে বিচ্ছেদে ভিজে যাওয়া তার চোখ এখন আনন্দে জ্বলজ্বল করছে। তার ঘন অশ্রু তার গাল বেয়ে ছড়িয়ে পড়ে। সে ভেজা চোখে রবির দিকে তাকিয়ে থাকে, যে মনটা কিছুক্ষণ আগে তার কাছ থেকে পালানোর কথা বলেছিল, তার সাথে দেখা না করার, কখনো তার প্রেমে না পড়ার, সে এখন তার দিকে টানতে থাকে। তার মন চাইল সে এগিয়ে গিয়ে রবিকে আঁকড়ে ধরে। কিন্তু সে সাহস দেখাতে পারেনি। হ্যাঁ, খুশির বদলে একটু রাগ অভিমান ফুটে উঠল মুখে। সে ঘাড় ঝাঁকিয়ে রাগ করে চলে যেতে লাগল।

তাড়াতাড়ি সে রবির পাস দিয়ে এগিয়ে গেল, রবিও দ্রুত ঘুরে গেল। তখন রবির পায়ের নিচে থাকা ছোট পাথরটি পিছলে যায়। পাথরটা পিছলে যাওয়ার সাথে সাথে তার পা পিছলে যায় এবং সে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়। পড়ে যেতেই তার শরীর দ্রুত খাদের দিকে পিছলে যায়।

কাঞ্চন ওর পড়ে যাওয়ার আওয়াজ শুনতে পেয়েই দ্রুত ঘুরে দাঁড়াল। রবিকে খাদের দিকে পড়তে দেখে কেঁদে উঠল – “স্যার…স্যার।”

রবিকে বাঁচাতে সে খাদের দিকে দৌড়ে গেল, সে খাদের পাশে দাঁড়িয়ে রবির দিকে তাকাল। রবি একটা পাথর ধরে ঝুলছিল। তার একটি পা পাথরের সাহায্যে এবং অন্য পা বাতাসে দুলছিল। এর ঠিক নিচে ছিল গভীর খাদ।

কাঞ্চন রবিকে এভাবে মৃত্যুর দোলনায় দুলতে দেখে তার দম আটকে গেল। সে ভয়ে কেঁপে উঠল। সে তাকে বাঁচানোর উপায় ভাবতে লাগল। প্রথমে ঘাড় উঁচিয়ে চারদিকে দেখে একজন মানুষের খোঁজে, কিন্তু সন্ধ্যার প্রান্তরে, দূরে কাউকে দেখতে পেল না। হতাশ হয়ে চোখ ফেরাল রবির দিকে। রবি তখনও উঠার চেষ্টা করছিল।

হঠাৎ কাঞ্চনের একটা কৌশল মাথায় এলো, সে তাড়াতাড়ি গলায় জড়ানো ওড়নাটা টেনে পেছনে গিঁট বেঁধে রবির দিকে ছুড়ে দিল। “নিন স্যার।”

“না…! “অস্বীকার করে মাথা নাড়ল রবি। “এভাবে তুমিও নেমে আসবে।”

“আমাকে বিশ্বাস করুন স্যার, আমার কিছু হবে না।” কাঞ্চন ধৃষ্টতার সাথে বললো- “আপনি আমার ওড়নাটা চেপে ধরে ওঠার চেষ্টা করুন।”

রবি তাই করল, এক হাত দিয়ে ওর ওড়নাটা চেপে ধরে অন্য হাত দিয়ে আস্তে আস্তে উপরে উঠতে লাগল, পাথরের সাপোর্ট নিয়ে।

কাঞ্চন গ্রামের জল খেয়ে বড় হয়েছে। সে বিন্দুমাত্র ঘাবড়াল না এবং তার সর্বশক্তি দিয়ে রবিকে টেনে তুলতে থাকল। সাথে সাথে রবি উঠে এলো। সে এক মুহুর্ত দাঁড়িয়ে নিজেকে স্থির করে। তারপর কাঞ্চনের দিকে তাকাল। কাঞ্চন রাগে ঘামে ভিজে তার চারপাশে ঘুরছিল। রবি কিছু বলতে মুখ খুলতেই কাঞ্চন রেগে বললো – “এতো গভীর খাদের কাছে দাঁড়ানোর কি দরকার ছিল? আপনি কি ভেবেছিলে যে এই খাদটা কোন খামারের পাড়…… কিছু হবে না? আজ যদি আমি না থাকতাম, আমি জানি না আপনার কি হত।

রবি হতভম্ব হয়ে কাঞ্চনের দিকে তাকিয়ে রইল, সে রাগে লাল-হলুদ হয়ে গেছে। মনে হচ্ছিল সে এখনই রবিকে ধুয়ে দেবে। সে তাকে এমনভাবে ধমক দিচ্ছিল যেন সে তার বাড়ির চাকর, এবং সে কিছু বড় বোকামি করেছে। কাঞ্চনের এমন রূপ সে আগে কখনো দেখেনি। মেয়েটি, যে সবসময় শান্ত এবং স্পর্শকাতর ছিল, এই সময়ে একটি সিংহীর রূপ ধারণ করেছে। মুখে যা আসছিল তা রবিকে বলছে। তার মুখ রাগে লাল হয়ে গেছে, তার চোখ চুল্লির মতো জ্বলে উঠেছে। নিঃশ্বাস এত দ্রুত চলছিল যেন সে মাইলের পর মাইল হেঁটে এসেছে। তার বুক জোরে জোরে ওঠা নামা করছিল। অপরাধীর মতো রবি চুপ করে দাঁড়িয়ে তার ধমক শুনতে থাকে।

কিছুক্ষণ পর রাগ কমে গেলে সে চুপ হয়ে যায়। রবি তখনও তার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল। তার হাতে তখনও কাঞ্চনের ওড়না ধরা, যা ঘষে ঘষে তার ঘাবড়ে যাওয়া দূর করার চেষ্টা করছিল। কাঞ্চন বুকের ওড়না ছাড়া ওর সামনে দাঁড়িয়ে। আর রাগের আধিক্যে তা উঠা নামা করছে। রবি তার ঘামে ভেজা মুখের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বললো – “কোন অধিকারে তুমি আমাকে এভাবে বকা দিচ্ছো? এটা আমার জীবন…. আমি খুশি তাই করব…… আমি এখান থেকে লাফ দিব। পাহাড়ের চূড়া থেকে… আমাকে নির্দেশ দেওয়ার তুমি কে?” রবি তার মেজাজের সাথে পরিচিত ছিল। তবু মন ছোঁয়াতে মিথ্যে রাগ দেখাল।

কাঞ্চনের ঠোঁট কেঁপে ওঠে। মেয়েটা কিছু বলতে চাইল কিন্তু বলতে পারল না। ভারী চোখে রবির দিকে তাকাল। তারপর চোখ নামিয়ে নিল।

“বলো, উত্তর দাও।” রবি আবার জিজ্ঞেস করল। “এভাবে কি ভেবে আমাকে বকা দিচ্ছিলে? আমার এত খেয়াল রাখার কে তুমি?”

কাঞ্চন আবার চোখ তুলে তাকালো রবির মুখে। তার মনে এলো বলে যে সে তাকে ভালোবাসে, তার জীবনসঙ্গী হতে চায়, তাকে ছাড়া সে বাঁচতে পারবে না, আঘাত পেলে সেও মরবে। কিন্তু মনের ভেতরের অনুভূতিগুলো সে বের করে আনতে পারেনি। সে ভেজা চোখে চুপচাপ রবির দিকে তাকিয়ে থাকে।

“তুমি কি আমাকে ভালোবাসো?” রবি তার নীরবতায় বলল। “তাই কি আমি মারা গেলে তুমি বাঁচবে না? যদি তাই হয়, তাহলে তুমি আমাকে বলছ না কেন আমাকে ভালোবাসো।”

“সা… ..স্যার ….! ”

রবি হাত বাড়িয়ে দুই হাতে ওর মুখ চেপে ধরল। তারপর বললো- “কেন লুকিয়ে কাঁদছো? একবারও বলোনি কেন তুমি আমাকে ভালোবাসো?”

“স্যার…!”সে হেঁচকি দিয়ে বললো – “মানে… আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি, স্যার, আমি আপনাকে ছাড়া বাঁচতে পারব না, স্যার। আমাকে নিয়ে যান, স্যার, আপনি যা বলবেন আমি তা পালন করব, আপনি যা বলবেন আমি তাই করব। আমি থাকব আপনি যেমন রাখেন। আমি খাবার কম খাব, আমি ঘরের সব কাজ করব। কিন্তু স্যার আমাকে নিয়ে যান।” এই বলে কাঞ্চন রবির সামনে হাত জোড় করে।

রবি ওর হাত ধরে চুমু খেল। তারপর বললো- “তুমি কি আমাকে পাথরের মানুষ ভেবেছো কাঞ্চন, আমার বুকে কি হৃদয় নেই, যে তোমার নিঃশর্ত ভালোবাসার বিনিময়ে তোমাকে ঘরের কাজ করতে বাধ্য করবে। আমি তোমাকে কম খাবার খাওয়াব। আমি রাখব আমার হৃদয়ে, আমার হৃদয়ের ভিতরে। কারণ আমিও তোমাকে ভালবাসি। পৃথিবীর কোন শক্তি তোমাকে আমার হৃদয় থেকে বের করে নিতে পারবে না।”

“স্যার…!” বুকে জড়িয়ে থাকা এই সুখ আর সামলাতে পারেনি কাঞ্চন।

রবি খুব শক্ত করে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। দুটি হৃদয় এক হয়ে গেল। কাঞ্চন রবির বাহুতে বন্দী হয়ে অনুভব করলো যেন সে পুরো পৃথিবী পেয়েছে। সে তার বাহুগুলির বৃত্তকে শক্তিশালী করতে থাকল। এই মুহূর্তে সে যে আনন্দ অনুভব করছে তা ভাষায় বর্ণনা করতে পারব না। সে ছিল সেই পাক্ষীর মতো যে এক ফোঁটা জলের জন্য মরুভূমিতে ঘুরে বেড়ায় কিন্তু জল পায় না। আর পাওয়া গেলে তার তৃষ্ণার্ত মন যে সুখ পায়, সেই সুখ এ সময়ে অনুভূত হয়। আজ তার তৃষ্ণার্ত মন শুধু একফোঁটা জলই পায়নি, বরং পেয়েছে সমগ্র সাগর। সে সেই সাগরের গভীরে হারিয়ে যেতে চেয়েছিল এবং হারিয়েও গিয়েছিল।

 

১৯

অনেকক্ষণ দুজনে লতা-পাতার মতো একে অপরকে জড়িয়ে ধরে একে অপরের হৃদস্পন্দন শুনতে থাকে। কাঞ্চন যেন এই সময়ে পুরো পৃথিবী ভুলে গেছে। এই সময়ে রবির কোলে থাকতে সে যে সুখ পাচ্ছে, তা সে আগে কখনো অনুভব করেনি।

কিছুক্ষণ জড়িয়ে থাকার পর রবি মৃদু গলায় ডাকল- “কাঞ্চন।”

রবি তাকে আদর করে ডাকল। রবির কন্ঠস্বর কাঞ্চনের কানে এসে পড়লে সে তার বন্ধ চোখের পাতা খুলে রবির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। “বলুন স্যার।”

রবি দুই হাতে মুখ ভরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে লাগল। কাঞ্চনের গালে তখনও ভেজা কান্নার চিহ্ন। এক হাত দিয়ে তার গাল থেকে অশ্রু মুছে দিল। তারপর কাঞ্চনকে বললো “আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি আমার অজান্তে অনেক কষ্ট দিয়েছি।

“ছি ছি … কি?” কাঞ্চন দম বন্ধ করে বলল – “আপনি আমার পিছনে আমার কথা শুনছিলেন। যান, আমি আপনার সাথে কথা বলব না।” কাঞ্চন মুখ ফুলিয়ে বলল।

“আমি ভুল করেছি, এখন হাসো।” রবি ওর দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল।

তার কথায় মৃদু হাসল কাঞ্চন।

“এখন সবসময় এভাবেই হাসতে থাকো। আমি আর এই চোখে অশ্রু দেখতে চাই না।” রবি হেসে ওর চোখের দিকে তাকাল।

“স্যার, আপনি আমাকে ছেড়ে যাবেন না তো?” কাঞ্চন গম্ভীর হয়ে বললো- “আপনি জানেন না স্যার, আপনার জন্য আমি কতটা ব্যাকুল।

“আহহ … কি বললে কাঞ্চন?” রবি ক্ষোভের সাথে বললো- “আমি সেরকম নই। তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না। তোমাকে আমার দরকার। বছরের পর বছর আমিও এই সত্যিকারের ভালোবাসার সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমি আর কোথায় পাবো তোমার চেয়ে সুন্দর মানুষ যে আমাকে আমার থেকেও বেশি ভালোবাসে। আজ আমি আমার মাকে জানাবো যে আমি তার পুত্রবধূ পছন্দ করেছি। দ্রুত এসে তার পুত্রবধূকে দেখে নিক। তোমার পুত্রবধূ হতে কনে খুব তাড়াহুড়ো করছে”

রবির দুষ্টুমি কথায় হঠাৎ কাঞ্চন লাল হয়ে গেল। সে মুখ ঘুরিয়ে লজ্জিত হয়ে বললো – “ধাত…! আমি কেন তাড়াহুড়ো করব? আমি জন্মের পর জন্ম পর্যন্ত আমার স্যারের জন্য অপেক্ষা করতে পারি।”

“তুমি আমাকে স্যার ডাকছ কেন?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল রবি। “স্যার তোমার মুখ থেকে শুনে মনে হচ্ছে আমি কোন মোটা, বুড়ো, বড়লোক আর তুমি আমার কাজের মেয়ে।”

“আমি একজন দাসী।” কাঞ্চন হাসল “সে দাসী যে সব সময় আপনার চরনে থাকবে।”

“সাবধান…!” গর্জে উঠল রবি। “আবার কোনদিন নিজেকে আমার দাসী বলবে না। তুমি আমার ভাবী বউ, তোমার স্থান আমার পায়ে নয়, আমার হৃদয়ে। বুঝেছ।” কাঞ্চনকে বুকে লাগিয়ে রবি বলল।

কাঞ্চন আবেগে বুকে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। তারপর তার বুকের উপর থেকেই বলে “মা জি আমাকে গ্রহণ করবেন, এমন হবে না যে তিনি আমাকে গরীব জেনে আমাদের সম্পর্ক অস্বীকার করবেন।”

“মোটেই না।” রবি তার গালে চুমু খেয়ে বললো- “আমার মা আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু, আমার পছন্দ তার পছন্দ হবে।”

কিছুক্ষণ, দুজনেই একে অপরকে জড়িয়ে কথা বলতে থাকে এবং প্রতিশ্রুতি দেয়। তারপর কিছুক্ষন পর কাঞ্চন বললো – “আচ্ছা স্যার, আমাকে এখন অনুমতি দিন, বুয়া আর বাবা আমার জন্য চিন্তা করছেন।” গভীর অন্ধকার দেখে চিন্তিত গলায় বলল কাঞ্চন।

আজ সকাল থেকে সে এখানে-সেখানে দৌড়াচ্ছিল। তখন মনে শুধু রবিই ঘুরছিল। কিন্তু এখন রবিকে পেয়েছে। তাই তার খেয়াল হয় পরিবারের কথা।

“ঠিক আছে।” রবি ওকে আলাদা করে বললো- “আবার কবে দেখা হবে।”

“আগামীকাল সন্ধ্যা ৫ টায় একই স্থানে।” কাঞ্চন হেসে রবির কাছ থেকে ওড়নাটা নিয়ে গলায় পরে নিল।

“আরে … আমার অন্য জুতো কোথায় গেল?” অবাক হয়ে বলল রবি। সে যখন পিছলে গিয়েছিল, তখন তাঁর পায় থেকে একটি জুতা পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু খাদ থেকে ওঠার পর দুজনেই একে অপরের মধ্যে এমনভাবে হারিয়ে গিয়েছিল যে রবির জুতোর কথা খেয়াল করেনি। আর এখন সন্ধ্যাও নেমে গেছে।

“এটা নিশ্চয়ই এখানে কোথাও আছে।” কাঞ্চন বলে জুতা খুঁজতে এদিক ওদিক তাকাতে থাকে।

সূর্যাস্ত হয়ে গেছে, কিন্তু অন্ধকার এতটা গভীর ছিল না যে মাটিতে পড়ে থাকা কোনো বস্তু দেখা যেত না।

জুতা খুঁজতে খুঁজতে খাদের কাছে পৌঁছে গেল কাঞ্চন। সে দেখল রবির জুতো পাথরের ফণাতে। সে তাড়াহুড়ো করে জুতাটা তুলে ওড়নায় লুকিয়ে রাখল, রবির চোখ ফাকি দিয়ে। “স্যার, এখন আপনার জুতা পাবেন না। আর খুঁজতে যাবেন না। অন্য জুতা কিনে নিন। আমি বাড়ি যাচ্ছি। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

“আরে ….দাঁড়াও, কিছুক্ষণ দেখা যাক। হয়তো খুঁজে পাব।” রবি কাঞ্চনের দিকে ফিরে বলল। হঠাৎ সে অনুভব করল যেন কাঞ্চন কিছু লুকানোর চেষ্টা করছে। “তোমার হাতে কি? কি লুকিয়ে রেখেছো?”

রবিকে তার দিকে এগিয়ে যেতে দেখে কাঞ্চন দ্রুত দৌড়ে উপরে চলে গেল। কিছুদূর যাওয়ার পর সে থেমে গেল, তারপর রবিকে জুতো দেখিয়ে বলল – “স্যার, আপনার জুতো আমার কাছে আছে। কিন্তু আমি দেব না। নিজের জন্য অন্য জুতা কিনুন।”এই বলে কাঞ্চন হেসে বাড়ির পথে পালিয়ে গেল।

“আরে ….. দাঁড়াও, দাও আমার জুতোটা দাও।” পিছন থেকে ডাক দিল রবি। কিন্তু কাঞ্চন থামেনা। ছুটে গিয়ে তার দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেল।

“অদ্ভুত মেয়ে।” রবি বকাঝকা করে। “সেদিন আমার জামাকাপড় পুড়িয়েছিল আর আজ সে আমার জুতা নিয়ে গেছে। আমার জামা-জুতায় ওর এত শত্রুতা কেন।” রবি মাথা খামচে ভাবল।

এক পায়ে জুতা পড়ে হাঁটতে হাঁটতে সে কোনোরকমে তার বাইকের কাছে পৌঁছায় এবং তারপর বাইক স্টার্ট করে প্রাসাদের দিকে চলে যায়।

 

রাত ৮ টা বাজে, নিক্কি তার রুমে সোফায় শুয়ে আছে। মনটা একেবারে অস্থির। যখন থেকে সে শহরে থাকতে শুরু করেছে, সে সবসময় বন্ধুদের মধ্যে থাকতে অভ্যস্ত ছিল। কোলাহল, পার্টি, গান, নাচ, তারপর সারা রাত বন্ধুদের সাথে মজা করা। ছেলে না মেয়ে, মেয়ে না ছেলে, সবার সামনেই জামা খুলে ফেলেছে, সে ছেলে না মেয়ে তার পরোয়া ছিল না। সে শুধু মজা চেয়েছিল, যেকোনো মূল্যে।

কিন্তু আজ সে একেবারে একা হয়ে গেছে, না সেই মানুষগুলো আছে, না সেসব হৈচৈ, না সেসব পার্টি না সারা রাতের মজা। সে হয়ে গিয়েছিল সেই পাক্ষীর মতো যে আকাশে সব সময় আপন গতিতে উড়তে থাকে, নিজের ইচ্ছামত গন্তব্য ঠিক করে চলে। কিন্তু যখন তাকে খাঁচায় বন্দী করা হয়, তখন সে শুধুই হাপিয়ে উঠে। নিক্কি বন্দী ছিল না কিন্তু তার দোলাচল ছিল খাঁচার পাক্ষীর মতো। কাঞ্চন যতক্ষন তার সাথে থাকত ততক্ষণ সে সব ভুলে যেত, কিন্তু চলে যাওয়ার সাথে সাথে সে আবার একা হয়ে যায়। ঠাকুর সাহেবের সাথেও শুধু রাতের খাবারের সময়ই দেখা হত, না হলে দিনে কিছুক্ষণ হলঘরে একসঙ্গে বসে থাকতেন, কিছু কথা বলার পর নিজের ঘরে চলে যেতেন।

এই পরিবেশে নিক্কি দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। সেজন্য সে রবির সাথে ঘনিষ্ঠ হতে চেয়েছিল, কিন্তু তাকে অসম্মান করে আরও খারাপ করে দিয়েছিল সে। সে তার অপমানের প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল। এবং সর্বদা এই প্রচেষ্টা ছিল রবির কোন দুর্বলতা খুজে যদি পাওয়া যায় সেটা সে আঁকড়ে ধরবে, তখন তাকে নিজের ইচ্ছায় নাচতে বাধ্য করবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত শুধুই হতাশ।

হঠাৎ সে উঠে জামাকাপড় বদলাতে লাগলো, গায়ের কাপড়গুলো শরীর থেকে আলাদা করে তার জায়গায় একটা সালোয়ার কুর্তা পরে হলের দিকে এলো। সে সরজুকে বলল যে সে বসতিতে যাচ্ছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরবে। তারপর সে বেরিয়ে গেল।

সে বের হয়ে তার জীপে বসল এবং জীপ চালিয়ে বসতির দিকে চলে গেল। জীপের আলোয় অন্ধকার ছিঁড়ে সে অল্প সময়ের মধ্যে বসতির শুরুতে পৌঁছে গেল। সে বাম দিকে মোড় নিয়ে চলছিল তখন সে তার ডানদিকে একটি ছায়া দেখতে পেল। দ্রুত ব্রেক কষে “চরররর…” শব্দে।

 

২০

জীপ থামতে দেখে ছায়াও নিজের জায়গায় থেমে দাঁড়াল। নিক্কি সেই ছায়ার দিকে মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল। অন্ধকারে সেই অন্ধকার ছায়াটিকে সে চিনতে পারল না, কিন্তু সে তার উচ্চতা অনুমান করেছিল। তার উচ্চতা ছিল প্রায় ৬ ফুট। নিক্কি ওর দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে বলল- “কে তুমি? সামনে এসো”

ছায়া এগিয়ে গেল। আর জীপের কাছে গেল। নিক্কি তার দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকালো, তার মুখটা কিছুটা পরিচিত মনে হলো। “তুই কাল্লু, তাই না?”

“হ্যাঁ নিক্কিতা, আমি কাল্লু।”সে মাথা নিচু করে বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল।

গ্রামের সবচেয়ে কালো কাল্লু ছিল কুৎসিত নিগ্রোর মতো দেখতে একজন যুবক। সে দেখতে যেমন কুৎসিত ছিল, ভিতরটা ছিল তেমনই সুন্দর। মুখিয়া জির ক্ষেতে কাজ করে নিজের ও বৃদ্ধা মাকে খাওয়াতেন।

যখন ৬ বছর তখন তার বাবা মারা যান। তার বাবা চাষের নামে কিছু জমি রেখেছিলেন। যা পরে নিজেকে ও কাল্লুকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তার মা বিক্রি করে দেন। এখন একটা ছোট্ট মাটির কুঁড়েঘর ছাড়া তার আর কিছুই ছিল না।

শৈশব থেকে যৌবন পর্যন্ত কাল্লু শুধু দুঃখ দেখেছে। তার কুৎসিত চেহারার কারণে সে ছোটবেলা থেকেই গ্রামের অন্য ছেলেমেয়েদের কাছে অপমানিত হত। ছোটবেলায় যার কাছে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিত, ঘৃণার বশে সে হাত সরিয়ে দিত। সে এমন এক নিঃসঙ্গ পাখি যে সে যে সব ডালে বসত সে সব ডালের সবাই একা ফেলে উড়ে যেত।

কিশোর বয়সে পৌঁছানোর পর তার দুঃখ আরও বেড়ে যায়। গ্রামের যে কোন ছেলেকে কোন মেয়ের সাথে কথা বলতে দেখলে বা কাউকে একা মেয়ের সাথে হাঁটতে দেখলে তার মন কেঁপে উঠত। প্রতিটা ছেলের মত তারও ইচ্ছা ছিল কেউ তাকেও ভালোবাসুক, কোথাও খামারের শস্যাগারে কেউ যেন তার জন্য অপেক্ষা করুক। কখনও কখনও ঝর্নার কাছে বসে একটি মেয়ের সাথে খেলবে। কেউ তার উপর রাগবে, ঝগড়া করবে, তার সাথে হাসবে, তাকে আদর করবে। কিন্তু এ সব তার ভাগ্যে ছিল না।

গ্রামের সব মেয়েরা তার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াত। কোনো মেয়ে তাকে ভালোবাসা তো দুরের কথা সরাসরি তার সঙ্গে কথাও বলত না। কোন মেয়েই বা কোন কুৎসিতকে পছন্দ করবে, প্রতিটি মেয়েই চায় তার ভাবী স্বামী সুন্দর, সুশিক্ষিত, উচ্চ পরিবারের এবং ধনী হোক।

কিন্তু এসব কিছুই তার কাছে ছিল না। কোন মেয়ে তার জন্য পাগল হবে এমন রূপ তার ছিল না, না সে শিক্ষিত ও ধনী ছিল। কিন্তু গ্রামের মেয়েদের মধ্যে এমন একটা মেয়ে ছিল, যাকে কাল্লু খুব পছন্দ করত। সে ছিল কাঞ্চন।

সমস্ত গ্রামের একমাত্র মেয়ে যে কাল্লুর সাথে হেসে কথা বলত, কখনও তার মুখ ফিরিয়ে নিত না। যখনই তার সাথে দেখা হতো, সে তার কাছে ভালভাবে তার অবস্থা জানতে চাইতো।

কাঞ্চনের এই ভালো ব্যবহার কাল্লুর পছন্দ হল এবং সে মনে মনে কাঞ্চনকে ভালবাসতে লাগল। কিন্তু কাঞ্চনকে কখনোই তার মনের কথা বলতে পারেনি। দূর থেকে দেখেই তার মনের তৃষ্ণা মিটাত। ভাল করেই জানে যে, চাঁদ ও চাকরের মিলন কখনো হয়নি এবং হবেও না।

কাঞ্চনও দরিদ্র ছিল কিন্তু তার চেয়ে লক্ষ গুণ ভালো। তাছাড়া সে সুন্দরী, সুশিক্ষিত। তার আর কাঞ্চনের মধ্যে কোনো মিল ছিল না। তার ভয় ছিল কাঞ্চনকে মনের কথা বললে তার খারাপ লাগবে। আর তার খারাপ লাগলে সে আর কখনো তার সাথে কথা বলবে না। এখন যে তার সাথে একটু কথা বলে, সে তাও বলবে না…

পাওয়ার চেয়ে বেশি হারানোর ভয় ছিল তার। তার একটা ভুল যেন তাকে কাঞ্চনের কাছ থেকে চিরতরে দূরে রাখতে না পারে এই ভেবে সে তার মনের অনুভূতিগুলোকে কখনো তার ঠোঁটে পৌঁছাতে দেয়নি।

দিনভর পশুর মতো মাঠে কাজ করত আর রাতে কাঞ্চনকে ভাবনায় রেখে তৃষ্ণার্ত মনের পিপাসা মেটানোর চেষ্টা করত। কিন্তু একাকীত্বে কাঞ্চনের স্মৃতি তার তৃষ্ণার্ত মনের তৃষ্ণা বাড়িয়ে দিত। যন্ত্রণা সীমা ছাড়িয়ে গেলে শিশুর মতো কাঁদত। তবে মনের কষ্ট কাউকে বলত না।

তার কষ্টের কথা সে ছাড়া আর কেউ জানত না। এই হতভাগ্য ব্যক্তিকে নিয়ে কারইবা কোনো উদ্বেগ থাকবে?

যদি কেউ তার একাকীত্বের বেদনার সাথে পরিচিত ছিল তবে তা কেবল তার মা। যখনই সে কাল্লুকে দুঃখী দেখত, সে তাকে তার ভালবাসার কোলে নিয়ে তাকে প্রলুব্ধ করত। সে ছিল কুৎসিত কিন্তু সেই মায়ের হৃদয়ের টুকরো। তার একমাত্র অবলম্বান। কিন্তু তার মা সবসময় চিন্তায় থাকতেন যে কে তার মেয়েকে তার গরীব কুৎসিত ছেলের হাতে দেবে? তার ছেলে কি সবসময় একা থাকবে?

কিন্তু সে কাল্লুর কাছে তার উদ্বেগ প্রকাশ করে না। যখনই উভয়ে একে অপরের সামনে থাকত, একে অপরের কাছ থেকে তাদের দুঃখ লুকিয়ে রাখত, তারা একে অপরের প্রতি তাদের ভালবাসার উচ্ছ্বাস করত।

এ সময় সে সুগনার বাড়ি যাচ্ছিল, তার শরীর জ্বরে পুড়ছিল, শরীর ঠান্ডায় কাঁপছিল। ঠাণ্ডা থেকে বাঁচতে ছেঁড়া পুরনো শাল দিয়ে শরীর ঢেকে রেখেছিল। জ্বর এতই বেশি যে সে যেতেও পারছিল না, কিন্তু সুগনার ডাকে এই অবস্থায়ও তার সাথে দেখা করতে যাচ্ছিল।

গ্রামে দুজন লোক ছিল যাদের কথা কাল্লু কখনও ফেলত না। একজন ছিলেন মুখিয়া ধনপত রায়, যিনি তাকে মজুরি দিতেন। দ্বিতীয় সুগনা, তিনি কাঞ্চনের বাবা বলে সুগনার ডাক কখনও এড়িয়ে যেতনা।

আজ যখন সুগনা তাকে ডেকেছে তাই সে এমন অবস্থায়ও তার বাড়ি যেতে রওনা দিয়েছে। বসতির শেষ প্রান্তে ছিল তার বাড়ি। সে তার বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তার কাছেও পৌঁছায়নি তখন জিপ থামার শব্দে তার চলন্ত পা থেমে যায়। তারপর নিক্কি আওয়াজ দিতেই সে তার জিপের কাছে গিয়ে দাঁড়াল।

“উফফ … তুই আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিস।” নিক্কি নিঃশ্বাস ফেলে বলল- “এমন রূপ নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস?”

“জি …সুগনা কাকার বাসায় যাচ্ছা। কোনো কাজে ডেকেছে।”

“ওহহহহ … তুই এভাবে শাল পরে যাচ্ছিস কেন?”

“আমার একটু জ্বর, নিক্কি জি।” শালটা সামলাতে সামলাতে কাল্লু বললো- “তাই তো শালটা দিয়ে ঢেকে রেখেছি।”

“তাহলে আমার জিপে বস, আমিও কাঞ্চনের বাসায় যাচ্ছি।” নিক্কি বলে তাকে সিটে বসার ইঙ্গিত দিল।

“নিক্কি জি আমি ঠিক যেতে পারব। আপনি কষ্ট করবেন না”

“আরে… আমি যখন সেখানে যাচ্ছি তখন আমার সাথে যেতে সমস্যা কি?” নিক্কি জ্বলে উঠল। কেউ তাকে অস্বীকার করলে তার রাগ সপ্তম আকাশে পৌঁছে যেত। মেয়েটি আরও বললো – “চুপচাপ আমার সাথে গাড়িতে বস।”

কাল্লু এবার অস্বীকার করতে পারল না। সে এগিয়ে গিয়ে জিপে তার পাশে বসল। আজ সে জীবনে প্রথম ফোর হুইলারে বসেছিল।

কাল্লু জীপে বসতেই নিক্কি জীপটাকে এগিয়ে দিল।

কিছুক্ষণ পর কাঞ্চনের বাসার সামনে জীপ থামল। নিক্কি প্রথমে নেমে দরজা ঠেলে উঠানে ঢুকল। কাল্লুও পেছনে পেছনে উঠোনে তাকে অনুসরণ করল।

শান্তা বুয়া উঠানে রুটি বানাচ্ছিল। পাশের খাটে বসে হুক্কা টানছিল সুগনা।

নিক্কিকে দেখে বুয়া অবাক হয়ে সুগনাকে বলে- দেখো, কোন মেয়ে এসেছে।

শান্তার কথা শুনে সুগনা দরজার দিকে মাথা ঘুরাল। নিক্কি হাসতে হাসতে তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। ওর দিকে তাকাতেই সুগনা বলল- “আরে শান্তা, এতো নিক্কি, চিনতে পারলি না?”

শান্তা অবাক হয়ে সুগনার দিকে তাকাল। তারপর নিক্কির দিকে চোখ রাখল। সে কিছু বলার আগেই নিক্কি তার কাছে এসে বলল – “নমস্কার চাচা। নমস্কার বুয়া।” হাত জোড় করে পালাক্রমে দুজনকেই সালাম করল। তারপর প্রণাম করে সুগনার পা ছুঁয়ে দিল।

“তুমি কত বড় হয়ে গেছ নিক্কি।” বুয়া অবাক হয়ে বললো- “তুমি যখন এর আগে এখানে এসেছো তখন কত ছোট ছিলে।”

বুয়ার কথায় নিক্কি হাসল। “কাঞ্চন কোথায়, বুয়া?”

“দিদি এখানে।” চিন্টুর আওয়াজ নিক্কির ঘাড় ঘুরিয়ে দিল, চিন্টু আর কাঞ্চনকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। নিক্কির গলা শুনে দুজনেই বেরিয়ে এসেছে।

নিক্কিকে দেখে কাঞ্চন তার দিকে ছুটে গেল। তারপর ওর হাত ধরে বললো- “আজ ভুলে আমার বাড়ির পথে কেমন করে?”

“আরে, আমার একা একা লাগছিল তাই ভাবলাম তোর সাথে দেখা করব।” নিক্কি উত্তর দিল।

“দিদি তুমি আমার জন্য শহর থেকে কি এনেছ? ”নিক্কির কুর্তি টেনে বলল চিন্টু।

নিক্কি তাকে বলতে লাগলো। নিক্কির আগমনে সবাই তাকে নিয়ে মেতে উঠে। কাল্লু কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল, জ্বরে কাঁপছিল, কিন্তু কেউ তার দিকে লক্ষ্যও করল না।

 

২১

কিছুক্ষন কাল্লু সেদিকে তাকিয়ে থেকে তারপর সুগনার কাছে চলে গেল। সেও সবার হাসিতে সামিল ছিল। ভুলে গেছে সে কাল্লুকে তার বাড়িতে ডেকেছিল এবং সে কখন এসেছে।

“চাচা…আপনি আমাকে ডেকেছেন?”

কাল্লুর ডাক শুনে সাথে সাথে সুগনার মনোযোগ তার দিকে গেল।

“আরে, তুই এখানে কখন এলি?” হতভম্ব হয়ে বলল সুগনা।

“আমি নিক্কিজির সাথে এসেছি, চাচা।” কাল্লু উত্তর দিল।

“সরি কাল্লু, আমি তোকে দেখতে পাইনি।” সুগনা হাসিমুখে বললো – “কিন্তু তোর কি হয়েছে? শাল পরে এসেছিস কেন? ভালো আছিস তো?”

সুগনার কথা শুনে চিন্টু আর শান্তা হেসে উঠল। কাঞ্চন এই বিষয়ে চিন্টুকে একটু বকাঝকা করে কাল্লুর দিকে তাকাতে লাগল।

“একটু জ্বর আছে চাচা। সকাল হলেই কমে যাবে।” কাল্লু বললো – “বলুন চাচা… আমাকে কেন ডেকেছেন?”

“আমি মুখিয়া জির কাছ থেকে জানলাম তুই আগামীকাল সার আনতে শহরে যাচ্ছিস। ভাবলাম নিজের জন্যও এক বস্তা সার আনিয়ে নেই।” সুগনা উত্তর দিল। “কিন্তু তুই এখন অসুস্থ হলে যাবি কিভাবে?”

“সকালের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে। ”কাল্লু উত্তর দিল। “আগামীকাল যাবার আগে দেখা হবে। এখন অনুমতি দিন।”

“দাঁড়া ….. কিছুক্ষণ বস। আমি এক গ্লাস গরম দুধে হলুদ দিয়ে দিচ্ছি… সকাল হলেই জ্বর কমে যাবে।” সুগনা ওকে থামিয়ে বলল। তারপর কাঞ্চনকে দুধ গরম করতে বলল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই কাঞ্চন তার হাতে এক গ্লাস গরম দুধ দিল। কাঞ্চনের হাত থেকে গ্লাসটা নিতে নিতে কাল্লুর হাতটা প্রবলভাবে কেঁপে উঠল। তার বুকে একটা মিষ্টি ব্যাথা হল। বুঝতে পেরে কাঞ্চন ওর জন্য এক গ্লাস দুধ ধরে রেখেছে….জ্বরে থাকার পরেও সে রোমাঞ্চিত হল। সে একবার তাকিয়ে কাঞ্চনের মুখ দেখে তারপর কাঞ্চনের হাত থেকে গ্লাসটা নিল।

দুধ পান করা পর্যন্ত কাঞ্চন তার পাশে দাঁড়িয়ে রইল। আস্তে আস্তে দুধটা খেয়ে খালি গ্লাসটা কাঞ্চনকে দিল। দুধ পান করার পর তার ইচ্ছা হলো আরো কিছুক্ষণ সেখানে বসে থাকার। সে কাঞ্চনকে আরও কিছুক্ষণ দেখতে চাইল। কিন্তু বাড়ির লোকজন যেন তাকে ভুল না বুঝে তা ভেবে উঠে দাঁড়াল। তারপর সকালে সুগনার সাথে দেখা করবে বলে বেরিয়ে যায়।

প্রায় ঘন্টা খানেক কাঞ্চনের বাসায় থাকার পর নিক্কি কাচের প্রাসাদে ফিরে এলো। প্রাসাদ থেকে বের হওয়ার সময় সে খুব টেনশনে ছিল, কিন্তু কাঞ্চনের বাসা থেকে বের হওয়ার সময় সে সব টেনশন দূর হয়ে গেছে। প্রাসাদে পৌছলে দেখে ভৃত্যরা রাতের খাবার সাজাচ্ছে। ঠাকুর সাহেব সোফায় বসে অপেক্ষা করছিলেন।

নিক্কির হলঘরে পা দিতেই ঠাকুর সাহেব জিজ্ঞেস করলেন- “এই সময় কোথা থেকে আসলে? কাঞ্চনের বাড়িতে গিয়েছিলে?”

“হ্যাঁ বাবা।” নিক্কি হেসে তাকে জড়িয়ে ধরে।

“তোমার মুখে খুশি দেখে বুঝলাম তুমি কাঞ্চনের বাড়ি থেকে আসছো।”ঠাকুর সাহেব গালে আদর করে বললেন – “ওখানে সব ঠিক আছে?”

“হ্যাঁ ….. সব ঠিক আছে, শান্তা বুয়াও ভালো আছে, সুগনা কাকার স্বাস্থ্যও ভালো। ৬ বছর আগে যা দেখেছিলাম তেমন কিছুই বদলায়নি, সব একই রকম।” নিক্কি একে একে সবার অবস্থা বলতে লাগলো – “শুধু চিন্টু বদলে গেছে। আগে নাক দিয়ে পানি পড়ত আর টুকটাক কথা বলত, এখন কাউকে কথা বলতে দেয় না।” এই বলে নিক্কি চুপ হয়ে গেল।

“যাক, ভালই হয়েছে, তুমি তাদের সাথে দেখা করে এসেছ।” ঠাকুর সাহেব আদর করে বললেন- “এখন এসো আমরা বাকি কথা খাবার টেবিলে করব।”

নিক্কি হেসে খাবার টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। তারপর তার চেয়ার টেনে বসল।

“সঞ্জয়” ঠাকুর সাহেব কাছে দাঁড়িয়ে থাকা একজন চাকরকে বললেন – “রবিকে নিয়ে এসো। তাকে বলো আমরা খাবার টেবিলে তার জন্য অপেক্ষা করছি।”

“জি মালিক।” সঞ্জয় রবির ঘরের দিকে গেল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই রবিকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখা গেল। ডাইনিং টেবিলের কাছে এসে ঠাকুর সাহেবকে প্রণাম করে হাসিমুখে, তারপর নিক্কির দিকে তাকিয়ে ওকে হ্যালো বলে চেয়ারে বসলেন।

নিক্কি তার হ্যালোর উত্তর দিতে আগ্রহী ছিল না। কিন্তু ঠাকুর সাহেবের উপস্থিতির কারনে তাকে জোর করে হ্যালো বলতে হলো।

চাকররা থালায় খাবার বেরে দেয়ার পর তিনজনই খেতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ঠাকুর সাহেব শুধু নামেই খেলেন। কিন্তু খাওয়ার ব্যাপারে আপোষ করেনি রবি।

“তোমার কি এখানে ভালো লাগছে, রবি?” খাওয়ার মাঝখানে ঠাকুর সাহেব রবিকে জিজ্ঞেস করলেন।

রবি প্লেট থেকে সরে গিয়ে ঠাকুর সাহেবের দিকে তাকাল, তারপর মুচকি হেসে বলল – “কেন ঠাকুর সাহেব ভাল লাগবে না। এখানকার পরিবেশ যে কারো মন কেড়ে নেবে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে রাঙানো এই জায়গাটা। আর আমি একজন প্রকৃতি প্রেমী।” এই বলে রবি নিক্কির দিকে তাকাল। তারপর আরও বলে- “শহরের কৃত্রিম সৌন্দর্যের চেয়ে গ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমার বেশি ভালো লাগে।”

রবির কথার মর্ম বুঝতে পেরে নিক্কির মুখ রাগে জ্বলে উঠল। কিন্তু তার বাবাকে খেয়াল করে নিয়ে সে দ্রুত তার রাগ নিয়ন্ত্রণ করে।

“হুম … ঠিক বলেছ।” ঠাকুর সাহেব রবির কথায় সায় দিয়ে বললেন – “আমাদেরও এই জায়গাটা খুব ভালো লেগেছে। তাই এখানে এসে বসতি স্থাপন করেছি।”

“তাহলে কি … এটা কি আপনা পূর্বপুরুষদের জায়গা নয়?” কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করল রবি।

“না …!” ঠাকুর সাহেব বললেন- “আমরা বেনারসের বাসিন্দা। আমাদের বাপ-দাদার জমি এখনও আছে। এখানে একবার এসেছি কোনো কাজে। আমাদের এই জায়গাটা ভালো লেগেছিল এবং আমরা এখানে জমি কিনেছিলাম। তারপর এই অট্টালিকা তৈরি করি।” প্রাসাদের কথা বলতে বলতে ঠাকুর সাহেবের মুখ বিষণ্ণ হয়ে উঠল। তবে এর কারণ জানতে চায়নি রবি। এবং নিক্কিও করেনি।

একবার রবির মনে এলো যে সে এর কারণ জিজ্ঞাসা করে, কিন্তু এই সময়ে সে এই প্রশ্ন করা সঙ্গত মনে করল না। খাবারের মাঝখানে দুঃখের কথা জিজ্ঞাসা করা উচিত নয়। কিন্তু রবির মনে এমন কিছু প্রশ্ন ছিল যার উত্তর একমাত্র ঠাকুর সাহেবই দিতে পারেন। এমনকি রাধা দেবীর অসুস্থতার বিষয়ে তাকে যা বলা হয়েছিল তাও তার কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না।

ঠাকুর সাহেব তাকে বলেছিলেন যে একদিন রাধা গর্ভবতী হওয়ার সময় সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পিছলে পড়েছিলেন। যার জেরে রাধা দেবীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই একই হাসপাতালে দিওয়ান জির স্ত্রীও সন্তান প্রসবের জন্য ভরতি ছিলেন। এবং দুর্ভাগ্যবশত উভয়ই একই দিনে ভর্তি হয়েছিল। ওই দিন দিওয়ান জির স্ত্রী একটি মৃত কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। নার্স যখন এই খবর নিয়ে এসে শিশুটির মৃত্যুর কথা জানায়, তখন রাধার মনে হয়েছিল যে তার মেয়েটি পড়ে যাওয়ার কারণে মারা গেছে। সে সেই জিনিসটা সহ্য করতে না পেরে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে।

যখন সে তার চিন্তা থেকে বেরিয়ে এল, দেখল যে নিক্কি তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে খাবারের প্লেটে চোখ স্থির করল।

কিছুক্ষণ পর সবাই খাবার টেবিল থেকে উঠে নিজ নিজ রুমের দিকে চলে গেল।

 

বেলা ১১ টা বাজে। শান্তা নদীতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কাঞ্চন ও চিন্টু এ সময় স্কুলে গেছে। সুগনা তার ক্ষেতে কাজ করতে গেছে। শান্তা ঘরে একা বসে না থেকে নদীতে গিয়ে গোসল করাই ভালো ভাবল। সে তার পরনের জামা কাপড় বের করে বাইরে থেকে ঘর তালা দিয়ে নদীর পাড়ে চলে গেল।

গ্রামের নারী-পুরুষ সবাই নদীতে গোসল করত। নদীতে মহিলাদের জন্য আলাদা এবং পুরুষদের জন্য আলাদা ঘাট ছিল। পুরুষরা মহিলা ঘাটের দিকে যায় না আর মহিলারা পুরুষদের ঘাটে যায় না।

শান্তা বসতি ছেড়ে কিছুদূর হাঁটতেই পিছন থেকে কে যেন নাম ধরে ডাক দিল- “আরে ও শান্তা, একটু আস্তে চল….. আমিও আসছি।”

শান্তা ঘুরে দেখল সুন্দরী দ্রুত এগোচ্ছে।

“আরে, সুন্দরী ভাবী।  তাড়াতাড়ি আমি দাঁড়িয়ে আছি।” সুন্দরীর কাছে আসতেই শান্তা সুন্দরীর সাথে কথা বলে।

“আরে বোন, তুমি জানো না … আমি একা চলতে কত ভয় পাই।” সুন্দরী বলল। “তখন থেকে ভাবছিলাম নদীর ধারে যাই, কিন্তু কোন সঙ্গী পাচ্ছিলাম না। তোমাকে যেতে দেখেই দৌড়ে এসেছি।”

“ভাবী এখন তো দিন … তুমি কি দিনের আলোতেও ভয় পাচ্ছ?” শান্তা হেসে বলল আস্তে আস্তে পা বাড়াতে লাগলো।

 

২২

সুন্দরীও পায়ে পায়ে হাঁটতে থাকে।

“আমি একাকীত্বকে ভয় পাই, দিন বা রাতে নয় পাগলি।” সুন্দরী হেসে বলল।

“বুঝলাম না ভাবী, তুমি কি বলতে চাও?” শান্তা একটু অবাক হয়ে বলল।

“দিদি, আমার মত তোমারও একই কাহিনী। তবুও তুমি বুঝ না?” সুন্দরী অবাক হয়ে বলল।

“তুমি আমাকে নিয়ে মজা করছ কেন ভাবী?” সুন্দরীর হাসিখুশি জীবনকে তার বর্ণহীন জীবনের সাথে তুলনা করা হলে সে আহত হয়ে বললো- “তোমার সব আছে। মুখিয়া দাদার মতো স্নেহময়ী স্বামী, তোমার বড় ঘর, অনিতার মতো সুন্দরী ও ভদ্র মেয়ে পেয়েছ। আর কি চাও তুমি?”

“আমি একই জিনিস মিস করি দিদি, তুমি যা মিস কর।” সুন্দরী হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বললো- “হ্যাঁ দিদি, সব কিছুর পরও আমার কিছু নেই। আমার স্বামী আছে, কিন্তু শুধু লোক দেখানোর জন্য। আমার একটি মেয়ে আছে তবুও আমাকে বন্ধ্যা বলা হয়।” এই বলে সুন্দরী কেঁদে ফেলল।

“তাহলে ডাক্তারের কাছে যাচ্ছ না কেন?” শান্তা আবেগে কথা বলে।

“ডাক্তার কি করবেন দিদি? যখন বীজই বোনা হয় না, ফল আসবে কোথা থেকে।”

“তাহলে সমস্যা কি…?” শান্তা কথার থেমে গেল।

“তাদের মধ্যে কোন দোষ নেই, দিদি। যদিও তারা গ্রাম জুড়ে খুব বীরের মত হাঁটে, কিন্তু বিছানায় আসার সাথে সাথে তারা আলগা হয়ে যায়।” চোখের জল মুছতে মুছতে বলল সুন্দরী। “আমার আর তোমার মধ্যে পার্থক্য একটাই যে আমার স্বামী আমার সাথে থাকে আর তোমার স্বামী তোমার থেকে দূরে।”

“তাহলে এখনে বিয়ে করেছো কেন…?” শান্তার চোখ ভিজে উঠল। তার দুঃখে সে তার দুঃখের প্রতিফলন দেখতে পেল। “এখন পর্যন্ত কিভাবে আছো ভাবী?”

“না …দিদি, আমি এত সহনশীল মহিলা নই।” সুন্দরী শান্তাকে বললো – “বিয়ের এক বছর ধরে আমি কষ্ট পাচ্ছিলাম। কিন্তু কতদিন ….? সেই দিনগুলোতে বীরজুকে মুখিয়া জি নতুন কাজে নিয়োগ দিয়েছিল। একদিন কোনো অজুহাতে তাকে বাড়ির ভেতরে ডেকে নিয়েছি। সেও আনন্দেই করেছে। সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত সে আমার শরীর শান্ত করছে।

সুন্দরীর এই খোলামেলা প্রকাশে শান্তা হতবাক। তার ওঠার ধাপগুলো মাটিতে আটকে গেল। মুখের উপর হাত রেখে সুন্দরীর দিকে বিস্ময়ের মত দেখতে লাগলো।

তাকে অবাক হতে দেখে তার পাও থেমে গেল। কিন্তু তার মনে কোনো লজ্জা ছিল না। সে মৃদু হাসল। তারপর বললো- “আমি আর কি করবো। তাদের নিয়ে চিন্তা করবো কেন যারা আমার দুঃখের কারন। আমার বাবা কি আমাকে বিয়ে দেয়ার আগে ভেবেছিল এই সম্পর্ক নিয়ে আমার মেয়ের জীবন সুখের হবে কি না। আমার স্বামী কখনো ভেবেছিলেন তার অর্ধেক বয়সের মেয়েকে স্ত্রী হিসেবে এনে তাকে খুশি রাখতে পারবে কিনা? সখি, না আমার বাবা আমার সুখের কথা ভেবেছিল না আমার স্বামী। বাবার মাথার বোঝা ঝেড়ে ফেলতে হবে, তাই ঝেড়ে ফেললেন। নববধূকে গ্রহণ করলেন স্বামী।

একটু ভাব দিদি, ৩৫ বছরের মহিলা যদি ২০ বছরের ছেলেকে বিয়ে করে, তাহলে লোকে বলবে এই বয়সে সে কেমন মহিলা যে দেহের মজা নিতে গেছে। এমন জঘন্য কাজ শুধু একজন পতিতাই করে, এ নারীর নামে কলঙ্ক, নারী নয়, এমন নারীর ছায়া থেকে দূরে থাকা উচিত। কিন্তু একজন পুরুষ যদি একই কাজ করে, তখন লোকে বলে, বাহ, কী লোক, এই বয়সেও যুবতী বউ আনতে পেরেছে। তাহলে সমাজে তার মর্যাদা আরও বাড়বে, স্ত্রী হয়তো বিছানায় কয়লার ওপর শুয়ে থাকবে। কিন্তু তারা গোঁফ তুলে বাইরে ঘুরে বেড়ায়।

শুধু নিজের কথা ভাব….! তোমার স্বামী তোমাকে ছেড়ে চলে গেছে, ওখানে কি করে জানি না। কখনো এই মেয়ের সাথে ঘুমায় আবার কখনো অন্য কারো সাথে। আর না জানি কত বেজন্মা বেড়ে উঠছে।

কিন্তু যেদিন সে ফিরে আসবে। তুমিও জিজ্ঞেস করবে না কার সাথে এত দিন ঘুমিয়েছিলে, কার সাথে জেগেছিলে। আর এই সমাজও জিজ্ঞেস করবে না। কিন্তু তুমি যদি একই কাজ কর, তাহলে হাজার মানুষ একসাথে প্রশ্ন করবে। স্বামী তোমাকে ঘর থেকে বের করে দেবে। পুরো সমাজে তোমাকে কলংকিত করা হবে। কারণ তুমি একজন নারী।”

শান্তা কিছু বলল না। সে নীরবে সুন্দরীর কথাগুলো সত্যের দাঁড়িপাল্লায় ওজন করতে থাকে। সুন্দরীর মুখ থেকে বেরিয়ে আসা প্রতিটি শব্দের মধ্যে সত্য লুকিয়ে ছিল। সে সুন্দরীর প্রতি সহানুভূতি অনুভব করে।

“বলো, আমি যদি মিথ্যা বলি, আমার মাথায় তোমার চপ্পল মার।” তাকে চুপ থাকতে দেখে সুন্দরী আরও বললো- “আমি এইসব পুরুষদের কেয়ার করা বন্ধ করে দিয়েছি। এখন ফলাফল যাই হোক না কেন, আমি পাত্তা দিচ্ছি না। আমি আমার জীবন যাপন করছি এবং এভাবেই বাঁচব।”

“কিন্তু দাদার কিছু সীমাবদ্ধতা আছে?” শান্তা মনের মধ্যে জেগে উঠা প্রশ্নটা সুন্দরীর সামনে রাখল।

“এগুলিও পুরুষদের দ্বারা তৈরি।” উত্তরে সুন্দরী বললো- “দিদি, আমাদের বাধ্যতা হল আমরা পুরুষদের এতটাই ভয় পাই যে আমরা আমাদের সুখের কথা কম চিন্তা করি এবং তাদের সম্মানের কথা বেশি চিন্তা করি। সত্যি বলতে, আমরা নিজেদের জন্য বাঁচি না। আমাদের সুখও তাদের ইচ্ছায়। আমরা দাসী এবং আমাদের সম্মানও তাদের সম্পত্তি। আমাদের নিজেদের কিছু নেই। না এই সমাজ,না এই ঘর…..! আমরা শুধুই বস্তু। যখন আমাদের যেভাবে খুশি ব্যবহার করতে পারে।

সত্যি বলছি দিদি, আজ মুখিয়া জির চেয়ে বিরজুকে আমার বেশি শ্রদ্ধা। কারণ এখন পর্যন্ত যা কিছু সুখ পেয়েছি, বিরজুর কাছ থেকে পেয়েছি, কোন দুঃখ পাইনি। আমি বলি তুমিও কারো হাত ধরো। তোমার যৌবন নষ্ট করছ কেন? তোমার মধ্যে এখনও অনেক মোহনীয়তা বাকি, এটি যে কোনও মানুষের মনকে নাড়া দিতে পারে।”

“না ভাবী।” শান্তা সুন্দরীর কথায় আতঙ্কিত হয়ে বললো – “এ সব আমার দ্বারা হবে না। এখন সামান্য জীবনই বাকি আছে, এভাবেই কাটাবো।”

“শান্তা কেন সেই মাতালের অপেক্ষায় তোমার যৌবন নষ্ট করছ। তার অপেক্ষা ছেড়ে কারো হাত ধরো, আমি তোমাকে আবার বিয়ে করতে বলছি না, শুধু কারো কোলে বন্দী হয়ে সুখ উপভোগ করার কথা বলছি। সত্যি করে বলো, তুমি চাও না কেউ তোমাকে ভালোবাসুক, তোমার এই সুন্দর ঠোঁটের রস পান করুক, কেউ তোমার এই নাজুক অংশে হাত রাখুক।” এই বলে সুন্দরী এক হাতে তার স্তন টিপে দিল।

“ভাবী … কি করছো?” শান্তা মাথা নেড়ে সরে গেল। সুন্দরীর ছোঁয়ায় তার সারা শরীর যেন এক আভায় ভরে গেল। উত্তেজনায় তার চোখ ভারী হয়ে উঠল। কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে শান্ত গলায় বললো- “আমার স্বপ্ন জাগিও না, ভাবী, আমি অপবাদে ভয় পাই। তুমি যা পারবে আমি তা পারবো না।”

“দিদি, একদিনের অপবাদের ভয়ে কেন সারা জীবন নরক বানিয়ে ফেলছ। তোমার বয়স এখন কত? তুমি এখনো অনেক মজা করতে পারো। সংসারের যত্ন বাদ দাও….. তোমার জীবন যাপন করো। যদি তুমি বলো, আমি তোমাকে সাহায্য করি। বিরজু খুব শক্তিশালী একজন মানুষ। তার পুরুষালি অংশটা খুবই দর্শনীয়।” সুন্দরী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বললো- “কি নিষ্ঠুরভাবে যে বিছানায় ঘষে, সত্যি বলছি, যখন সে গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন আমি পৃথিবী ভুলে যাই। একবার তার সেবা নিয়ে দেখো… কিভাবে তোমার বছরের তৃষ্ণা মেটে?

নেশায় শান্তার চোখ লাল হয়ে গেল। শরীরে লালসা রক্তের মতো বয়ে গেল। শরীর এত গরম হয়ে গেল যে ওর যোনি ভিজে গেল। সুন্দরীর কথায় বিরজুর শক্ত শরীর একসময় ভাবনায় ভেসে ওঠে। তার মনে হল যেন বিরজুর হাত সেই স্তনের উপর হামাগুড়ি দিচ্ছে যা কিছুক্ষণ আগে সুন্দরী টিপেছিল। এই অনুভূতি তার চিন্তাকে আরও গভীর করে তুলেছে… এখন তার মনে হতে লাগল যেন বিরজুর হাত তার সারা শরীরে স্পর্শ করছে, কখনো সে বিরজুর শক্ত হাতের স্পর্শ অনুভব করে তার স্তনে আবার কখনো তার পাছায় তার হাত। মাঝে মাঝে সে অনুভব করে যে বিরজু তাকে বাহুতে জড়িয়ে ধরে তার ঠোঁট চুষছে।

 

২৩

শান্তা মনের থেকে বিরজুর চিন্তাগুলোকে ছুড়ে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা করল। কিন্তু বিরজু তার মন কেড়ে নিচ্ছিল। শান্তা তার ভারী চোখের পাতা খুলে সুন্দরী দিকে তাকাল। সে মৃদু হাসছিল।

“কি হয়েছে দিদি, হঠাৎ চুপ হয়ে গেলে কেন?” শান্তার মুখের বদলে যাওয়া অভিব্যক্তির দিকে তাকিয়ে কথা বলল সুন্দরী।

“কিছু না ভাবী।” শান্তা আস্তে আস্তে বলে কাঁপা কাঁপা পায়ে নদীর দিকে এগিয়ে গেল।

সুন্দরীও তার সাথে বহমান নদীর দিকে এগোতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দুইজনে নদীতে পৌঁছে গেল। সারাটা পথ ধরে সুন্দরী শান্তার সাথে একই বিষয়ে কথা বলতে থাকে, আর তার ঘুমন্ত স্বপ্নগুলোকে জাগিয়ে তুলতে থাকে। কিন্তু নদীর ধারে পৌঁছতেই তাকে চুপ করে যেতে হলো। কারণ নদীতে আগে থেকেই কিছু মহিলা উপস্থিত ছিলেন। আর সে চায়নি যে তাদের কথা অন্য কেউ শুনুক।

সুন্দরী চুপ করে গেলেও শান্তার মনে ঝড় ওঠে। যে আগুন শান্তা ১০ বছর ধরে দমন করেছিল, আজ সুন্দরী তা জাগিয়ে দিয়েছে। শান্তার মন অস্থির হয়ে উঠেছিল। এমনকি গোসল করার সময়, সে সুন্দরীর বলা কথা নিয়ে চিন্তা করতে থাকে।

 

ঠাকুর জগৎ সিং তার ঘরে বসে দিওয়ান জির অপেক্ষায় ছিলেন। ৫ মিনিট আগে মঙ্গল্লুকে তার বাসায় ডেকে পাঠায়। তার মুখে উদ্বেগ দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু দুশ্চিন্তা বিন্দুমাত্রও ছিল না। সে চেয়ার থেকে উঠে একটা সিগার জ্বালিয়ে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে লাগল।

চুরুটটায় একটা লম্বা টান দিতেই দিওয়ান জি দরজা দিয়ে ঢুকলেন। পায়ের শব্দে ঠাকুর সাহেব ঘুরে দাঁড়ালেন। দিওয়ান জিকে দেখে তাঁর চেয়ারে ফিরে এসে বসলেন।

দিওয়ান জি তখনও দাঁড়িয়ে ছিলেন। ঠাকুর সাহেব চেয়ারে বসার সাথে সাথেই দিওয়ান জি তাকে বললেন – “কোন চিন্তা সরকার?”

“না দিওয়ান জি। ভগবানের ইচ্ছায় যখন থেকে রবি এসেছে, সবকিছু ঠিকঠাক চলছে। আমি আপনার সাথে একটি ভাল এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলতে চাই।”

দিওয়ানজি প্রশ্নবিদ্ধ চোখে ঠাকুর সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার বোঝার কিছু ছিল না।

“আপনি বসুন।” ঠাকুর সাহেব চেয়ারের দিকে ইশারা করে দিওয়ান জিকে বসতে বললেন।

দিওয়ান জি তার কাছে থাকা চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসলেন। – ” বলুন, সরকার। আদেশ দিন।”

“আদেশ না দিওয়ান জি, আমি আপনার রায় জানতে চাই।” ঠাকুর সাহেব চুরুটের শেষ পাফটা নিয়ে এসট্রেতে নিভিয়ে দিয়ে বললেন- রবিকে আপনার কেমন লাগে?

“রবি?” দিওয়ানজি অবাক হয়ে বললেন – “কিসের কথা জিজ্ঞেস করছেন?”

“নিক্কি সম্পর্কে।” ঠাকুর সাহেব দিওয়ান জির সামনে মনের কথা ব্যক্ত করলেন – “আমাদের নিক্কির জন্য রবি কেমন হবে? তার বাড়ির সম্পত্তি নিয়ে আমাদের মাথা ব্যাথা নেই, সে একজন ডাক্তার এবং ভালো ভদ্র ছেলে। এটাই আমাদের জন্য যথেষ্ট।”

“সরকার, আপনি আমার মনের কথা বলেছেন।” দেওয়ান জি খুশিতে কিচিরমিচির করে বললেন – “আমি রবিকে সেদিনই পছন্দ করেছিলাম যেদিন দিল্লিতে তার সাথে দেখা হয়েছিল। নিক্কি আর রবির জুটি লাখে এক হবে। একটুও দেরি করবেন না। এই বিষয়ে আজই রবির সাথে কথা বলুন।”

“আচ্ছা, সন্ধ্যেবেলা, চলুন রবি আর নিক্কিকে বসিয়ে দুজনের ইচ্ছা জেনে নিই।” ঠাকুর সাহেব আবার চুরুটের দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন।

“জো হুকুম।”দিওয়ান উঠে বলল।

তারপর ঠাকুর সাহেবের অনুমতি নিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন। দরজার বাইরে যেতেই তার চোখ নিক্কির সাথে আঘাত করে। সে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে দিওয়ান জি আর ঠাকুর সাহেবের কথা শুনছিল।

সে ঠাকুর সাহেবের কাছে কোনো কাজে আসছিল এমন সময় দরজার বাইরে থেকে ঠাকুর সাহেবকে নিজের সম্পর্কে এবং রবির সম্পর্কে কিছু বলতে শুনে দরজার বাইরে আটকে গেল। তারপর কিছুক্ষণ ওই অবস্থায় থেকে সব কথা শোনে। এখন যখন দিওয়ান জি তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন, সে সাথে সাথে লজ্জা পেয়ে দ্রুত তার ঘরের দিকে ছুটে যায়।

নিক্কি যে এই সম্পর্কের জন্য প্রস্তুত তা বুঝতে দেওয়ান জির সময় লাগেনি। সে হাসিমুখে তার পথে চলে গেল।

 

নিক্কি সোজা নিজের রুমে এসে বিছানায় পড়ে গেল। তারপর একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বাবা ও দিওয়ান জির মুখে শোনা কথাগুলো মনে করতে লাগলো। সে খুশি ছিল, কিন্তু সে কেন খুশি তা বুঝতে পারল না। যার কাছ থেকে সে তার অবজ্ঞার প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল সেই ব্যক্তির সাথে তার বিয়ের কথা শুনে তার হৃদয় কেন এত খুশি? সে রবিকে অপমান করতে চেয়েছিল, তাহলে আজ কেন তাকে তার দাবিতে সাজানোর কথা ভাবছে? হয়ত রবির ভালো লাগাই নিক্কির মন থেকে সব ময়লা দূর করে দিয়েছিল। নিক্কির মন আগেই জেনেছিল রবি লাখে একজন। যে ব্যক্তি তার নগ্ন দেহ ত্যাগ করে সে সাধারণ মানুষ হতে পারে না। রবির এই ভালো লাগাই ছিল তার সুখের কারণ। রবির মতো একজন ভদ্রলোক তার স্বামী হতে যাচ্ছে বলে সে খুশিই বোধ করছিল।

রবিকে নিজের ভাবনায় স্থির করে নিক্কি মনে মনে হাসল তারপর মনে মনে বলল- “এখন বলুন মিস্টার রবি, আমার কাছ থেকে পালিয়ে কোথায় যাবেন? এখন আমি এমন একটা বাঁধন বাঁধতে যাচ্ছি যে সারাজীবন আমার সাথে থাকতে হবে। তাহলে দেখ কিভাবে প্রতিশোধ নেব আমি তোমার কাছ থেকে। তুমি আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছো।

মুহুর্তে তার মাথায় একটা চিন্তা এলো, এখনই তার রুমে গিয়ে তাকে এই সম্পর্কের কথা বলি না কেন। তাকে একটু উত্যক্ত করা যাক।

মেয়েটা হেসে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। তারপর রবির ঘরের দিকে পা বাড়াতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে রবির ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে। সে শুধু দরজায় টোকা দিতে যাবে তখন তার চোখ দরজার ল্যাচের দিকে যায় যা বাইরে থেকে বন্ধ।

দরজা বন্ধ দেখে নিক্কির কপালে একটা বলিরেখা ফুটে উঠল। ঘড়িতে সময় দেখল। সময় তখন ৫ টা। সে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ভাবল, তারপর সিঁড়ি বেয়ে হলের দিকে এল। সে একজন চাকরকে রবির কথা জিজ্ঞেস করে জানতে পারল সে তার বাইকে করে কোথাও গেছে।

নিক্কি চিন্তায় পড়ে গেল। কয়েকদিন ধরে সে লক্ষ্য করছিল যে রবি ঘনঘন সন্ধ্যায় প্রাসাদের বাইরে যেতে শুরু করেছে। কিন্তু তিনি কোথায় যেতেন, কেন যেতেন তা কখনো জানার চেষ্টা করেনি। কিন্তু কেন জানি আজ তার মনে একটা অজানা সন্দেহ ঘুরপাক খাচ্ছিল।

সে অস্থিরভাবে হলের মধ্যে পায়চারি করতে করতে একটাই কথা ভাবছিল- ‘ রবির কি কোনো মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক আছে? কিন্তু কি দরকার? তার যদি সত্যিই একজন মেয়ের অভাব অনুভব করত তবে তো সে আমার কাছেই আসত। আমি তো সব সময় তাকে দেয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্য কোথাও ঘুরতে হবে কেন তার?

“কিছু একটা আছে, নিক্কি।” মনটা মৃদুভাবে কেঁপে উঠল। “মেজাজ আর আবহাওয়া বদলাতে বেশি সময় লাগে না। তুমি এভাবে চোখ বন্ধ করে থাকো, পাছে পাখি অন্য কোথাও দানা খায়। সন্ধ্যাবেলা কোথায় যায় তোমাকে খুঁজে বের করতে হবে। এমনও হতে পরে যে সে তোমার সামনে সন্ন্যাসী হওয়ার ভান করে বাইরে ঘুরে বেড়ায়, গ্রামের ফুলের রস চুষে খায়।”

এই ভেবে নিক্কির মুখ শক্ত হয়ে গেল। মেয়েটি দ্রুত প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এল। তারপর তার জিপে বসে জীপটিকে উপত্যকার দিকে ছুটাল।

 

২৪

পঁচিশ মিনিট ধরে ঝর্নার কাছে পাথরের ওপর বসে কাঞ্চনের জন্য অপেক্ষা করছিল রবি।

গতকাল সে এই জায়গায় তার সাথে দেখা করবে বলে গিয়েছিল। কিন্তু কাঞ্চনের অপেক্ষায় আধঘণ্টা পার হয়ে গেলেও সে এখনও আসেনি।

রবি পেঁচার মতো তাকিয়ে ছিল বহমান ঝর্নার দিকে। কখনো রোমিও, কখনো ফরহাদ আবার কখনো মজনু আর রাঞ্জার অদেখা ছবি তার মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল। এই জন্য না যে সে নিজেকে সেই মহান প্রেমিকদের সাথে তুলনা করছিল, কিন্তু কারণ আজ সে সত্যিই তাদের ব্যথা অনুভব করেছিল।

আজ সে বুঝতে পারছে বিচ্ছেদ কাকে বলে? একাকীত্বে বসে নিজের প্রেমিকার জন্য অপেক্ষা করা কেমন? আজ সে জানতে পেরেছিল যে প্রেমিকদের জামা ছিঁড়ে কেন? কেন পাগলের মত রাস্তায় ঘুরে বেড়াও? একা একা বসে পাথরে মাথা ঠুকে কেন? কারণ আজ সেও প্রেমে পড়েছে। আজ সেও কারো জন্য অপেক্ষা করছে।

বই, চলচ্চিত্র এবং বন্ধুদের কাছ থেকে এই মহান প্রেমিকদের সম্পর্কে অনেক দেখেছে এবং শুনেছে। কিন্তু কখনো অনুভব করতে পারেনি তাদের সত্যিকারের ভালোবাসার আকুলতা। তাদের কেমন লাগতো? জ্বাল ছাড়া যেমন জ্বলে না। তেমনি ভালবাসার আকাঙ্ক্ষা ছাড়া ভালবাসা উপলব্ধি হয় না। এ বিষয়ে কোনো এক কবি বলেছেনঃ

“খালিশ দরদ-ই-মহব্বতেরও একই অনুভূতি।

যারা কাউকে নিজের থেকে বেশি ভালোবাসে।”

আজ তাকেও সেই যন্ত্রণা ভোগ করতে হচ্ছে। সে কখনো পাথরের উপর বসে চুল টানছিল, আবার কখনো বিরক্তি নিয়ে ফিরে তাকাচ্ছিল।

এবারও বিরক্তিতে ঘাড় ফেরানোর সাথে সাথে তার চোখ আনন্দে চকচক করে উঠল। পাথর থেকে পড়ে যাওয়া বাঁচাতে বাঁচাতে কাঞ্চনকে আসতে দেখে। সে খুশিতে পাথরের উপর দাঁড়িয়ে কাঞ্চনের দিকে তাকাতে লাগল।

কাঞ্চনের পরনে ছিল নীল সালোয়ার কামিজ। ওই পোশাকে তাকে খুব সুন্দর লাগছিল। স্কার্ফটা গলায় পেঁচিয়ে পেছনে ঝুলছিল। টাইট কুর্তিতে তার পাহাড়ের চূড়াগুলোর আকার স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। কাঞ্চন এসে রবির পাশে দাঁড়াল। তারপর রবির দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল।

“কয়টা বাজে?” কাঞ্চনকে হাতের কব্জিতে বাঁধা ঘড়িটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল রবি। “আমি গত আধাঘন্টা ধরে পাগলের মত বসে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। তুমি আমাকে পাত্তা দিলে না। এটাই কি তোমার ভালোবাসা।” না চাইলেও রবির কথায় রাগ ফুটে উঠে।

রবির মুখ থেকে বেরিয়ে আসা কড়া কথায় কাঞ্চন স্তব্ধ হয়ে গেল। সে ভাবতেও পারেনি যে সে এখানে এসেই তার  কাছ থেকে এমন তিরস্কার শুনতে পাবে। ঘর থেকে বের হতে হতে তার মনে হাজারো আশা, পথ জুড়ে কিচিরমিচির, মনে হাজারো ইচ্ছা এসে ভর করেছিল। কিন্তু এখানে আসার সাথে সাথে তার মনের মধ্যে ফুটে থাকা স্বপ্নের সব ফুল নিমেষে শুকিয়ে গেল। সে নীচু স্বরে রবির সাথে কথা বলল – “ভুল হয়েছে স্যার। আমাকে ক্ষমা করবেন। বুয়া আমাকে একটা কাজে আটকে দিয়েছিলেন।” এই বলে লজ্জায় কাঞ্চনের ঘাড় নিচু হয়ে গেল।

কাঞ্চনের ছিন্নভিন্ন মুখ দেখে রবি তার ভুল বুঝতে পারল। তার সমস্ত রাগ এক নিমিষেই উবে গেল। কারণ না জেনেই কাঞ্চনকে বকাঝকা করেছে এই ভেবে তার মনটা অপরাধবোধে ভরে গেল।

সে ধীরে ধীরে কাঞ্চনের কাছে এল। কাঞ্চন তখনও ঘাড় নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

সে তার হাত দিয়ে তার চিবুক স্পর্শ করে তার মুখ তুলল। কাঞ্চনের চোখ ভিজে গেল। তার চোখের পাতার মাঝে দুটি মুক্তোর মতো ফোঁটা জ্বলে উঠে। ওর চোখে জল দেখে রবির নিজের উপর রাগ হল। তার এই ভুলের জন্য এখন পাথরে মাথা ঠুকতে ই্চ্ছে করছে। সে এত অবিবেচক হল কিভাবে? চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বললো “আমাকে মাফ করে দাও কাঞ্চন, আমি আর কখনো তোমার উপর রাগ করব না। কথা দিলাম। তুমি চাইলে আমি কান ধরে উঠ বস করতে পারি এই ভুলের জন্য। কিন্তু প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও আর একবার ভালোবেসে হাসো। ”

রবির কথাগুলো শুনে সত্যি হাসল কাঞ্চন। তার ভিতরকার সব কষ্ট এক নিমিষেই দূর হয়ে গেল। পলকহীন চোখে রবির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর সে অনুনয়ের সুরে বলল – “স্যার, আমাকে কোনদিন কষ্ট দিবেন না, কখনো আমার থেকে বিচ্ছিন্ন হবেন না। আমি আপনাকে ছাড়া থাকতে পারব না।”

“আমিও কি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারব?” এই বলে রবি ওর কপালে চুমু দিল। “এসো…ওখানে বসি।”

রবি তার বাম দিকে দাঁড়িয়ে থাকা একটি বিশাল গাছের দিকে ইশারা করে তারপর কাঞ্চনের হাত ধরে সেদিকে বাড়তে থাকে। গাছের নিচে একটা বড় সমতল পাথর পড়ে ছিল। পাথরটি এত বড় যে ৩ জন মানুষ আরামে ঘুমাতে পারে। পাথর থেকে দুই কদম এগিয়েই ছিল গভীর খাদ। রবি গাছের গোড়ায় পিঠ ঠেকিয়ে বসে রইল। কাঞ্চন তার একটু সামনে বসে দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে থাকা ফুলের উপত্যকার দিকে তাকাতে লাগল।

যদিও কাঞ্চন এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আগেই দেখেছে। কিন্তু আজ তার দৃষ্টিভঙ্গিতে ছিল পার্থক্য। আজ সে দেখতে পেল ভালোবাসার রঙ মিশে আছে এই সুন্দর মোকদ্দমায়। সে যেদিকেই তাকালো দেখতে পেল সব গাছ, পাতা, চারাগাছ, ফুল তার দিকে তাকিয়ে হাসছে।

সূর্য ছিল দিগন্তের দিকে। বায়ুমণ্ডলে লালচে ভাব ছড়িয়ে পড়েছে। সন্ধ্যার লালে আরও সুন্দর হয়ে উঠছিল এই উপত্যকা। সব কিছু দেখতে দেখতে হারিয়ে গেল কাঞ্চন। কখন যে তার পিছনে বসে রবি তাকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছে সেটা সে নিজেও জানে না।

রবিও তার সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে সব ভুলে গিয়েছিল। তারপর কাঞ্চন ওর দিকে ফিরল। রবিকে এভাবে দেখে তার চোখে লজ্জা ফুটে উঠল, সে মৃদু লজ্জিত হয়ে বলল – “কি দেখছেন স্যার?”

“তুমি যা দেখছিলে তাই।” রবি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল।

“আমি তো এই উপত্যকার সৌন্দর্য দেখছিলাম।” কাঞ্চন মুচকি হেসে বলল- “কিন্তু আপনি তো…!” কথা অসম্পূর্ণ রেখে চোখ নামিয়ে নিলেন।

“তো কি ভুল বললাম। আমিও সৌন্দর্যই খুঁজছিলাম।”

“ধাত…!” কাঞ্চন লজ্জা পেল।

“সত্যি বলছি কাঞ্চন। সারা পৃথিবীতে তোমার মতো সুন্দরী মেয়ে আর নেই।” রবি তার সৌন্দর্যে হারিয়ে গিয়ে বলল।

“আপনি এক নম্বর মিথ্যাবাদী।” কাঞ্চন তার সুন্দর চোখ রবির মুখের দিকে রেখে বললো- “আমি জানি আমি খুব সুন্দরী নই। আমি নিক্কির মতো সুন্দর নই। আর শহরে নিশ্চয়ই আমার থেকে আরো অনেক সুন্দরী মেয়েরা থাকে। মাঝে মাঝে মনে হয় আপনি শহরের লোক। আপনি ফিরে গিয়ে আমাকে ভুলে যাবেন।”

“আহহহ … কি বললে কাঞ্চন? কেন ভাবছো আমি তোমাকে ছেড়ে যাব?” রবি সরে ওর কাছে গিয়ে বললো- “তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করো না? যদি তাই হয়, তাহলে তোমাকে আমার বউ না করা পর্যন্ত আমি শহরে যাব না। তোমাকে বিয়ে করার পর তোমাকে নিয়ে শহরে যাবো।”

“কিন্তু আপনার মা? তাকে ছাড়া বিয়ে করবেন?”

“আমি আমার মাকে এখানে ডাকব।” রবি ওর গাল চেপে ধরে বলল।

রবির কথায় কাঞ্চনের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। রবির কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করল।

রবি এক হাতে কাঞ্চনের কাঁধ ধরে অন্য হাতে চুলে আদর করতে থাকে। সে তার যৌবনের শুরুর মুহূর্তগুলি মনে করতে শুরু করে যখন তার বন্ধুরা তাকে নিয়ে মজা করত। সে তার একাকীত্ব নিয়ে কতটা আতঙ্কিত ছিল। তখন সে কখনো ভাবেনি যে একটা মেয়েও তাকে ভালোবাসতে পারে। কেউ তার প্রতিও আসক্ত হতে পারে। কিন্তু আজ ভাগ্য তাকে কাঞ্চনের সাথে মিশিয়ে দিয়ে তার সব অভিযোগ দূর করে দিয়েছে। মাঝে মাঝে তার মনে হয় সে গভীর ঘুমে আছে, এখন তার চোখ খুলবে এবং সবকিছু শেষ হয়ে যাচ্ছে।

তিনি কাঞ্চনের প্রেমে পড়েছিলেন। নিজেকে তার ভালোবাসার কাছে ঋণী মনে হলো। কাঞ্চনের দিকে তাকাল সে। সে এখনও চোখ বন্ধ করে তার কাঁধে মাথা রেখেছিল।

সে তার মাথায় আদর করে চুমু দিল।

চুমু খাওয়ার অনুভূতিতে কাঞ্চনের মনোযোগও বিক্ষিপ্ত হয়ে গেল। হয়তো সেও কিছু চিন্তায় মগ্ন ছিল। মৃদুস্বরে বললো- “স্যার, মা কখন আসবেন?”

“আজ আমি ওনাকে ফোন করে সব খুলে বলব। এবং এখানে আসার জন্য অনুরোধ করব।” রবি তার গালে হাত বুলিয়ে বললো – “সে যত তাড়াতাড়ি আসবে, আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গাঁট বেঁধে ফেলব।”

“মা জি… আপনার মা কি আমার মতো গ্রামের মেয়েকে মেনে নেবে?” কাঞ্চন আবার চিন্তিত হয়ে বলল।

“মাকে নিয়ে চিন্তা করছ কেন? সে পুরানো ধাঁচের একজন নারী। সে উচ্চ প্রফাইলের মেয়ে চায় না। সে তোমার মতো লাজুক ও ভদ্র মেয়েকেই পুত্রবধু হিসেবে চায়। সে চায় পুত্রবধূর মধ্যে মাত্র ২টি গুন। প্রথমত, সেই মেয়েটি বাড়ির লোকদের সম্মান করবে, দ্বিতীয়ত, ঘরের কাজকর্ম সামলাতে পারবে, ঘর ঠিকমতো দেখাশুনা করতে পারবে এবং নিজের হাতে খাবার তৈরি করে খাওয়াতে পারবে। মা সবসময় নিজের হাতে রান্না করে খাবার খেয়েছে। সে পুত্রবধুর হাতের খাবার খেতে পছন্দ করবে। এটুকুই। এখন নিশ্চয়ই এতটুকু সে চাইতেই পারে তাই না? এই বলে সে কাঞ্চনের দিকে তাকাল।

কাঞ্চন মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে কাঁদছিল। সারা জীবন চিন্টুর সাথে খেলে লাফিয়ে কাটিয়ে দিয়েছে। কদাচিৎ ঘরের কোন কাজ করেছে। আর রান্নার কথা বলতে গেলে চা ছাড়া আর কিছুই জানে না। রবির কথা শুনে সে চিন্তায় পড়ে গেল। মন ছটফট করছিল পালিয়ে বাড়ি গিয়ে বুয়ার কাছ থেকে রান্না শেখার।

“ওহ হ্যাঁ …..!” হঠাৎ রবি চমকে উঠে বললো- “খাওয়ার কথায় মনে পড়ে গেল। না, খিচড়ি….. খিচড়িও না …….হ্যাঁ, ক্ষীরের কথা মনে পড়ল ….. ক্ষীর করতে পারো তো তাই না, নিয়ে আসতে পারবে?”

কাঞ্চনের কষ্ট বাড়ল, প্রথমে সে চিন্তিত ছিল যে সে রান্নাই করতে জানে না, এখন সে রবির জন্য ক্ষীর রান্না করবে কীভাবে?

রবিকে কী উত্তর দেবে সে বুঝতে পারছিল না। যদি সে বলে যে আগামীকাল সে ক্ষীর তৈরি করে আনবে, তাহলে তাকে প্রতিদিন ক্ষীর আনতে হবে। আর যদি সে বলে যে সে ক্ষীর বানাতে জানে না, তাহলে যদি রবি রেগে যায়।

“কি ভাবছ?” রবি তাকে বাধা দেয়। “তুমি তো ক্ষীর বানাতে জানো, তাই না? আমি ছোটবেলা থেকেই ক্ষীর ভালোবাসি।”

“হ্যাঁ, স্যার, আমি আগামীকাল আপনার জন্য ক্ষীর তৈরি করব।” বলল কাঞ্চন। কিন্তু বলার পর গভীর চিন্তায় পড়ে গেল। “স্যার, এখন বাসায় যাবো? বুয়া তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে বলেছে।”

রবি কাঞ্চনের দিকে তাকাল। তার মুখে কষ্টের ছাপ কিন্তু এর সঠিক কারণ সে বুঝতে পারল না। হেসে বলে – “ঠিক আছে। তবে কাল তাড়াতাড়ি আসবে। আর ক্ষীর আনতে ভুলবে না।”

“জি।” কাঞ্চনও মাথা নাড়ে। তারপর চলে যাওয়ার জন্য উঠে পড়ল।

রবিও জুতা পরে উঠে দাঁড়াল। তারপর একসাথে দুজনে উঠে আসতে লাগলো। হঠাৎ রবি কাঞ্চনকে বললো- “ওহ, এটা তো ভুল কথা। আমাদের প্রথম প্রেমের মিলন শেষ হতে চলেছে অথচ আমরা একে অপরকে কোন চিহ্ন দেইনি।”

“চিহ্ন?” কাঞ্চন হতভম্ব হয়ে গেল। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে রবির দিকে তাকাল।

“বইয়ে পড়েছি, প্রেমের প্রথম সাক্ষাতে প্রেমিকরা একে অপরকে চুম্বন করে ভালোবাসার ইঙ্গিত দেয়, চুম্বন ছাড়া প্রেম অসম্পূর্ণ বলে মনে করা হয়। কিন্তু আমরা মোটেও চুমু খাইনি।”

রবির কথায় লজ্জা পেল কাঞ্চন। আর নিচের দিকে তাকাতে লাগলো।

“কি হয়েছে?” রবি দুই হাতে ওর মুখ ভরাট করতে করতে জিজ্ঞেস করল। “তুমি যদি না চাও তাহলে কোন জবরদস্তি নেই।”

কাঞ্চনের মনে হলো, আজ যদি সে রাজি না হয়, তাহলে যদি তার প্রতি রবির ভালোবাসা কমে যায়! – “আমি কি প্রত্যাখ্যান করেছি স্যার।” এই বলে সে লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ফেলল।

রবি তার মুখের দিকে তাকাল, যেখানে লজ্জার পাশাপাশি আত্মসমর্পণের গভীর ছাপ। সে মুখ নিচু করে কাঞ্চনের কাঁপা ঠোঁটে ঠোঁট রাখল।

কাঞ্চনের সারা শরীর কেঁপে ওঠে। সে রবির বাহুতে আবৃত্ত।

রবি একটা লম্বা চুমু খেয়ে ওর থেকে ওর ঠোঁট আলাদা করল। তারপর কাঞ্চনের চোখের দিকে তাকাল। লজ্জায় ও উত্তেজনায় তার চোখ লাল হয়ে গেছে।

“এখন মিলন শেষ।” রবি হাসল। “তুমি এখন বাড়ি যেতে পার।”

কাঞ্চন ভারি চোখের পলকে কিছুক্ষণ রবির দিকে তাকিয়ে থাকল, তারপর হঠাৎ লজ্জা পেয়ে নিজের পথে দৌড়ে গেল।

রবি তার বাইকের কাছে এলো। আসতেই পায়ের নিচ থেকে মাটি বেরিয়ে গেল।

নিক্কি জিপে বসে তার জন্য অপেক্ষা করছিল। যে জায়গায় রবি আর কাঞ্চন দাঁড়িয়ে চুমু খাচ্ছিল ওই জায়গাটা জীপ থেকে বেশি দূরে ছিল না। সেখান থেকে একটু নামলেই নিক্কি তাকে স্পষ্ট দেখতে পায়।

রবি বাইকে উঠে এল। তারপর নিক্কির দিকে তাকাল। তার চোখ চকচক করছিল। তার মুখ রাগে ফেটে পড়ার জন্য প্রস্তুত।

Leave a Reply